আমাদের বেঁচে থাকার জন্যে অক্সিজেনের প্রয়োজন। প্রতিমুহূর্তে আমরা এবং আমাদের মতো অন্যান্য প্রাণীরা নিশ্বাসের সাথে সাথে অক্সিজেন গ্রহণ করে সেটাকে শরীরে ব্যবহার করে কার্বন ডাই অক্সাইড বের করে দিচ্ছি। শুধু যে আমরা অক্সিজেন ব্যবহার করি তা নয়, গাড়ি কলকারখানা যন্ত্রপাতি সবজায়গাতেই কয়লা, তেল, গ্যাস পুড়িয়ে শক্তি তৈরি করার সময় অক্সিজেন ব্যবহার করা হয় এবং সেখান থেকে কার্বন ডাই অক্সাইড বের হয়ে আসে। তাহলে অত্যান্ত সঙ্গত প্রশ্ন পৃথিবীর অক্সিজেন কি ধীরে ধীরে কমে আসছে? এমন একটা কি সময় আসবে যখন পৃথিবীতে আমাদের নিশ্বাস নেবারও অক্সিজেন থাকবে না?
আমাদের প্রকৃতি আসলে অত্যন্ত কৌশলী, প্রাণিজগৎ যেন অক্সিজেনের অভাবে নিশ্বাস বন্ধ হয়ে মারা না যায় সেটা নিশ্চিত করার জন্যে ক্রমাগত অক্সিজেন তৈরি করার একটা বিশাল প্রাকৃতিক ফ্যাক্টরি তৈরি করে রেখেছে। সেই ফ্যাক্টরির নাম হচ্ছে গাছ। মানুষ বা
অন্যান্য প্রাণী নিজের খাবার নিজে তৈরি করতে পারে না, গাছ পারে। তারা মাটি থেকে পানি, বাতাস থেকে কার্বন ডাই অক্সাইড আর আকাশ থেকে সূর্যের আলো নিয়ে একটা জটিল রাসায়নিক বিক্রিয়া করে নিজের খাবারটা নিজে তৈরি করে নেয়। এই খাবার তৈরি করার প্রক্রিয়ায় খানিকটা বর্জ্য পদার্থ বের হয়ে আসে। সেই মহামূল্যবান বর্জ্য পদার্থটাই হচ্ছে অক্সিজেন । আলোকে নিয়ে সংশ্লেষণ করে খাবার তৈরি করার এই চমকপ্রদ প্রক্রিয়াটির একটা চমকপ্রদ নাম আছে, সেটা হচ্ছে সালোক সংশ্লেষণ। পৃথিবীর লক্ষ লক্ষ গাছ সালোক সংশ্লেষণ করে ক্রমাগত অক্সিজেন তৈরি করে যাচ্ছে বলে আমাদের অক্সিজেনের অভাব হয় না। আমরা যখন আহতুক একটা গাছ কেটে ফেলি আমাদের মনে রাখতে হবে আমরা তখন আমাদের বেঁচে থাকার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উপাদান অক্সিজেনের সরবরাহ হতে (যত কমই হোক) একটু হস্তক্ষেপ করছি। আমাদের বাঁচিয়ে রাখার জন্যে আমরা অন্য যা কিছুর উপর নির্ভর করি না কেন, সবার উপরে কিন্তু গাছ।
অক্সিজেন শুধু যে আমাদের নিশ্বাসে প্রয়োজন হয় তা নয়, তার আরেকটা . গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। যারা একটু হলেও বিজ্ঞান পড়েছে তারা জানে পৃথিবীর সবকিছু তৈরি হয়েছে বিরানব্বইটা মৌলিক পদার্থ দিয়ে। এই বিরানব্বইটা মৌলিক পদার্থের একটা হচ্ছে অক্সিজেন। মৌলিক পদার্থগুলোর পরমাণু একে অন্যের সঙ্গে যুক্ত হয়ে তৈরি করে অনু, আর সেগুলিই হচ্ছে পৃথিবী কিংবা সৃষ্টি জগতের মূল উপদান। পানির অনুতে আছে দুটো হাইড্রোজেন এবং একটা অক্সিজেনের পরমাণু। সেরকম অক্সিজেনের অনুতে আছে দুটো অক্সিজেনের পরমাণু । এটাই অক্সিজেনের মূল রূপ এবং প্রকৃতিতে এভাবেই অক্সিজেন থাকে, একসঙ্গে দুটো অক্সিজেনের পরমাণু।
