পৃথিবীর বড় বড় মনীষীরা পৃথিবীর সকল মানুষের সমান অধিকারের জন্যে সংগ্রাম করে গেছেন। আমরা ধারণা তারা যদি এখন পৃথিবীতে ফিরে আসতেন তাহলে ইন্টারনেট দেখে খানিকটা সান্ত্বনা পেতেন। পৃথিবীর অনেক বড় বড় রাজনৈতিক নেতা, অনেক রাষ্ট্রনায়ক, অনেক দার্শনিক যেটি করতে পারেন নি পৃথিবীর বিজ্ঞানী এবং প্রযুক্তিবিদেরা সেটা করে ফেলেছেন। পৃথিবীর সবচেয়ে সম্পদশালী মানুষের কাছে এখন যে তথ্যভাণ্ডার পৃথিবীর সবচেয়ে সাধারণ মানুষের কাছেও এখন সেই তথ্যভাণ্ডার। পৃথিবীর খুব সাধারণ একজন মানুষও এখন তার প্রতিবাদ, তার ক্ষোভ বা আনন্দকে এখন সারা পৃথিবীর মানুষের কাছে তুলে দিতে পারে। পৃথিবীর মানুষের এত ক্ষমতার কথা কি কেউ কখনও চিন্তা করেছিল?
নূতন কিছু নিয়ে উচ্ছ্বাস স্বাভাবিক বিষয়। তথ্য প্রযুক্তি নিয়েও সেটা হয়েছে। ভোগবাদী মানুষ এর সাথে জড়িত। অর্থবিত্তকে নিয়ে প্রয়োজন থেকে বেশি মাথা ঘামিয়েছে। যে বিজ্ঞানী আর প্রযুক্তিবিদেরা এটাকে গড়ে তুলেছে তাদেরকে যথাযথ সম্মান না দিয়ে যারা এটাকে নিয়ে ব্যবসা করেছে সে-রকম মানুষকে নিয়ে বেশি মাথা ঘামিয়েছে। কিন্তু এই সকল উচ্ছ্বাস একসময় কমে আসবে, চোখ ধাঁধানো অর্থবিত্তের কুয়াশা কেটে যাবার পর আমরা তথ্যপ্রযুক্তির সত্যিকার রূপটি দেখতে পাব। সেটা দেখার জন্যেই পৃথিবীর অনেক মানুষ আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করে আছে।
সেটি কী কেউ জানে না। আমার ধারণা সেই ভূমিকাটি হবে পৃথিবীর জ্ঞানভাণ্ডারে তার অবদানটুকু পৃথিবীর ইতিহাস সেটি আগে কখনো ঘটে নি। অজানাকে জানার জন্যে মানুষের হাতে এখন যে বিশাল অস্ত্র আছে তার কথা কী কেউ কখনও কল্পনা করতে পারেছিল?
.
7. ফাইবার অপটিক্স
“ফাইবার অপটিক্স” বিষয়টি কী ভালোভাবে না জানলেও আমাদের দেশের মানুষ “ফাইবার অপটিক্স” কথাটির সাথে খুব ভালোভাবে পরিচিত। পৃথিবীর প্রায় সব দেশই ফাইবার অপটিক ক্যাবল দিয়ে আন্তর্জাতিক তথ্যপ্রবাহের মূলধারার সাথে বহুদিন আগে যোগাযোগ করে ফেলেছে, সাবমেরিন ক্যাবল ব্যবহার করে সেই যোগাযোগটি করতে আমদের বহুকাল লেগে গেছে। যখন বিষয়টি খুব সহজ ছিল তখন সরকারি নির্বুদ্ধিতার কারণে সেটা নেয়া হয় নি। গত এক দশক থেকে দেশের মানুষের চাপে সরকার “নিচ্ছি” “নেবো” করছে, শুনে শুনে আমরা কখনো ক্লান্ত, কখনো হতাশ হয়ে গিয়েছিলাম। শেষ পর্যন্ত সেই যোগাযোগটি হয়েছে এখনো সেটি বিশ্বাস হতে চায় না। আমাদের দেশের ইন্টারনেট যোগাযোগ হতো ভিস্যাট দিয়ে। সারা দেশে হয়তো শ খানেক ভিস্যাট ছিল অথচ এখন একটি অপটিক্যাল ফাইবার দিয়েই লাখ খানেক ভিস্যাটের সমান তথ্যবিনিময় করা যেতে পারে, তাই আমরা সবাই যে ফাইবার অপটিক্স নিয়ে একটু অস্থির হয়েছিলাম তাতে অবাক হবার কী আছে?
