কোপার্নিকাস গ্রহ-নক্ষত্র এবং চন্দ্র-সূর্যকে পর্যবেক্ষণ করে একটি বৈজ্ঞানিক সূত্রে উপস্থিত হয়েছিলেন, বিজ্ঞানীরা সব সময় এ-রকম পর্যবেক্ষণের উপর নির্ভর করেন না। যেটা পর্যবেক্ষণ করতে চান সম্ভব হলে সেটি গবেষণাগারে তৈরি করে সেটাকে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে থাকেন। একসময় মনে করা হতো সমস্ত বিশ্বজগৎ, গ্রহ, নক্ষত্র সবকিছু ইথার নামক অদৃশ্য এক বস্তুতে ডুবে আছে, পানিতে যেরকম ঢেউ তৈরি করা হয় আলো সেরকম ইথারের মাঝে তৈরি করা ঢেউ। বিজ্ঞানীরা তখন একটি চুলচেড়া পরীক্ষা করতে শুরু করলেন, পরীক্ষার উদ্দেশ্য ইথারের মাঝে দিয়ে পৃথিবী কত বেগে ছুটে যাচ্ছে সেটা বের করা। মাইকেলসন (আলবার্ট এ মাইকেলসন) এবং মোরীর (এডওয়ার্ড ডাব্লিউ মোরলী) এর পরীক্ষায় দেখা গেল ইথার বলে আসলে কিছু নেই। (অনেক কবি সাহিত্যিক অবশ্যি এখনো সেই খবরটি পান নি, তারা তাদের লেখালেখিতে এখনও ইথার শব্দটি ব্যবহার করে যাচ্ছেন!) ইথারের মতো এ-রকম গুরুত্বপূর্ণ একটা ধারণা বিজ্ঞানীরা যেরকম একটা পরীক্ষা করে অস্তিত্বহীন করে দিয়েছিলেন ঠিক সেরকম আরও অনেক ধারণাকে পরীক্ষা করে সত্যও প্রমাণ করেছেন। পৃথিবীর নূতন বিজ্ঞান এখন পরীক্ষা-নিরীক্ষার উপরে নির্ভরশীল হয়ে উঠেছে, তাই বিজ্ঞানচর্চার একটা বড় অংশ এখন গবেষণাগারের উপর নির্ভর করে। তাত্ত্বিক এবং ব্যবহারিক বিজ্ঞান এখন একটি আরেকটির হাত ধরে অগ্রসর হচ্ছে, একটি ছাড়া অন্যটি এগিয়ে যাবার কথা আজকাল কেউ কল্পনাও করতে পারে না।
পর্যবেক্ষণ এবং পরীক্ষা-নিরীক্ষা ছাড়াও অবশ্যি বিজ্ঞানীরা সব সময়েই যুক্তিতর্ক ব্যবহার করে প্রকৃতির রহস্যকে বুঝতে চেষ্টা করেন। বড় বড় বিজ্ঞানীদের এক ধরনের ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় থাকে, সেই ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় দিয়ে তারা অনেক কিছু ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেন যা হয়তো সাধারণ মানুষ কল্পনাও করতে পারেন না। মাইকেলসন এবং মোরলী একটি চুলচেড়া পরীক্ষা করে ইথার নামক বস্তুটিকে অস্তিত্বহীন করে দিয়েছিলেন, বিজ্ঞানী আইনস্টাইন সেই একই কাজ করেছিলেন সম্পূর্ণ অন্যভাবে। ইলেকট্রো ম্যাগনেটিজমের কিছু সূত্রকে সমন্বিত করার জন্যে তিনি তার জগদ্বিখ্যাত আপেক্ষিক সূত্র বের করেছিলেন, পুরাপুরি চিন্তা-ভাবনা এবং যুক্তিতর্ক দিয়ে। তার আপেক্ষিক সূত্র সরাসরি ইথারকে বাতিল করে দিয়েছিল এবং মাইকেলসন মোরলীর পরীক্ষাটি ছিল তার প্রমাণ।