তবে সূর্যালোকের অতি বেগুনি রশি (বা আলট্রা ভায়োলেট রে) এই অক্সিজেনে একটা বিচিত্র কাণ্ড ঘটাতে পারে, অক্সিজেনের অনুকে ভেঙে দুটো পরমাণুতে আলাদা করে ফেলতে পারে। আলাদা হয়ে যাওয়া পরমাণু কাছাকাছি একটা অক্সিজেন অনুর সাথে যুক্ত হয়ে হঠাৎ একটা নূতন রূপ নিয়ে নেয়। যেটাতে থাকে দুটোর বদলে তিনটি অক্সিজেন পরমাণু। তখন সেটাকে আর অক্সিজেন বলে না সেটাকে বলে ওজোন। এমনিতে ওজোন আমাদের জন্যে খুব ক্ষতিকর, ফুসফুসের বারোটা বাজিয়ে দেয়। কিন্তু বায়ুমণ্ডলের উপরে খুব সূক্ষ্ম ওজোনের একটা আস্তরণ রয়েছে সেটা কিন্তু আমাদেরকে সূর্যালোকের অতিবেগুনী রশ্মি থেকে রক্ষা করে আসছে। তার কারণ ওজোন খুব ভালোভাবে অতিবেগুনী রশ্মি শোষণ করতে পারে। যে অক্সিজেন পৃথিবীর প্রাণিজগৎকে নিশ্বাস নিতে দিয়ে বাঁচিয়ে রাখছে তারই একটা ভিন্ন অনু আবার বায়ুমণ্ডলে থেকে আমাদেরকে অতিবেগুনী রশ্মি থেকে রক্ষা করে আসছে। কোনো একটা গ্যাসের প্রতি যদি আমাদের কৃতজ্ঞ থাকার প্রশ্ন আসে, নিশ্চিতভাবেই সেটা হবে অক্সিজেন!
তবে মানব জাতি খুব দায়িত্বশীল নয়। পৃথিবীতে আরাম আয়েশে থাকার জন্যে তারা যে এয়ারকন্ডিশন, ফ্রিজ বা নানা ধরনের স্প্রে তৈরি করেছে তার ভেতরে ক্লোরোফ্লোরোকার্বন (সি.এফ.সি) নামে এক ধরনের গ্যাস তৈরি করে। সেই গ্যাসটি যখন মুক্ত হয়ে বায়ুমণ্ডলে মিশে যায় তখন একটা ভয়ানক কাণ্ড ঘটে। প্রথমে সূর্যালোক ক্লোরোফ্লোরোকার্বনকে ভেঙে তার ভেতর থেকে ক্লোরিন নামে ভয়ংকর বিক্রিয়াশীল একটা গ্যাসকে আলাদা করে ফেলে। সেই ক্লোরিন তখন ওজোন গ্যাসকে আক্রমণ করে তাকে সাধারণ দুই পরমাণুর অক্সিজেন অনুতে পাল্টে দেয়। নিশ্বাস নেবার জন্যে এই অক্সিজেন কাজে লাগতে পারে কিন্তু সূর্যালোকের অতি বেগুনি রশ্মিকে সেটা আটকাতে পারে না। পৃথিবীর অবিবেচক মানুষের কারণে এই ব্যাপারটা ঘটতে শুরু করেছে এবং বিজ্ঞানীরা আতঙ্ক নিয়ে আবিষ্কার করেছেন পৃথিবীকে রক্ষা করার জন্যে যে সূক্ষ্ম ওজোনের স্তর ছিল সেটা ধীরে ধীরে ক্ষয় হয়ে যাচ্ছে। শুধু যে ক্ষয় হচ্ছে তা নয় জায়গায় জায়গায় বিশাল গর্ত তৈরি হয়েছে। যার ফলে পৃথিবীর মানুষ ভয়ংকর অতি বেগুনি রশ্মিতে আক্রান্ত হতে শুরু করেছে–চামড়ার ক্যান্সার তার প্রথম লক্ষণ। ভবিষ্যতে আরও কী হবে আমরা সেটা এখনো জানি না।