ফাইবার শব্দটির অর্থ তন্ত্র এবং অপটিক্স হচ্ছে আলোসংক্রান্ত বিজ্ঞান, কাজেই ফাইবার অপটিক্স কথাটি দিয়ে কোনো সূক্ষ্ম তন্তু দিয়ে আলো আনা নেয়ার বিজ্ঞানকে বোঝানোর কথা। তবে সাধারণ অর্থে আমরা ফাইবার অপটিক্স বলতে কাচের সূক্ষ্ম তন্তু দিয়ে তথ্য পাঠানোর প্রযুক্তিটিকে বুঝিয়ে থাকি। তথ্য আদান প্রদানের অন্যান্য পদ্ধতি থেকে এটা ভিন্ন কারণ এখানে সেই কাজটি করার জন্যে আলো ব্যবহার করা হয়।
আলো ব্যবহার করে তথ্য পাঠানো খুব অস্বাভাবিক কিছু নয়। মাত্র কিছুদিন আগে এক রাতের ট্রেনে আমি একজন স্মাগলারকে দেখেছি, সে তার হাতের টর্চ লাইট জ্বালিয়ে এবং নিভিয়ে তার সাঙ্গোপাঙ্গোদের একটা সংবাদ দিল! ফাইবার অপটিক্স ব্যবহার করে তথ্য পাঠানোর মূল বিষয়টা অনেকটা সেরকম–আলো জ্বালিয়ে এবং নিভিয়ে তথ্য পাঠানো। তবে সেটা করা হয় অবিশ্বাস্য দ্রুতগতিতে। স্মাগলার যেখানে তার আলোটা সেকেন্ডে একবার জ্বালাতে বা নেভাতে পারে ফাইবার অপটিক্সের লেজার রশ্মি সেটা করে সেকেন্ডে হাজার কোটি বার থেকে বেশি (দশ বিলিওন)! স্মাগলারের টর্চ লাইটের আলো যায় সোজা, সামনে দেয়াল থাকলে সেই আলো আটকে যায়, দেয়াল ভেদ করে যেতে পারে না। ফাইবার অপটিক্সে সেটা যায় সূক্ষ্ম কাচের তন্তু দিয়ে, সেই কাচের তন্তু দেয়ালে ঘরবাড়ি এমনকি সমুদ্র মহাসমুদ্র পর্যন্ত পাড়ি দিতে পারে।
তথ্য পাঠানোর এই প্রক্রিয়ায় যে সূক্ষ্ম কাচের তন্তু ব্যবহার করা হয় তাকে বলে অপটিক্যাল ফাইবার। যে বিজ্ঞানী প্রথম অনুমান করেছিলেন তথ্য পাঠানোর জন্যে কাচের তন্তু বা অপটিক্যাল ফাইবার ব্যবহার করা যেতে পারে নিঃসন্দেহ তিনি ছিলেন একজন সত্যিকারের ভবিষ্যৎ দ্রষ্টা। জানালার বা ছবির ফ্রেমে কাচ দেখে আমরা ধারণা করেছি কাছ একটি স্বচ্ছ জিনিস, সেটি স্বচ্ছ তার কারণ কাঁচটি পাতলা। আমরা যদি কাচের একটা দণ্ড নিই তাহলে আবিষ্কার করব কাচ আসলে তেমন স্বচ্ছ নয়। সাধারণ কাচের ভেতর দিয়ে আলো পাঠালে মাত্র বিশ মিটার যেতে যেতেই তার শতকরা নিরানব্বই ভাগ শোষিত হয়ে যায়। এ-রকম একটা জিনিস দিয়ে একদিন শত শত কিলোমিটার দূরে তথ্য পাঠানো যেতে পারে বিষয়টি আগে থেকে অনুমান করতে পারেন শুধু সত্যিকারের একজন ভবিষ্যৎ দ্রষ্টা।
তথ্য পাঠানোর জন্যে কাচের স্বচ্ছতা বাড়ানোর কাজে বিজ্ঞানী আর প্রযুক্তিবিদরা কাজ শুরু করে একটা অভাবনীয় কাজ করে ফেললেন। তারা কাঁচকে এমনই স্বচ্ছ করে ফেললেন যে আলোর শতকরা নিরানব্বই ভাগ শোষিত হওয়ার জন্যে বিশ মিটার নয় এখন যেতে হয় দুইশ’ কিলোমিটার। মানুষ কোন কিছুকে একগুণ বা দ্বিগুণ উন্নত করতে পারলেই খুশিতে আত্মহারা হয়ে যায়। সেই হিসেবে এই উন্নতি হচ্ছে দশ হাজার গুণ! পৃথিবীর ইতিহাসে এ রকম উদাহরণ খুব বেশি নেই।