আমরা জানি সব প্রাণীই এক ধরনের বুদ্ধিমত্তা নিয়ে বড় হয়। বাঘ যখন হরিণ শিকার করে তখন সে তার বুদ্ধিমত্তা ব্যবহার করে। মাকড়াশা যখন জাল বুনে সেখানেও সে তার বুদ্ধিমত্তা ব্যবহার করে। আরও ক্ষুদ্র প্রাণী বা জীবাণু যখন অন্য কোনো প্রাণীকে আক্রমণ করে তখনও সে তার বুদ্ধিমত্তাকে ব্যবহার করে। যে সব প্রাণীর মস্তিষ্ক রয়েছে তাদের বুদ্ধিমত্তার বড় অংশ থাকে মস্তিষ্কে কিন্তু যাদের মস্তিষ্ক নেই সেই জীবাণুর মতো ক্ষুদ্র প্রাণীদের বুদ্ধিমত্তা থাকে কোথায়? সেগুলো থাকে তাদের জীনস এর মাঝে ডি.এন.এ সাজানো নিওক্লিওটাইডে। এই বুদ্ধিমত্তা কিংবা তথ্য কিন্তু কম নয়। একজন মানুষের শরীরের একটি ক্রমোজমে প্রায় 5 বিলিওন নিওক্লিওটাইডের জোড়া। A,T,C এবং G এই চার ধরনের নিউক্লিওটাইড দিয়ে 20 বিলিওন বিটস তথ্য রাখা সম্ভব। মানুষে মস্তিষ্কের মাঝে রাখা তথ্যের তুলনায় সেটি মোটেও কম নয়। তবে এই তথ্যগুলো নিজের প্রয়োজনে। পরিবর্তন করা যায় না, বাড়ানো যায় না, কমানো যায় না। প্রকৃতির নীল নকশা অনুযায়ী এটা পাকাপাকিভাবে রেখে দেয়া হয়েছে। ‘ প্রাণিজগৎ বিবর্তনের মাঝে দিয়ে এ-রকম অবস্থায় পৌঁচেছে। একটা সময় ছিল যখন প্রাণিজগতের পুরো বুদ্ধিমত্তাটাই ছিল এই জিন্স বা ডি.এন.এ.র ভেতরে। ধীরে ধীরে প্রাণিজগতের মাঝে মস্তিষ্কের বিকাশ হলো এবং এই মস্তিষ্কে বুদ্ধিমত্তার জন্ম হতে শুরু করল। আজ থেকে প্রায় একশ মিলিওন (দশ কোটি) বছর আগে প্রথমবারের মতো একটা প্রাণীর মস্তিষ্কের বুদ্ধিমত্তা তার ডি.এন.এ.তে রাখা বুদ্ধিমত্তাকে অতিক্রম করে যায়। বিবর্তনের পরিমাপে নিঃসন্দেহে সেটা ছিল খুব বড় একটা মাইলফলক। ধীরে ধীরে সরীসৃপের জন্ম হলো স্তন্যপায়ী প্রাণী এলো এবং একসময় মানুষের জন্ম হলো।
বুদ্ধিমত্তার হিসেবে মানুষ কিন্তু অন্যসব প্রাণী থেকে একটি বিষয়ে একেবারে আলাদা। মানুষ হচ্ছে প্রথম প্রাণী যে তার বুদ্ধিমত্তার জন্যে শুধুমাত্র তার মস্তিষ্কের উপর নির্ভরশীল নয়। মানুষের অনেক বুদ্ধিমত্তা তার মস্তিষ্কের বাইরে, বইপত্রে, কাগজে জার্নালে। অনেক তথ্য কম্পিউটারে, লাইব্রেরিতে, ইন্টারনেটে। একটা প্রাণী যখন বুদ্ধিমত্তার জন্যে হঠাৎ করে শুধুমাত্র তার মস্তিষ্কের উপর নির্ভরশীল না থাকে সে মস্তিষ্কের বাইরে থেকে বুদ্ধিমত্তা সংগ্রহ করতে পারে তখন পুরো বিষয়টা অন্যরকম হয়ে যায়।
এ-রকম একটা প্রাণীর বিবর্তন কেমন করে অগ্রসর হয় আমরা আজ সেটা বলতে পারব না। আজ থেকে লক্ষ বৎসর পরের মানুষ সেটা সে খুব কৌতূহলী হয়ে দেখবেন সে ব্যাপারে আমার কোনো সন্দেহ নেই।
.
