ফাইবার অপটিক্স কমিউনিকেশান্সে ইনফ্রারেড আলোটা দেয়া হয় লেজার দিয়ে। সত্তরের দশকে লেজারের প্রযুক্তিটি ধীরে ধীরে গড়ে উঠেছে। একদিন লেজার অন্যদিকে ফাইবার এই দুটি প্রযুক্তি একই সাথে গড়ে উঠে পৃথিবীকে তথ্য আদান প্রদানের যে দরজাটি খুলে দিয়েছে প্রযুক্তির ইতিহাসে সেটি সব সময় একটি মাইলফলক হয়ে থাকবে। আর সেই ভোলা দরজা দিয়ে সম্ভাবনার যে আলো এসে পরেছে পৃথিবীকে সেটি সারা জীবনের জন্যে পাল্টে দিয়েছে।
০৪. রসায়ন
8. অক্সিজেন : নিত্যকালের সঙ্গী
একটু যদি ঠাণ্ডা মাথায় চিন্তা করা হয় তাহলে দেখা যায় আমরা আসলে অত্যন্ত নাজুক সৃষ্টি। এই সৃষ্টি জগতের সবচেয়ে জটিল বিষয়টি হচ্ছে আমাদের মস্তিষ্ক, সেটাকে করোটির ভেতরে সাবধানে রেখে শরীরের নানা অঙ্গপ্রত্যঙ্গ দিয়ে সাবধানে একটা ‘সিস্টেম’ দাঁড় করানো হয়েছে। সিস্টেমটা চালু রাখার জন্যে আমাদের দিনে কয়েক বার খেতে হয়। না খেয়ে কতদিন থাকা যায়–ইচ্ছেয় হোক অনিচ্ছায় হোক সেই পরীক্ষা অনেকবার হয়ে গেছে।
মেক্সিকোর ভূমিকম্পের পর কয়েক জন নবজাতক শিশুকে ধ্বংসস্তূপের ভেতর থেকে নয়দিন পর উদ্ধার করা হয়েছিল, আমার জানামতে সেটাই হচ্ছে দীর্ঘ সময় কিছু না খেয়ে বেঁচে থাকার সবচেয়ে বড় রেকর্ড। কোনো পানীয় কিংবা কোনো খাবার না খেয়ে মানুষ কয়েক দিন বেঁচে থাকতে পারলেও নিশ্বাস না নিয়ে সে কিন্তু কয়েক মিনিটও বেঁচে থাকতে পারে না। আমাদের মিনিটে বিশ থেকে ত্রিশবারের মতো নিশ্বাস নিতে হয়। নিশ্বাস নেবার অর্থ হচ্ছে বাইরের বাতাসকে বুকের ভেতরে ফুসফুসে টেনে নেয়া। বাতাসে অনেক ধরনের গ্যাস রয়েছে তার মাঝে সবচেয়ে বেশি রয়েছে নাইট্রোজেন, শতকরা 77 ভাগ। অক্সিজেন রয়েছে শতকরা 21 ভাগ, এই দুই মিলেই শতকরা আটানব্বই ভাগ। বাকি দুই ভাগ এসেছে আরও অনেক গ্যাস থেকে, সেগুলো হচ্ছে কার্বন ডাই অক্সাইড, আরগন, হিলিয়াম, নিওন, ক্রিপ্টন, জিনন, নাইট্রাস অক্সাইড, কার্বন মনোঅক্সাইড ইত্যাদি। এ ছাড়া বিভিন্ন ঋতু বা জলবায়ুর উপর নির্ভর করে বাতাসে সব সময় খানিকটা জলীয় বাষ্প থাকে। আরগন হিলিয়াম, আর নিওন হচ্ছে পুরাপুরি নিষ্ক্রীয় গ্যাস আবার কার্বন মনোঅক্সাইড সবচেয়ে বিষাক্ত গ্যাসগুলোর একটি। বাতাসে এদের পরিমাণ খুব কম তাই আমরা বেঁচে থাকি।
নিশ্বাস নেবার সময় সবগুলো গ্যাসই আমাদের বুকের ভেতর টেনে নিই কিন্তু ব্যবহার করি শুধুমাত্র অক্সিজেনকে। এই অক্সিজেনই আমাদেরকে বাঁচিয়ে রাখে। একজন মানুষ যখন খুব অসুস্থ হয়ে পড়ে অনেক সময় তার নিজে থেকে নিশ্বাস নেবার ক্ষমতা থাকে না তখন তাকে আলাদা করে অক্সিজেন দিতে হয়। অনেক সময় সময়ের আগে শিশুদের জন্ম হয়ে যায়, তার শরীর তখন পুরাপুরি গঠিত হয় নি। প্রথম প্রথম ইনকুবেটরে রাখতে হয়। ইনকুবেটরে তাদের নিশ্বাস দেবার জন্যে যে বাতাস দেয়া হয় সেখানে অক্সিজেন থাকে অনেক বেশি শতকরা ত্রিশ থেকে চল্লিশ ভাগ। নিশ্বাস নিতে খুব সমস্যা এ-রকম নবজাতকদের একেবারে পুরাপুরি শতকরা একশভাগ অক্সিজেনের মাঝে রেখে দেওয়ারও নজির আছে, তবে সেটি করতে হয় খুব সাবধানে। কারণ, কম অক্সিজেন যে-রকম বিপজ্জনক, প্রয়োজন থেকে বেশি অক্সিজেনও ঠিক সেরকম বিপজ্জনক। রক্তে বেশি অক্সিজেন চলে গেলে চোখের শিরা-উপশিরা ফেটে গিয়ে নবজাতকদের চোখের দৃষ্টির বড় ক্ষতি হয়ে যেতে পারে।
