বিজ্ঞানীরা এটা নিয়ে অনেকদিন থেকেই চেঁচামেচি করছেন, আমরা আশা করছি পৃথিবীর অবিবেচক মানুষ একদিন বিজ্ঞানীদের চেঁচামেচি শুনে পৃথিবীটাকে রক্ষা করার জন্যে এগিয়ে আসরেন!
০৫. প্রাণীজগৎ
9. জীবনের নীল নকশা
বিজ্ঞানী রাদারফোর্ড বলেছিলেন, তুমি যদি বিজ্ঞানের কোনো তত্ত্ব তোমার কজের বুয়াকে বোঝাতে না পার তাহলে বুঝতে হবে ব্যাপারটি তুমি নিজেই বোঝ নি! কাজের বুয়া কিংবা মহিলাদের বুদ্ধিমত্তাকে উপহাস করার জন্যে কথাটি বলা হয় নি, বিজ্ঞানের কোনো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ছাড়াও যে বিজ্ঞানের মূল বিষয়গুলো বোঝা সম্ভব সেই বিষয়টাকে এখানে জোর দিয়ে বলা হয়েছে। বিজ্ঞানের মূল বিষয়গুলো সব সময়েই আশ্চর্য রকম সহজ এবং সরল–এটি কোন দুর্ঘটনার নয়। প্রকৃতি জটিলতা পছন্দ করে না, সে সবচেয়ে সহজ এবং সুন্দর উপায়ে সবকিছু গড়ে তুলেছে। বিজ্ঞানীরা সেটা খুঁজে বের করছেন এবং তাদের মাথার ভেতর সব সময়েই এটা কাজ করে যে, বিজ্ঞানের যে অজানা জটিল বিষয়টি নিয়ে এখন তারা হাবুডুবু খাচ্ছেন, যখন তার সমাধানটি তারা পাবেন সেটি হবে আশ্চর্য রকম সহজ এবং সরল। প্রাচীনকালে মানুষ ধরে নিয়েছিল চাঁদ সূর্য গ্রহ নক্ষত্র সবকিছু পৃথিবীকে ঘিরে ঘুরে (ধর্মগ্রন্থে সেটা লেখা আছে, কার ঘাড়ে দুটি মাথা সেটি অস্বীকার করবে?) সে সময়কার বিজ্ঞানীরা যখন চাঁদ সূর্য গ্রহ নক্ষত্র পর্যবেক্ষণ করে সেগুলো ঠিক কিভাবে পৃথিবীকে ঘিরে ঘুরছে বের করার চেষ্টা করছিলেন তখন তাদের মাথা খারাপ হবার অবস্থা। চাঁদ এবং সূর্যের বিষয়টা নিয়ে সমস্যা নেই কিন্তু গ্রহগুলোর গতিপথের কোনো নিয়ম শৃঙ্খলা নেই, কখনো সেটা যাচ্ছে জোরে, কখনো আস্তে। শুধু তাই নয় কখনো-কখনো একদিকে খানিকটা গিয়ে আবার গতিপথ পাল্টে উল্টো দিকে ফিরে আসছে! কারো সাথে কারো মিল নেই, সর মিলিয়ে একটা বিশাল জগাখিচুড়ি। চাঁদ সূর্য এবং গ্রহ নক্ষত্রের এই জটিল গতিবিধি ব্যাখ্যা করা পৃথিবীর সেরা বিজ্ঞানীদের জন্যেও ছিল অসম্ভব একটি ব্যাপার। শেষ পর্যন্ত কোপার্নিকাস যখন বললেন আসলে পৃথিবী নয় সূর্যকে ঘিরে সব গ্রহগুলো ঘুরছে, সাথে সাথে প্রায় চোখের পলকে সব জটিলতা দূর হয়ে গেল। বিজ্ঞানী এবং সাধারণ মানুষ একই সাথে অবাক হ্রয়ে। দেখল সবকিছুর মূলে আছে মহাকর্ষ বল, সেই মহাকর্ষ বলের আকর্ষণে সূর্যকে ঘিরে সবগুলো গ্রহ ঘুরছে! খুব সহজ-সরল একটি বিষয়, কাজের বুয়ারাও সেটা বুঝবেন।
জীবিত প্রাণীর মূল ব্যাপারটিও সেরকম আশ্চর্য রকম সহজ এবং সরল। একটা জীবিত প্রাণী কীভাবে জন্ম হবে এবং বিকশিত হবে তার একটা নীল নকশা থাকে। ক্ষুদ্র একটা জীবাণু থেকে শুরু করে মানুষের মতো জটিল একটা প্রাণীর সবার ভেতরেই সেই নীল নকশাটি একই প্রক্রিয়ায় লুকিয়ে রাখা হয়েছে এই তথ্যটিই কী আমাদের অবাক করে দেয় না? একটা নীল নকশা মানে কিছু তথ্য, কিছু নির্দেশ। সেগুলো আমরা আগে রাখতাম কাগজে