নিওকর্টেক্স বা উচ্চতর ব্রেন দুই ভাগে বিভক্ত। একটা বাম গোলার্ধ অন্যটি ডান গোলার্ধ। এটি এমন কিছু বিচিত্র নয়, কারণ আমাদের প্রায় সবকিছুই দুটি করে–আমাদের হাত দুটি, পা দুটি, চোখ, ফুসফুস কিডনী দুটি, কাজেই মস্তিষ্কের সবচেয়ে বিকশিত অংশটিও দুই ভাগে ভাগ থাকবে তাতে অবাক হবার কী আছে? তবে এখানে যে জিনিসটি বিচিত্র সেটি হচ্ছে মস্তিষ্কের এই বাম এবং ডান গোলার্ধ একজন মানুষের চরিত্রের সম্পূর্ণ ভিন্ন দুটি দিককে নিয়ন্ত্রণ করে। একেবারে এক কথায় যদি বলতে হয় তাহলে বলতে হবে বাম গোলার্ধ হচ্ছে যুক্তি এবং বিশ্লেষণের জন্যে (critical analysis) এবং ডান গোলার্ধ হচ্ছে অর্ন্তজ্ঞান (intution) এর জন্যে। মস্তিষ্কের এই দুটি গোলার্ধ একেবারে ভিন্ন ভিন্ন দুটি দায়িত্ব পালন করলেও তারা একেবারে আলাদা নয়। এই দুটি আলাদা গোলার্ধ কর্পাস কেলুসাম নামে এক ধরনের নিউরাল তন্তু দিয়ে যুক্ত। অর্থাৎ, বাম এবং ডান গোলার্ধের মাঝে যোগাযোগ আছে এবং একজন মানুষ একই সাথে যুক্তি দিয়ে বিশ্লেষণ করতে পারে আবার নিজের অর্ন্তজ্ঞানও খানিকটা ব্যবহার করতে পারে।
মস্তিষ্কের বাম গোলার্ধে যুক্তিবাদী চিন্তা এবং বিশ্লেষণ ছাড়াও ভাষা, নিয়ম, পদ্ধতি, গণিত, পরিমিতি বোধ এই বিষয়গুলোও নিয়ন্ত্রণ করে। আবার ডান গোলার্ধে রয়েছে একটা বস্তুকে দেখে তার জ্যামিতিক বা ত্রিমাত্রিক রূপ বোঝার শক্তি, দার্শনিক চিন্তা, অবচেতন এবং উপমা বা কল্পনার জগৎ অনুভব করার ক্ষমতা। বাম গোলার্ধে সবকিছু ঘটে পরপর, ডান গোলার্ধে সামগ্রিকভাবে একসাথে। একেবারে ভিন্ন ধরনের দুটি মননশীল প্রক্রিয়া দুই গোলার্ধে আলাদা আলাদাভাবে ঘটে এবং কর্পাস কেলুসামের সেতু দুধরনের প্রক্রিয়ার মাঝে একটা সামঞ্জস্য নিয়ে আসে। কাজেই যে মানুষটির ভেতর কল্পনার একটা জগৎ রয়েছে, জীবন সম্পর্কে দার্শনিকভাবে চিন্তা করে সেই একই মানুষ জীবনের খুঁটিনাটি হিসেবগুলোও করে সতর্কভাবে সিদ্ধান্ত নিতে পারে। তারপরেও আমরা কিন্তু একজন মানুষের মাঝে তার মস্তিষ্কের একটা গোলার্ধের প্রাধান্য খুঁজে পাই। যাদের ভেতর বাম গোলার্ধের প্রাধ্যনা বেশি তারা অত্যন্ত হিসেবী এবং সতর্ক। যার ভেতরে ডান গোলার্ধের প্রাধান্য সে একটু কল্পনাপ্রবণ, অন্তজ্ঞানের উপর একটু বেশি নির্ভরশীল মানুষ।
মানুষের মস্তিষ্কের বাম এবং ডান গোলার্ধ যে একেবারে ভিন্ন ভিন্ন কাজ করে সেটি নিয়ে বিজ্ঞানীরা খুব চমৎকার গবেষণা করেছেন। এই গবেষণাটি করা সম্ভব হয়েছে কিছু দুর্ভাগা মানুষের কারণে। এই মানুষগুলো মৃগী রোগাক্রান্ত এবং তাদের অবস্থা এতই ভয়ানক যে প্রতি ঘণ্টায় কয়েক বার মৃগী রোগের খিচুনি শুরু হয়ে যায়। কোনো উপায় না দেখে মস্তিষ্কের ডাক্তাররা অনেক চিন্তাভাবনা করে তাদের মস্তিষ্কের বাম এবং ডান গোলার্ধের যে যোগসূত্র সেই কর্পাস