আমরা নিশ্বাসে নিশ্বাসে অক্সিজেন গ্রহণ করি বলে এই গ্যাসটিকে খুব আপন একটা গ্যাস হিসেবে ধরে নিয়েছি। কিন্তু যদি একটাকে শুধুমাত্র রাসায়নিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখতাম তাহলে অত্যন্ত সভয়ে এই গ্যাসটাকে বিবেচনা করতে হতো। প্রকৃতিতে যত উপাদান আছে তার মাঝে সবচেয়ে বেশি বিক্রিয়া করতে পারে যে কয়টি গ্যাস আছে তার মাঝে অক্সিজেন একটি। কঠিন লোহার মতো ধাতু জং পড়ে শেষ হয়ে যায় সেটাও অক্সিজেনের কারণে। যখনই দেখি আগুন জ্বলছে সেটি আর কিছুই নয় সেটা হচ্ছে অক্সিজেনের বিক্রিয়া। এ-রকম ভয়ংকর বিক্রিয়াশীল একটা গ্যাস আমরা আমাদের শরীরে শক্তি তৈরি করার জন্যে ব্যবহার করি, সেটা প্রকৃতির জন্যে একটা বিশাল কৃতিত্বের ব্যাপার। আমরা যেটাকে বলি “পোড়া” তার বৈজ্ঞানিক নাম হচ্ছে অক্সিডেশান অর্থাৎ, অক্সিজেনের সাথে সংযোগ। পোড়ানো বলতে আমরা যেটা বোঝাই সেটা ঘটে খুব দ্রুত কিন্তু সেটা আস্তে আস্তেও ঘটতে পারে। লোহার জং ধরা হচ্ছে তার উদাহরণ, সেটা অক্সিডেশান কিন্তু সেটা কয়েকমিনিটের মাঝে ঘটে না সেটা ঘটতে সময় নেয়। আপেল কেটে রেখে দিলে তার মাঝে একটা লালচে রং চলে আসে সেটাও অক্সিডেশান। কাগজ পুরানো হলে সেটা বাদামি রং নেয় সেটাও অক্সিডেশান। এই অক্সিজেশানগুলো হয় খুব ধীরে ধীরে। আগুন ধরে কিছু পুড়ে যাবার সময় অক্সিডেশানের কারণে প্রচণ্ড তাপ বের হয় তার কথা আমরা সবাই জানি যখন সেটা ধীরে ধীরে হয় তখনও কিন্তু তাপ বের হয় কিন্তু সেটা খুব কম বলে আমরা ধরতে পারি না।
আমাদের শরীরে শক্তি তৈরি করার জন্যে অক্সিডেশান হয় এবং সেটাও দাউদাউ করে আগুন জ্বলার মতো হয় না সেটা হয় খুব ধীরে ধীরে। আমরা যখন নিশ্বাস নেই তখন ফুসফুসের ভেতর যে বাতাসটুকু ঢুকে তার অক্সিজেনটুকু ফুসফুসের বিশেষ ধরনের টিস্যুর মাধ্যমে রক্তের লোহিত কণিকার উপর চেপে বসে। লোহিত কণিকা সেই অক্সিজেনকে বহন করে নিয়ে যায় শরীরের সর্বত্র। একেবারে আনাচে কানাচে। আমরা যা খাই সেগুলোও শরীরের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে, লোহিত কণিকা দিয়ে বহন করে আনা অক্সিজেন সেই খাবারকে অক্সিডেশান করে। বাইরে জৈব পদার্থ পোড়ালে সব সময়েই কার্বন ডাই অক্সাইড তৈরি হয়, শরীরের ভেতরে সেটা ঘটে। অক্সিডেশান করে শক্তির জন্ম দেবার পর, সেই কার্বন ডাই অক্সাইড়কে আবার লোহিত কণিকা ফুসফুসে ফেরত আনে। আমাদের প্রশ্বাসের সাথে সেই কার্বন ডাই অক্সাইড বের হয়ে আসে। এবং নিশ্বাস আর প্রঃশ্বাসের এই সমন্বয় বজায় না রাখলে আমরা কয়েক মিনিটের মাঝে মারা পড়ব।