লিখে, আজকাল রাখি কম্পিউটারের হার্ড ড্রাইভ কিংবা সিডি রমে। আপাতঃদৃষ্টিতে পুরো বিষয়টাকে অনেক জটিল মনে হলেও তথ্য সংরক্ষণের সময় সেটা রাখার জন্যে আশ্চর্য রকম সরল একটা পদ্ধতি ব্যবহার করা হয় তার নাম বাইনারী পদ্ধতি এবং সেটা করার জন্যে। এবং 0 এই দুটি অংককে ব্যবহার করা হয়। জীবিত প্রাণীরা তাদের নীল নকশার তথ্য সংরক্ষণ করার জন্যে প্রায় এ-রকম একটা পদ্ধতি বেছে নিয়েছে “ডি.এন.এ” এর ডাবল হেলিক্সে সেই তথ্য রাখা হয় মাত্র চার ধরনের বেস পেয়ার দিয়ে, শর্ট কাটে তাদের নাম হচ্ছে A, C, G এবং T। শুধু তাই নয় ডি.এন এতে A এর বিপরীতে থাকে সব সময় T এবং C এর বিপরীতে থাকে G। যারা পৃথিবীর একটু খোঁজখবর রাখে তারা নিশ্চয়ই জানে বর্তমান জগতে বিজ্ঞানের সবচেয়ে বড় প্রজেক্ট হচ্ছে মানব জিনোম প্রজেক্ট, কেউ যদি আক্ষরিক অর্থে সেটি দেখতে চায় তাহলে সে দেখবে ATCGCCTGATTCCGT এ-রকম মাইলের পর মাইল চার অক্ষরের সাড়ি। এটি হচ্ছে মানব দেহের নীল নকশা, এর মাঝে লুকিয়ে আছে মানব দেহের সকল রহস্য!
মানুষ কিংবা অন্য যে কোনো জীবিত প্রাণীর জন্যেই এই নীল নকশাটি খুব গুরুত্বপূর্ণ। সেগুলো খুব যত্ন করে সংরক্ষণ করা দরকার। তাই জীবিত প্রাণী এগুলো সংরক্ষণ করার জন্যে যে পদ্ধতি বেছে নিয়েছে সেটি খুবই চমকপ্রদ। শরীরের বিশেষ কোনো এক জায়গায় বিশেষ যত্ন করে না রেখে সেটাকে শরীরের লক্ষ লক্ষ কোষের প্রত্যেকটা কোষের নিউক্লিয়াসের ভেতর রেখে দেয়া হয়েছে। শরীরের যে কোষের জন্যে যে নির্দেশটি প্রয়োজন সে তার প্রয়োজনমত হাতের কাছে নীল-নকশা থেকে সেটি পেয়ে যাচ্ছে।
একটি জীবিত কোষের নিউক্লিয়াসের যেখানে এই নীলনকশাকে রাখা হয় তার বৈজ্ঞানিক নাম হচ্ছে ক্রোমোজম। ফুট ফ্লাই নামক পতঙ্গের ক্রোমোজম হচ্ছে 4 টি, বিড়ালের 34 টি এবং মানুষের 46 টি । কেউ যেন মনে না করে যে প্রাণী যত উন্নত তার ক্রোমাজমের সংখ্যা তত বেশি, কারণ কুকুরের ক্রোমোজমের সংখ্যা মানুষ থেকে বেশি, 78 টি।
অল্প কয়েকটা প্রাণীর ক্রোমোজমের সংখ্যা বলা হয়েছে বলে কেউ হয়তো আলাদাভাবে লক্ষ করে নি যে প্রতিটি ক্ষেত্রেই সেগুলো জোড় সংখ্যাক। মানুষের বেলাতেও তাই, মোট ক্রোমোজমের সংখ্যা 46 হলেও সেটি আসলে 23 জোড়া ক্রোমোজম এবং প্রকৃতির সহজ-সরল নিয়মে সন্তানের 23 জোড়া ক্রোমোজমে 23 টি আসে বাবার কাছ থেকে বাকি 23 টি আসে মায়ের কাছ থেকে। 9.3 নং ছবিতে মানুষের 23 জোড়া ক্রোমোজমকে দেখানো হয়েছে, কেউ যদি একটু মনোযোগ দিয়ে ছবিটা লক্ষ করে তাহলে তার কাছে ছবিটার কয়েকটা বৈশিষ্ট্য নজরে পড়বে। প্রথমত, দেখা যাচ্ছে ক্রোমোজমগুলোকে সাজানোর সময় বড় থেকে ছোট ক্রোমোজমে সাজানো হয়েছে। এটি নেহায়েতই তালিকাভুক্তি করার ব্যাপার এর মাঝে কোন বিজ্ঞান নেই। একটা কোষের নিউক্লিয়াসের ভেতরে যখন ক্রোমাজেমগুলো থাকে তখন কিন্তু সেগুলো এ-রকম সাজানো গোছানো থাকে না, ডি.