13. ঘুমের কলকব্জা
আমাদের জীবনে যে কয়টা নিয়মিত বিষয় রয়েছে ঘুম হচ্ছে তার মাঝে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ একটি। আমাদের সবার প্রত্যেকদিন ঘুমাতে হয়। কেউ একটু বেশি ঘুমায় কেউ একটু কম। বিজ্ঞানী টমাস আলভা এডিসন ঘুমটাকে সময় নষ্ট বলে মনে করতেন তাই তিনি রাতে মাত্র চার ঘণ্টা ঘুমাতেন। আবার বিজ্ঞানী আইনস্টাইন বলতেন রাতে যদি তিনি দশ ঘণ্টা না ঘুমান তিনি ঠিক করে কাজ করতে পারেন না। যেহেতু চব্বিশঘণ্টার মাঝে সবাইকে একবার হলেও ঘুমাতে হয় তাই সবারই জানা উচিত তার আসলে কতটুকু ঘুমের দরকার। দেখা গেছে যার যেটুকু ঘুমের দরকার সে যদি তার থেকে কম সময় ঘুমায় তাহলে সে হয়তো এক দুই ঘণ্টা সময় বাঁচিয়ে ফেলে ঠিকই কিন্তু আসলে খুব একটা লাভ হয় না। কম ঘুমানোর কারণে সে সারা দিন ঘুমঘুম ভাব নিয়ে থাকে, তার মাঝে সতেজ উৎফুল্ল ভাবটা থাকে না, খিটখিটে মেজাজ হয়ে থাকে বলে সে আসলে যতটুকু কাজ যত সুন্দরভাবে করতে পারতো তার কিছুই পারে না। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র গবেষণা করে দেখেছে কম ঘুমনোর কারণে গাড়ি চালাতে চালাতে ঘুমিয়ে পড়ার কারণে সেই দেশে বছরে প্রায় দুই লক্ষ একসিডেন্ট হয়ে মানুষ মারা যায় প্রায় পাঁচ হাজার। একটা সময় ছিল যখন দিনের বেলা সবাই কাজকর্ম করতো, রাত্রিবেলাটি ছিল বিশ্রামের। লাইট বাল্ব অবিষ্কার হওয়ার পর হঠাৎ করে রাত আর রাত থাকল না। বলা যায় রাতারাতি দিন রাতের পার্থক্যটা ঘুচে যাওয়ায় মানুষের ঘুমের সময় কমে এলো। পৃথিবী এখন রাতে ঘুমায় না, রাতের পৃথিবী সচল রাখার জন্যে অনেক মানুষকে রাতে কাজ করতে হয়। দেখা গেছে যারা রাতে কাজ করে তাদের অর্ধেক মানুষই কখনো-কখনো কাজের মাঝে ঘুমিয়ে পড়ে। কাজের ক্ষতি হয়, একসিডেন্ট হয়, হাসপাতালে দৌড়াদৌড়ি করতে হয়, সব মিলিয়ে ক্ষতির পরিমাণ শুধু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেই বছরে সত্তর বিলিওন ডলার (প্রায় চাশ বিশ হাজার কোটি টাকা)। শুধু যে আর্থিক ক্ষতি তা নয় পৃথিবীর সবচেয়ে বড় দুটি নিউক্লিয়ার একসিডেন্ট চেরনোবিল এবং থ্রি মাইল আইল্যান্ড হয়েছিল ভোররাতে, যখন মানুষ হয় সবচেয়ে ঘুমকাতুরে সবেচেয়ে ক্লান্ত। দু জায়গাতেই দুর্ঘটনাগুলি ঘটেছিল কারণ রাতের শিফটের কর্মকর্তরা বিপদ সংকেতগুলো সময়মতো ধরতে পারে নি।
আধুনিক পৃথিবীতে আমরা এখন শুধু ছুটছি, আমাদের বিশ্রাম নেবার সময় নেই। আমরা চেষ্টা করি কম সময় ঘুমিয়ে কত বেশি কাজ করতে পারি। কিন্তু বিজ্ঞানীরা ঘুম নিয়ে গবেষণা করে আবিষ্কার করেছেন যে, ঘুম এমন একটা বিষয় যে এখানে ফাঁকি দেবার কোনো সুযোগ নেই। একজন মানুষের যেটুকু ঘুমের দরকার তাকে ততটুকু ঘুমাতেই হবে, যদি না ঘুমায় তাহলে তাকে জীবনের অন্য জায়গায় অনেক বেশি মূল্য দিতে হবে।