কাঁচকে স্বচ্ছ করার পর তার ভেতর দিয়ে আলো পাঠানোর আগে আরো একটা প্রশ্ন এসে যায় সেটা হচ্ছে এই স্বচ্ছ কাচের ভেতর আলো আটকা থাকবে কেন? আলো তো সরল রেখায় যায় কাচের তন্তু একটু বাকা হলেই তো আলো কাচের দেয়ালে এসে আঘাত করে বের হয়ে যাবে। আলোকে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় নিতে হলে তাকে তো কাচের তন্তুর ভেতরে আটকে রাখতে হবে, সেটা করা হবে কেমন করে?
আসলে এই ব্যাপারটি খুব কঠিন নয়, পূর্ণ অভ্যন্তরীণ প্রতিফলন নামে একটা প্রক্রিয়া এই কাজটিকে খুব সহজ করে দিয়েছে। বিষয়টি 7.2 নং ছবিতে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। এক মাধ্যম থেকে অন্য মাধ্যমে যাবার সময় আলো বেঁকে যায়। 7.2 নং ছবির প্রথম অংশে সেটা দেখানো হয়েছে কাচ এবং বাতাসের জন্যে। খানিকটা কাচ ভেদ করে বাতাসে চলে গেছে এবং খানিকটা প্রতিফলিত হয়ে কাচের ভেতরেই ফিরে এসেছে। এখন কোনোভাবে যদি আলোকরশ্মিটা আরো বাঁকা করে পাঠানো যায় তাহলে দেখা যাবে একটা নির্দিষ্ট কোণ থেকে বেশি হলে কোনো আলোই আর কাচ ভেদ করে বাতাসে যেতে পারছে না, পুরোটাই কাচের ভিতরে ফিরে আসছে। ঘন মাধ্যমে থেকে হালকা মাধ্যমে যাবার সময় আলো যখন বের হতে না পেরে পুরোটাই প্রতিফলিত হয়ে ফিরে আসে সেটাকে বলে পূর্ণ অভ্যন্তরীণ প্রতিফলন। অপটিক্যাল ফাইবারে আলো আটকা পড়ে থাকে এই কারণে, অস্বাভাবিক স্বচ্ছ হওয়ার পরেও আলো বের হতে পারে না।
অপটিক্যাল ফাইবারে আলোর পূর্ণ অভ্যন্তরীণ প্রতিফলনকে ব্যবহার করার জন্যে সেটাকে খুব সূক্ষ্মভাবে তৈরি করা হয়। অনেকেই হয়তো জানে না যে অপটিক্যাল ফাইবার আসলে চুল থেকেও সূক্ষ্ম! এছু সূক্ষ্ম কাচ অত্যন্ত ভঙ্গুর বলে তার উপরে প্লাস্টিকের একটা আবরণ থাকে এরং সে কারণে সেটাকে হয়তো সুতোর মতো মোটা দেখায়। তবে সেটাকে ব্যবহার করার জন্যে তার উপরে আরো নানারকম আবরণ দেয়া হয় এবং শেষ পর্যন্ত সেটা টেবিল ল্যাম্পের ইলেকট্রিক তারের মতো আকার নেয়। মাটির নিচে দিয়ে বা সমুদ্রের নিচে দিয়ে যে অপটিক্যাল ফাইবার নেয়া হয় সেগুলো অবশ্যি রীতিমতো রাক্ষুসে ক্যাবল। তার ভিতরে বাইরে নানা ধরনের আবরণ থাকে, পুরো ক্যাবলটাকে শক্ত করার জন্যে ভেতরে শক্ত স্টীলের পাত পর্যন্ত ঢুকিয়ে রাখা হয়।
ফাইবার অপটিক্সে যে কাচের তন্তু ব্যবহার করা হয় তার দুটি অংশ। ভেতরের অংশটি কার বা কেন্দ্র এবং বাইরের অংশটি ক্ল্যাড বা বহিরাচ্ছাদন। আলো যেন পূর্ণ অভ্যন্তরীণ প্রতিফলন হয়ে অপটিক্যাল ফাইবার আটকা থাকতে পারে সে জন্যে সব সময়েই ক্ল্যাড থেকে কোরের প্রতিসারংকে বেশি হয়।