এন.এ. তন্তুগুলো খোলা অবস্থায় পুরো, নিউক্লিয়াসের ভেতরে এলোমেলো অবস্থায় থাকে। শুধুমাত্র কোষ বিভাজনের সময় সাময়িকভাবে এগুলো ছোট এবং মোটা হয়ে আসে, সেগুলো তখন আলাদাভাবে দেখা সম্ভব হয়। ছবির ক্রোমোজমগুলো একটু মনোযোগ দিয়ে দেখলে আমরা যে জিনিসটি দেখব সেটা হচ্ছে 23 জোড়া ক্রোমোজমের সবগুলো এক ধরনের জোড়া, তাদের নামকরণ করা হয়েছে 1, 2, 3। এ-রকম সংখ্যা দিয়ে, শুধুমাত্র শেষ জোড়াটিকে 23 নম্বর না বলে বলা হয়েছে XY। শুধু তাই নয় x এবং Y দেখতে ভিন্ন। বিশাল X ক্রোমোজমের পাশাপাশি Y রীতিমতো ক্ষুদ্র এবং খর্বকায়। আমরা আগেই বলেছি 23 জোড়া ক্রোমোজমের একটি এসেছে বাবার কাছ থেকে অন্যটি মায়ের কাছ থেকে। যার অর্থ XY এই জোড়ার ভেতরে একটি বাবার অন্যটি মায়ের। কাউকে যদি অনুমান করতে বলা হয় কোনটি বাবা থেকে এসেছে আমি নিশ্চিত সে বলবে বৃহদাকৃতি X ক্রোমোজমটি বাবার, আমরা পুরুষশাসিত সমাজে থাকি যা কিছু বড়, যা কিছু ক্ষমতাশালী সেটাকেই পুরুষের সাথে তুলনা করতে ভালোবাসি। প্রকৃতপক্ষে Y ক্রোমোজমটি এসেছে বাবার কাছ থেকে। একজন মানুষের প্রত্যেকটা কোষের প্রত্যেকটা নিউক্লিয়াসে এই তেইশ জোড়া ক্রোমোজম রয়েছে এবং এর মাঝেই লুকিয়ে রাখা হয়েছে সেই মানুষটির দেহ গঠনের নীল নকশা। কারো নীল নকশায় যদি কালো চুলের নির্দেশনা থাকে তাহলে সে হবে কালো চুলের মানুষ, যদি নীল নকশায় নীল চোখের নির্দেশনা থাকে তাহলে সে হবে নীল চোখের মানুষ। যদি গায়ের রং শ্যামলা হওয়ার নির্দেশনা থাকে তাহলে সে জন্ম নেবে কোমল শ্যামলা রং নিয়ে। আবার কোনো দুর্ভাগ্যের কারণে যদি তার নীল নকশায় থাকে হেমোফিলিয়া রোগের নির্দেশনা নিয়ে তাহলে সে অবধারিতভাবে বড় হবে হেমোফিলিয়া রোগ নিয়ে। শুধু যে চুল বা চোখের রঙ বা গায়ের রঙ এবং কখনো-কখনো দুরারোগ্য রোগের নির্দেশনা এই ক্রোমোজমের ভেতর ডি.এন.এ’র সুদীর্ঘ তন্তুতে লুকিয়ে থাকে তা নয় একজন মানুষ পুরুষ হবে না মেয়ে হবে সেটিও থাকে এই ক্রোমোজমগুলোর ভেতরে, আরও স্পষ্ট ভাবে। একজন মানুষ যদি পুরুষ ক্রমোজম XY দুটিই থাকতে পারে। বাবার xটি পেলে হয় তাহলে তার 23তম জোড়ার সন্তান হয় মেয়ে, ৮টি পেলে সন্তান হয় ছেলে। ক্রোমোজমগুলো হয় x এবং Y যেরকম এই ছবিতে দেখানো হয়েছে। ছবিটি যদি পুরুষমানুষের না হয়ে একটি মেয়ের ক্রোমোজম হতো তাহলে 23 তম জোড়ার দুটিই হতো একই ধরনের, সেখানে থাকত XX! খুব সঙ্গত কারণেই এখন কেউ কেউ প্রশ্ন করতে পারে মেয়েরা পচ্ছে দুটি দীর্ঘ X ক্রোমোজম অথচ ছেলেরা পাচ্ছে একটি দীর্ঘ x এবং একটি রীতিমতো বেটেখাটো Y ক্রোমোজম তাহলে কী বলতে হবে ছেলেদের প্রতি প্রকৃতি খানিকটা অবিচার করেছে? কথাটি একেবারে মিথ্যে নয়, আমরা আমাদের চারপাশে অনেক টাকমাথার পুরুষ দেখেছি কিন্তু কখনো কী কোনো টাকমাথার মহিলা দেখেছি? এর কারণটাও লুকিয়ে আছে X এবং Y ক্রোমোজমের ভেতর।