ফেলুসামটিকে কেটে দিলেন। এর ফলে তাদের মৃগী রোগের খিচুনির সমস্যা প্রায় পুরাপুরি মিটে গেল এবং আপাতঃদৃষ্টিতে তাদেরকে পুরাপুরি স্বাভাবিক মানুষ মনে হতে লাগল। কিন্তু কর্পাস কেসাম কেটে দেয়ার কারণে বাম গোলার্ধ এবং ডান গোলার্ধের মাঝে আর কোনো যোগাযোগ রইল না। তাদের মস্তিষ্কে দুটো গোলার্ধই আছে কিন্তু সেগুলো আর একসাথে সমন্বিতভাবে কাজ করতে পারে না। সেগুলো কাজ করে সম্পূর্ণ আলাদা ভাবে।
এই মানুষগুলোকে আপাতঃদৃষ্টিতে সম্পূর্ণ স্বাভাবিক মানুষ মনে হলেও তাদের ভেতর কিছু অস্বাভাবিক বিষয় লক্ষ করা গেল। সেই অস্বাভাবিক বিষয়গুলো বোঝার জন্যে আরেকটা বিষয় জানা দরকার, মানুষের শরীরের ডানদিকের অংশ–হাত, পা, চোখের ডান পাশের দৃশ্যমান এলাকা, নাকের ডান অংশের গন্ধ নেবার ক্ষমতা সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করে মস্তিষ্কের বাম দিকের গোলার্ধ। ঠিক সেরকম তার শরীরের বাম দিকের সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করে ডানদিকের অংশ। এবারে বিজ্ঞানীদের পরীক্ষাগুলোর কথা বলা যেতে পারে। তারা দ্বিখণ্ডিত মস্তিষ্কের এই মানুষগুলোকে ত্রিমাত্রিক কিছু ছবি দেখিয়ে সেগুলো আঁকতে বললেন, একবার বাম হাতে আরেকবার ডান হাতে। আমরা আগেই বলেছি মস্তিষ্কের ডান গোলার্ধ ত্রিমাত্রিক রূপ বুঝতে পারে ডান গোলার্ধ বাম হাতকে নিয়ন্ত্রণ করে, তাই দেখা গেল বাম হাত দিয়ে মানুষগুলো বেশ সুন্দর করে ত্রিমাত্রিক ছবি একেঁছে। আবার সেই একই মানুষ যখন ডান হাত দিয়ে সেই একই ছবি আঁকার চেষ্টা করেছে (যদিও সে ডান হাত দিয়েই সবকিছু করে) দেখা গেল কিছুই আঁকতে পারছে না। তার ডান হাতটি নিয়ন্ত্রণ করে মস্তিষ্কের বাম গোলার্ধ সেটি ত্রিমাত্রিক রূপ ধরতে পারে না। যেহেতু মস্তিষ্কের দুই গোলার্ধের মাঝে সব যোগাযোগ কেটে দেয়া হয়েছে তাই এক গোলার্ধ আর অন্য গোলার্ধকে সাহায্য করতে পারছে না। দ্বিখণ্ডিত মস্তিষ্কের মানুষগুলোকে নিয়ে সবচেয়ে চমকপ্রদ পরীক্ষাটি ছিল এ-রকম (11.4নং ছবি): তার সামনে বাম চোখের দৃষ্টি সীমার মাঝে “বই” লেখা শব্দ রেখে মানুষটাকে জিজ্ঞেস করা হলো এখানে কী লেখা আছে? মানুষটাকে পুরাপুরি বিভ্রান্ত দেখা গেল, সে দেখছে শব্দটা বই কিন্তু সেটা বলতে পারছে না। কারণ, যেহেতু বাম চোখের দৃষ্টি সীমার মাঝে সেটা গিয়েছে মস্তিষ্কের ডান গোলার্ধে, কিন্তু মস্তিষ্কের ডান গোলার্ধে ভাষার ব্যাপারটি নেই তাই মানুষ “বই”য়ের মতো পরিচিত শব্দটাও মুখে বলতে পারছে না। তখন তাকে বলা হলো শব্দটা লেখো মানুষটা বাম হাতে পরিষ্কার লিখে ফেলল “বই”। যেহেতু সেটা মস্তিষ্কের ডান গোলার্ধে আছে সেটা নিয়ন্ত্রণ করছে বাম হাত তাই বাম হাতে লেখা তার জন্যে কোনো সমস্যা নয়। দ্বিখণ্ডিত মস্তিষ্কের এই মানুষটি শব্দটি লিখতে পারে কিন্তু বলতে পারে না!