একটা প্রাণীর শরীরের তুলনায় তার মস্তিষ্ক কত বড় সেটা বুদ্ধিমত্তার একটা পরিমাপ হতে পারে জানার পর স্বাভাবিকভাবে যে প্রশ্নটা প্রথমে আসে সেটা হচ্ছে। কোন প্রাণী এই তালিকায় সবার আগে? কার মস্তিষ্ক তার শরীরের তুলনায় সবচেয়ে বড়? উত্তরটা অনুমান করা খুব কঠিন নয়–প্রাণীটা হচ্ছে মানুষ। এদিক দিয়ে মানুষের সবচেয়ে কাছাকাছি প্রাণী হচ্ছে ডলফিন। সম্ভবত এটা মোটেও কাকতালীয় ব্যাপার নয় যে ডলফিনের বুদ্ধিমত্তা নিয়ে নাবিক এবং জাহাজীদের মাঝে অসাধারণ কিছু গল্প প্রচলিত আছে। অতি সাম্প্রতিক সুনামির সময়েও ডলফিনদের বুদ্ধি ব্যবহার করে কিছু মানুষের প্রাণরক্ষার খবর সংবাদপত্রে ছাপা হয়েছে।
পৃথিবীর অতিকায় প্রাণীদের মাঝে অন্যতম হচ্ছে ব্লু হোয়েল এবং অবলুপ্ত প্রাণীদের মাঝে হচ্ছে ডাইনোসর। ডাইনোসর সরীসৃপ জাতীয় প্রাণী তাই তাদের মস্তিষ্কের আকার ছোট হওয়ারই কথা কিন্তু ব্লু হোয়েল জাতীয় তিমিদের তুলনায় তার মস্তিষ্ক একশ গুণ ছোট। মানুষের মস্তিষ্ক থেকে সেটা প্রায় সাড়ে ছয় গুণ বড়, এই তিমিরা তাদের এত বড় মস্তিষ্ক নিয়ে কী করে সেটা অনেকের কাছেই রহস্য। তাদের কী চিন্তা করার ক্ষমতা আছে? দূরদৃষ্টি আছে? দুঃখ বা ভালোবাসার মতো উন্নত অনুভূতি আছে? মাঝে মাঝেই যে তিমি মাছেরা দল বেঁধে সমুদ্রের তীরে বালুবেলায় ঝাঁপিয়ে পড়ে আত্মাহুতি দেয় তার পিছনে কী কোনো বেদনা বা বিষণ্ণতা কাজ করে? কে তার উত্তর দেবে!
মস্তিষ্কের আয়াতন বা ওজন নিয়ে কথা বলতে চাইলেই তার ভেতরকার তথ্য বা বুদ্ধিমত্তাকে কোন একধরনের সংখ্যা দিয়ে প্রকাশ করার ইচ্ছে করে। মানুষের মস্তিষ্কের কোষ বা নিউরণের সংখ্যা হচ্ছে দশ বিলিওন (এক হাজার কোটি)। এই নিউরনগুলো অন্য নিউরনের সাথে যে যোগসূত্র দিয়ে যুক্ত তার নাম হচ্ছে সিনান্স। প্রতিটি নিউরণের গড়ে এক হাজারটি করে সিনান্স রয়েছে এবং সেই এক হাজার সিনান্স দিয়ে প্রত্যেকটি নিউরন আরো এক হাজার নিউরনের সাথে যোগাযোগ রাখে। আজকাল কম্পিউটারের সাথে পরিচিত হওয়ার কারণে তথ্যকে আমরা বিট (bit) হিসেবে গুণতে শিখেছি। কোনো একটা তথ্যকে যদি একটি “হ্যাঁ” কিংবা একটি “না” দিয়ে প্রকাশ করা যায় সেটা হচ্ছে একটি বিট। কাজেই আমরা যদি ধরে নিই সিনান্স সংযোগ শুধু মাত্র ‘হ্যাঁ’ কিংবা না দিয়ে তথ্যের আদান-প্রদান করা হয় তাহলে যেহেতু মোট সিনালের সংখ্যা হচ্ছে দশ হাজার বিলিওন (দশ লক্ষ কোটি) কাজেই মস্তিষ্কের রাখা তথ্যের পরিমাণও হবে দশ হাজার বিলিওন বিট বা কম্পিউটারের ভাষায় এক টেরা বাইট।