কাজেই বলা যেতে পারে আমাদের আধুনিক বিজ্ঞানচর্চা এখন পর্যবেক্ষণ, পরীক্ষা-নিরীক্ষা বা যুক্তিতর্ক এই তিনটি বিষয়ের উপর নির্ভর করে গড়ে উঠেছে। বিজ্ঞান ব্যাপারটি আমরা সবাই সরাসরি দেখতে পাই না কিন্তু বিজ্ঞানের ব্যবহার বা প্রযুক্তি (টেকনোলজি)-কে কিন্তু বেশ সহজেই দেখতে পাই। এটি এখন আর অস্বীকার করার উপায় নেই প্রযুক্তির মোহ আমাদের অনেক সময় অন্ধ করে ফেলছে, আমরা অনেক সময় কোনটা বিজ্ঞান আর কোনটা প্রযুক্তি সেটা আলাদা করতে পারছি না। বিজ্ঞানের কৃতিত্বটা প্রযুক্তিকে দিচ্ছি, কিংবা প্রযুক্তির অপকীৰ্ত্তির দায়ভার বহন করতে হচ্ছে বিজ্ঞানকে।
ভোগবাদী পৃথিবীতে এখন খুব গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তিকে আলাদা করে দেখা–তা না হলে আমরা কিন্তু খুব বড় বিপদে পড়ে যেতে পারি।
—–
১. ভারী বস্তু এবং হালকা বস্তু যে একই সাথে নিচে পড়বে সেটা কোনো পরীক্ষা না করে শুধুমাত্র যুক্তিতর্ক দিয়েই বের করা সম্ভব। ধরা যাক ভারী বস্তু তাড়াতাড়ি এবং হালকা বস্তু ধীরে ধীরে নিচে পড়ে। এখন একটি ভারী বস্তুর সাথে হালকা বস্তু বেঁধে দিলে হালকা বস্তুটি ভারী বস্তুটিকে তাড়াতাড়ি পড়তে বাধা দিবে, কাজেই দুটি মিলে একটু আস্তে পড়বে। কিন্তু আমরা অন্যভাবেও দেখতে পারি ভারী এবং হালকা মিলে যে বস্তুটা হয়েছে সেটা আরো বেশি ভারী কাজেই আরো তাড়াতাড়ি পড়া উচিৎ। একভাবে দেখা যাচ্ছে আস্তে পড়বে অন্যভাবে দেখা যাচ্ছে দ্রুত পড়বে। এই বিভ্রান্তি মেটানো সম্ভব যদি আমরা ধরে নিই দুটো একই গতিতে নিচে পড়বে।
২. আইনস্টাইনের বিখ্যাত সূত্র E = mc^2
.
2. বিজ্ঞান বনাম প্রযুক্তি
মা এবং সন্তানের মাঝে তুলনা করতে গিয়ে একটা খুব সুন্দর কথা বলা হয়, কথাটা হচ্ছে। “কুপুত্র যদিবা হয়, কুমাতা কখনো নয়।” সন্তানের জন্যে মায়ের ভালোবাসা দিয়েই একটা জীবন শুরু হয় তাই মায়ের উপর এত বড় একটা বিশ্বাস থাকবে বিচিত্র কী? কুপুত্র এবং কুমাতা নিয়ে এই কথাটা একটু পরিবর্তন করে আমরা বিজ্ঞান আর প্রযুক্তির জন্যে ব্যবহার করতে পারি, কথাটি হবে এরকম, “কু-প্রযুক্তি যদি বা হয়, কু-বিজ্ঞান কখনো নয়।” যার অর্থ বিজ্ঞানটা হচ্ছে জ্ঞান আর প্রযুক্তিটা হচ্ছে তার ব্যবহার, জ্ঞানটা কখনোই খারাপ হতে পারে না, কিন্তু প্রযুক্তিটা খুব সহজেই ভয়ংকর হতে পারে। আইনস্টাইন যখন তার আপেক্ষিক তত্ত্ব নিয়ে চিন্তাভাবনা করতে করতে লিখলেন E = mc^2 তখন তার বুক একবারও আতঙ্কে কেঁপে উঠে নি। কিন্তু দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের শেষের দিকে যখন হিরোশিমা আর নাগাসাকি শহরে নিউক্লিয়ার বোমা এক মুহূর্তে কয়েক লক্ষ মানুষকে মেরে ফেলল তখন সারা পৃথিবীর মানুষের বুক আতঙ্কে কেঁপে উঠেছিল। এখানে E = mc^2 হচ্ছে বিজ্ঞান আর নিউক্লিয়ার বোমাটা হচ্ছে প্রযুক্তি–দুটোর মাঝে যোজন যোজন দূরত্ব।