যে বিজ্ঞানী মানুষের ডান এবং বাম মস্তিষ্ক নিয়ে গবেষণা করে এই বিষয়গুলো আবিষ্কার করেছিলেন তার নাম রজার স্পেরী, তিনি তার এই কাজের জন্যে নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন।
মস্তিষ্কের বাম এবং ডান গোলার্ধের এই চমকপ্রদ বিষয়গুলো কিন্তু আমরা নিজেরাও পরীক্ষা করে দেখতে পারি। ধারণা করা হয় আমাদের সচেতন সময়ে বাম গোলার্ধ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। আমরা যখন ঘুমাই তখন বাম গোলার্ধ দমিত হয়ে থাকে। হঠাৎ করে যদি কাউকে ঘুম থেকে জাগানো হয়, দেখা যায় সে পরিষ্কার জানে কী বলতে হবে কিন্তু কথা বলতে পারে না! ভাষার নিয়ন্ত্রণ বাম গোলার্ধে ঘুমের মাঝে সেটা দমিত ছিল তাই হঠাৎ করে নিয়ন্ত্রণটা নিতে পারছে না। পুরাপুরি জেগে ওঠার পরেই শুধু একজন মানুষ গুছিয়ে কথা বলতে পারে।
ধারণা করা হয় আদিকালে নিওকর্টেক্সের দুই অংশই একই ধরনের দায়িত্ব পালন করতো। বিবর্তনের ধারায় ধীরে ধীরে দুই গোলার্ধ যুক্তিতর্ক এবং অবচেতন মনের অন্ত জ্ঞানসংক্রান্ত কাজ এই দুটি দায়িত্ব পালন করতে শুরু করেছে। বাম গোলার্ধ একটু বেশি হিসেবি, ডান গোলার্ধ একটু বেশি কল্পনা প্রবণ। নূতন পৃথিবীতে চেষ্টা করা হচ্ছে সফল মানুষকে তাদের মস্তিষ্কের দুই গোলার্ধকেই সুষম উপস্থাপন করে সমন্বয় করা শিখতে।
তা হলেই হয়তো তারা সত্যিকার মানুষ হতে পারবে।
.
12. বুদ্ধিমত্তা : মস্তিষ্কের ভেতরে এবং বাইরে
প্রাণিজগতে সবারই কমবেশি বুদ্ধিমত্তা রয়েছে–মানুষ হিসেবে আমাদের বুদ্ধিমত্তা সবচেয়ে বেশি। এই বুদ্ধিমত্তা ব্যবহার করে আমরা কী করতে পারি চারপাশে তাকালেই সেটা চোখে পড়ে। তার সবগুলোই যে খুব ভালো সেটা খুব জোর দিয়ে বলা যাবে না। যেমন আমাদের এই বুদ্ধিমত্তা আছে বলেই আমরা সমস্ত পৃথিবীটাকে অনেকবার ধ্বংস করে ফেলার মতো অস্ত্রভাণ্ডার তৈরি করে মহানন্দে বসে আছি। তবে মানুষের শুভ বুদ্ধির ওপরে আমাদের বিশ্বাস আছে, শেষ পর্যন্ত মানব জাতি সভ্যতার পথ ধরে সুন্দর ভবিষ্যতের দিকে অগ্রসর হবে এটা আমরা সব সময়েই মনেপ্রাণে বিশ্বাস করি।
আমাদের কিংবা অন্য প্রাণীদের বুদ্ধিমত্তা শরীরের যে জৈবিক অংশ থেকে আসে সেটাকে আমরা বলি মস্তিষ্ক। “অমুকের কলিজা খুব শক্ত” “অমুকের হৃদয়টা খুব নরম” কিংবা “অমুকের বুকে খুব কষ্ট” এ রকম কথাবার্তা বলে আমরা মানুষের চরিত্র বা অনুভূতির জন্যে শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ প্রত্যেঙ্গের নাম ব্যবহার করলেও আসলে সবকিছুর কেন্দ্রবিন্দু কিন্তু মস্তিষ্ক। মানুষের মস্তিষ্কের ওজন দেড় কেজি থেকে একটু কম (1375 gm)। মস্তিষ্কের ঘনত্ব শরীরের অন্যান্য টিস্যুর মতো পানির ঘনত্বের কাছাকাছি। কাজেই মস্তিষ্কের আয়তন দেড় লিটারের মতো (1375cc)। অর্থাৎ, মাঝারি মিনারেল ওয়াটারের একটা বোতলে মানুষের পুরো মস্তিষ্কটা এঁটে যায়।