এটি বেশি কিংবা কম সেই বিষয়ে যাবার আগে আমরা অন্য একটা বিষয় : দেখতে পারি। যদি মাথায় শুধু একটা সিনা থাকত তাহলে পুরো মন্ত্রিক শুধু দুটো অবস্থায় থাকতে পারতো (একটি হচ্ছে ‘হ্যাঁ’ অন্যটি হচ্ছে না’)। যদি সিনা সংখ্যা হতে দুই তাহলে মস্তি ষ্কের সম্ভাব্য অবস্থা হতে পারতো চার (প্রথমটি ‘হ্যাঁ’ দ্বিতীয়টি ‘হ্যাঁ,’ প্রথমটি হ্যাঁ’ দ্বিতীয়টি ‘না’, প্রথমটি ‘না’ দ্বিতীয়টি ‘হ্যাঁ’ এবং প্রথমটি ‘না’ দ্বিতীয়টিও ‘না’)। সিনান্সের সংখ্যা যদি হতো তিন তাহলে মস্তিষ্কের সম্ভাব্য অবস্থা হতো আট। এভাবে আমরা দেখাতে পারি সিনা সংখ্যা যখন দশ হাজার বিলিওন তখন আমাদের মস্তিষ্কের সম্ভাব্য অবস্থার মোট, সংখ্যা হচ্ছে 10^39, ছোট একটুখানি জায়গায় লিখে ফেললেও সংখ্যাটি অনেক বড়, আমাদের এই সৃষ্টিজগৎ, বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে যত অনু-পরমাণু আছে এটি তার থেকেও বড়। মানুষের মস্তিষ্ক এই অচিন্ত্যনীয় সংখ্যক অবস্থায় মাঝে যেতে পারে। একজন মানুষ তার জীবদ্দশায় কখনোই তার সকল সম্ভাবনাগুলোর ভেতর দিয়ে যেতে পারে না। সব মানুষের মস্তিষ্কেই অসংখ্য অজানা অবস্থাগুলো রয়ে যায় তাই প্রত্যেকটা মানুষই এত স্বতন্ত্র এত ভিন্ন। মানুষের মাঝে তাই এত রহস্য। মনে রাখতে হবে কম্পিউটারে ব্যবহৃত ট্রানজিস্টরে শুধু ‘হ্যাঁ’ ‘না’ এই দুটি পর্যায় থাকতে পারে বলে আমরা সিনান্সের বেলাতেও তাই ধরেছি। মানুষের সিনান্সে ট্রানজিস্টরের সীমাবদ্ধতা নেই, সেগুলোকে শুধু ‘হ্যাঁ’ ‘না’ এই দুই পর্যায়ে সীমাবদ্ধ থাকতে হয় না, প্রতিটি সংযোগ আরো বেশি পর্যায়ের ভেতর দিয়ে যেতে পারে। কাজেই মস্তিষ্কের প্রকৃত অবস্থার সংখ্যা আরো অনেক বেশি।
মানুষের মস্তিষ্কের সাথে কম্পিউটারের তুলনা করা এক অর্থে ছেলেমানুষি একটি প্রক্রিয়া হলেও সেটা যখন শুরু করা হয়েছে সেটাকে আরো একটু এগিয়ে নেয়া যায়। আমরা যদি তথ্য সংরক্ষণের ব্যবহৃত ইলেকট্রনিক চীপস বা ইন্টেগ্রেটেড সার্কিটের সাথে মস্তিষ্কের তুলনা করি তাহলে দেখব আমরা প্রতি একক আয়াতনে তথ্য সংরক্ষণের ক্ষেত্রে এখনো দশ হাজার গুণ পিছিয়ে আছি। অন্যভাবে বলা যায় মানুষের মস্তিষ্কে যেটুকু আয়াতনে যতটুকু তথ্য রাখা যায়, ইন্টোগ্রটেড সার্কিটে একই পরিমাণ তথ্য রাখতে হলে তার জন্যে জায়গা লাগবে দশ হাজার গুণ বেশি!
বিজ্ঞানীরা ল্যাবরেটরিতে প্রাণীর মাঝে পরীক্ষা করে একটা গুরুত্বপূর্ণ এবং সাধারণ মানুষের জন্যে আশাব্যঞ্জক তথ্য পেয়েছেন। তারা দেখেছেন একটা প্রাণীকে যদি খুব সাদামাটাভাবে রাখা হয় তাহলে তার মস্তিষ্কও হয় সাদামাটা। কিন্তু প্রাণীটাকে যদি খুব উত্তেজনাপূর্ণ পরিবেশে নতুন নতুন চিন্তাভাবনার ক্ষেত্র তৈরি করে নানারকম সমস্যা সমাধানের সুযোগ করে রাখা হয় তাহলে তার মস্তিষ্কের গুণগত পরিবর্তন হয়ে যায়। তার মস্তিষ্কের সিনালের মাঝে নূতন নূতন সংযোগ তৈরি হতে থাকে। আমরা মানুষের মেধা বলে একটা কথা ব্যবহার করি, সেই ‘মেধা’ শব্দটি দিয়ে আমরা যদি চিন্তাভাবনা বা বিশ্লেষণ করার ক্ষমতাকে বুঝিয়ে থাকি তাহলে বুঝতে হবে একজন মানুষ যেটুকু মেধা নিয়ে জন্ম নিয়েছে তাকে ততটুকু নিয়ে সন্তুষ্ট থাকতে হবে না। সে ক্রমাগত তার মস্তিষ্ক ব্যবহার করে নূতন কিছু শিখে তার নিউরনের নূতন সিনান্স সংযোগ বাড়াতে পারে, অন্য কথায় বলা যায় তার মেধা বাড়াতে পারে।