তথ্যবিনিময় করার জন্যে ফাইবার অপটিক্স কমিউনিকেশান্সে দুই রকম ফাইবার ব্যবহার করা হয়। এক ধরনের ফাইবারের কোর হচ্ছে 50 মাইক্রন তার নাম মাল্টিমোড ফাইবার। অন্য আরেক ধরনের ফাইবারের কোর আরো অনেক ছোট, 10 মাইক্রনের কাছাকাছি, তার নাম সিংগল মোড ফাইবার। কোরের বাইরে ক্লাডের আচ্ছাদন দিয়ে দুই ধরনের ফাইবারকেই 125 মাইক্রনের কাছাকাছি নিয়ে আসা হয়েছে। 7.4 নং ছবিতে এই দুই ধরনের ফাইবারকে দেখানো হয়েছে। মাল্টিমোড ফাইবারে আলোকরশ্মি নানাভাবে যেতে। পারে কিন্তু সিংগল মোড ফাইবারে সেটি যেতে পারে মাত্র এক ভাবে, ফাইবারগুলোর নামকরণটি হয়েছেও এই কারণে। যদি দীর্ঘ দূরত্বে যেতে হয় এবং তথ্যবিনিময় করতে হয় অনেক বেশি তাহলে সব সময়েই সিংগল মোড ফাইবার ব্যবহার করতে হয়। বাংলাদেশ রেলওয়ের ফাইবারগুলো সিংগল মোড। সমুদ্রের তলদেশ দিয়ে যে সাবমেরিন ক্যাবল বাংলাদেশে আসছে সেটিও সিংগল মোড। সিংগল মোডের, আনুষাঙ্গিক যন্ত্রপাতি জটিল তার খরচও বেশি। যদি ছোট খাট দূরত্বে যেতে হয় তাহলে মাল্টিমোড ফাইবার ব্যবহার করা যায়। আমাদের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের নেটওয়ার্ক তৈরি করার সময় মাল্টিমোড ফাইবার ব্যবহার করা হয়েছে, ক্যাম্পাস ছোট বলে দূরত্ব বেশি নয়–সেটি একটি কারণ, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় বলে অর্থের টানাটানি –সেটি আরেকটি কারণ।
এতক্ষণ আমরা শুধু কাচের তন্তু বা অপটিক্যাল ফাইবারের কথা বলেছি, এর ভেতর দিয়ে কী ধরনের আলো পাঠানো হয় সেটি নিয়ে কোনো কথা বলি নি। যেহেতু আলোর কথা বলা হচ্ছে একটা খুব স্বাভাবিক প্রশ্ন আলোর রংটা কী? লাল নীল হলুদ নাকি অন্য কিছু? মজার ব্যাপার হচ্ছে এই প্রশ্নের কোনো উত্তর নেই। তার কারণ ফাইবার অপটিক কমিউনিকেশান্সে যে আলো ব্যবহার করা হয় সেটি দৃশ্যমান আলো নয়, আমরা যেটা চোখেই দেখতে পাই না সেটার আবার রং কীভাবে হবে?
ব্যাপারটা আরেকটু পরিষ্কার করে বলা যায়। আলো আসলে বিদ্যুৎ চৌম্বকীয় তরঙ্গ। যে কোন তরঙ্গের একটা তরঙ্গ দৈর্ঘ্য থাকে কাজেই বিদ্যুৎ চৌম্বকীয় তরঙ্গেরও তরঙ্গ দৈর্ঘ্য আছে। এই তরঙ্গ দৈর্ঘ্য নির্দিষ্ট করা নেই, ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র থেকে শুরু করে কয়েকশ কিলোমিটার পর্যন্ত লম্বা হতে পারে। এই বিদ্যুৎ চৌম্বকীয় তরঙ্গের তরঙ্গ-দৈঘ্য যখন 0.4 থেকে 0.7 মাইক্রনের ভেতর হয় শুধু মাত্র তখন আমরা সেটা দেখতে পাই, অন্য কখনো দেখতে পাই না। 7.5 নং ছবিতে বিভিন্ন তরঙ্গ দৈর্ঘ্যের জন্যে বিদ্যুৎ চৌম্বকীয় তরঙ্গকে কী নামে ডাকা হয় সেটা দেখানো হয়েছে। দৃশ্যমান আলোর পাশে যে ইনফ্রারেড আলো রয়েছে সেটি ফাইবার অপটিক কমিউনিকেশান্সে ব্যবহার করা হয়। ইনফ্রারেড আলোর ব্যাপ্তি বেশ বড়, তার পুরোটুকু ব্যবহার করা যায় না, তরঙ্গ দৈর্ঘ্য 1.3 থেকে 1.5 মাইক্রন পর্যন্ত ছোট অংশটাকে ব্যবহার করা হয়।