তবে সব মানুষের মস্তিষ্কের আয়তন সমান নয়। পূর্ব দেশীয় মানুষের মস্তিষ্ক তুলনামূলকভাবে পশ্চিম দেশীয় মানুষ থেকে বড়। আবার পুরুষের মস্তিষ্ক তুলনামূলকভাবে মহিলাদের মস্তিষ্ক থেকে বড়। তবে আয়তনের এই পার্থক্যটুকু কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ নয়। পৃথিবীতে আয়তনে বড় মস্তিষ্কের মানুষের মাঝে রয়েছেন কবি বায়রন বা ইভান তুর্গনেভ (2,200 gm)। তবে মস্তিষ্কের সর্বোচ্চ ব্যবহারে পৃথিবী থেকে একজনকে বেছে নিতে হলে যে মানুষটিকে বেছে নিতে হবে তিনি হচ্ছেন বিজ্ঞানী আইনস্টাইন, তার মস্তিষ্ক কিন্তু বায়রন বা তুর্গনেভের মতো বড় ছিল না। আবার পৃথিবীর অসংখ্য মানুষ থেকেও বেশি প্রতিভাবান নোবেল পুরস্কার বিজয়ী সাহিত্যিক আনাতলি ফ্রান্সের (Anatolc Frana) মস্তিষ্কের আয়তন ছিল রীতিমতো ছোট (মাত্র 1100 gm) বায়রনের অর্ধেক। কাজেই একজন মানুষের মস্তিষ্কের আয়াতন বা ওজন যেটুকু হওয়া উচিৎ, তার চাইতে দুই একশ গ্রাম বেশি বা কম হলে সেটা বুদ্ধিমত্তার ক্ষেত্রে কোনোই পার্থক্য সৃষ্টি করে না, সেটাই হচ্ছে বিজ্ঞানীদের অভিমত।
একটা বড় প্রাণী হলে তার বড় শরীরকে নিয়ন্ত্রণ করতে তুলনামূলকভাবে একটা বড় মস্তিষ্ক দরকার আবার প্রাণীটা ছোট হলে তার ছোট শরীরের নিয়ন্ত্রণের জন্যে মস্তিষ্কটা ছোট হলেই চলে। কাজেই মস্তিষ্কের প্রকৃত পরিমাণ থেকে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে সেটি তার শরীরের ওজনের কত অংশ। গবেষকরা পৃথিবীর সকল প্রাণীর মস্তিষ্কের ওজনকে শরীরের ওজন দিয়ে ভাগ দিয়ে একটা চমকপ্রদ তথ্য খুঁজে পেয়েছেন। তারা দেখেছেন প্রাণিজগতকে সুনির্দিষ্টভাবে দুই ভাগে ভাগ করা যায়। একভাগে পড়ে স্তন্যপায়ী প্রাণী এবং পাখি, অন্যভাগে পড়ে মাছ এবং সরিসৃপ জাতীয় প্রাণী। সব সময়েই দেখা গেছে স্তন্যপায়ী প্রাণী এবং পাখিদের মস্তিষ্কের আকার মাছ এবং সরিসৃপ থেকে প্রায় দশগুন বেশি। গবেষকদের এই তথ্য ছাড়াও আমরা কিন্তু এই তথ্যের কথা অনুমান করতে পারতাম। অনেক মানুষই সঙ্গী হিসেবে কুকুর কিংবা বেড়াল পুষে । সার্কাসে বাঘ, ভালুক, হাতি, ঘোড়া এমন কি পাখিদের ট্রেনিং দিয়ে খেলা দেখানো হয়। মাছ কিংবা সরীসৃপদের ট্রেনিং দিয়ে খেলা দেখানোর কোনো রেওয়াজ নেই। আমাদের দেশে সাপুড়েরা সাপের খেলা দেখায় কিন্তু সেটা কোনো বুদ্ধির খেলা নয়। সাপুড়েরা ঝাপি থেকে তাদের বের করে এবং সাপগুলো ফণা তুলে বসে থাকে, এই পর্যন্তই। পৃথিবীর অনেক বিনোদন কেন্দ্রে ডলফিন এবং তিমি মাছ খেলা দেখায় কিন্তু সেগুলোকে মাছ বলা হলেও আসলে তারা মাছ নয়, আসলে সেগুলো স্তন্যপায়ী প্রাণী।