কম্পিউটার হচ্ছে একমাত্র টুল যেটা একটা নির্দিষ্ট কাজের জন্যে তৈরি হয় নি। এটা দিয়ে কী কাজ করা যেতে পারে সেটা নির্ভর করে একজনের সৃজনশীতার উপরে। বলা হয়ে থাকে মানবসভ্যতার ইতিহাসে যে ছোট যন্ত্রটি পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি বৈজ্ঞানিক তথ্য সংগ্রহ করেছে সেটি হচ্ছে ভয়েজার 1 এবং 2 মহাকাশযান। পৃথিবী থেকে 1977 সালে শুরু করে সেটি একটি একটি গ্রহের পাশে দিয়ে গিয়েছে এবং সেই গ্রহটির পাশে দিয়ে যাবার সময় তার সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করে পৃথিবীতে পাঠিয়েছে। ভয়েজার 1 এবং 2-এর পুরো নিয়ন্ত্রণে ছিল একটা কম্পিউটার, 1977-এর প্রযুক্তিতে সে-সময় যে কম্পিউটার তৈরি করা হয়েছিল সেটি বর্তমান কম্পিউটারের তুলনায় একটি হাস্যকর খেলনা ছাড়া আর কিছু নয়। কিন্তু সেই হাস্যকর খেলনা জাতীয় কম্পিউটারটি ভয়েজার 1 এবং 2 কে নিখুঁতভাবে গ্রহমণ্ডলীর ভেতর দিয়ে নিয়ে সৌরজগতের বাইরে পাঠিয়ে দিয়েছিল। এই উদাহরণটি হচ্ছে সম্ভবতঃ কম্পিউটারের ব্যবহারের একটি সুন্দর উদাহরণ।
খারাপ উদাহরণও আছে, কম্পিউটার ব্যবহার করে পৃথিবীতে আজকাল বড় বড় অপরাধ করা শুরু হয়েছে। ইলেকট্রনিক অর্থ বিনিময় শুরু হবার সাথে সাথে নিরাপত্তার জন্যে বিশেষ সংখ্যা নির্ধারণ করে দেয়ার প্রচলন হয়েছে। সংখ্যাটি যত বড় তার নিরাপত্তা তত বেশি। তবে দৈনন্দিন কাজে ব্যবহার করার জন্যে বিশাল সংখ্যা এক ধরনের যন্ত্রণার মতো তাই সেই (PIN) নম্বরগুলো খুব বড় নয়। সাধারণভাবে সেটি অনুমান করা সহজ নয়, তাই অপরাধীরা কম্পিউটারকে বসিয়ে দেয় সেই নম্বরগুলোকে খুঁজে বের করতে। একজন মানুষের পক্ষে যেটা অসম্ভব একটা কম্পিউটারের জন্যে সেটা ছেলে-খেলা। তাই প্রতিদিন অসংখ্য মানুষের সেই গোপন নম্বর বের করে কোটি কোটি ডলার চুরি করা হচ্ছে। এটি হচ্ছে কম্পিউটার ব্যবহার করে অপকর্ম করার একটি উদাহরণ!
কম্পিউটার ব্যবহারের প্রকৃত উদাহরণ হচ্ছে এই দুটি উদাহরণের ভেতরে বাইরে আরো অসংখ্য উদাহরণ। এর শেষ কোথায় হবে সেটি অনুমান করা কঠিন, অনুমান করা যায় মানুষের সৃজনশীলতাই শুধু মাত্র এর শেষ খুঁজে বের করতে পারবে। তাই একটি সহায়ক যন্ত্র বা টুল হয়েও কম্পিউটার বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে বিভাগ ভোলা হয়, অসংখ্য ছাত্র-ছাত্রী সেটি নিয়ে পড়াশোনা করে। বিজ্ঞানী আর গবেষকরা তার উন্নতির জন্যে শ্রম দেন, ব্যবসায়ীরা সেটা ব্যবহার করে ব্যবসা করেন এবং সারা পৃথিবীর মানুষ সভ্যতাকে একটা নূতন পর্যায়ে হাজির হতে দেখেন।
কোনো রকম খুঁটিনাটিতে না গিয়ে আমরা যদি কম্পিউটারকে ব্যাখ্যা করতে চাই তাহলে বলা যায় এর দুটি অংশ: একটি হচ্ছে প্রসেসর অন্যটি মেমোরি। প্রসেসরে হিসেব-নিকেশ করা হয়, মেমোরিতে তথ্যগুলোকে সাময়িকভাবে রাখা যায়। প্রথম কম্পিউটার তৈরি হবার পর যতদিন যাচ্ছে ততই একদিকে প্রসেসরের উন্নতি হচ্ছে অন্যদিকে একটি প্রসেসরের সাথে অনেক বেশি মেমোরি যুক্ত করা সম্ভব হচ্ছে। ইলেকট্রনিক প্রযুক্তির উন্নতি হওয়ার কারণে সুফলটা সরাসরি ভোগ করছে কম্পিউটার প্রযুক্তি এবং মোটামুটিভাবে বলা যায় প্রতি কয়েক বছরেই কম্পিউটারের ক্ষমতা দ্বিগুণ হয়ে যাচ্ছে। প্রযুক্তির অন্য কোনো ক্ষেত্রে এরকম উন্নতি দেখা গিয়েছে কেউ দাবি করতে পারবে না।
এই বিষয়টি মানুষকে হঠাৎ একটি সম্পূর্ণ ভিন্ন ধরনের ভাবনায় ফেলে দিয়েছে। মানুষের মস্তিষ্ক এবং কম্পিউটারের কর্মপদ্ধতি এক নয়। কম্পিউটার কাজ করে ডিজিটাল সিগনাল দিয়ে, এখানে প্রসেসর আর মেমোরি দুটো সম্পূর্ণ ভিন্ন জিনিস। মানুষের মস্তিষ্কের সংযোগকে বলা হয় নিউরাল সংযোগ, সেখানে প্রসেসর আর মেমোরী একই জায়গায়। তারপরেও বিজ্ঞানীরা হিসেব করে মানব মস্তিষ্ককে কম্পিউটারের সাথে তুলনা করার চেষ্টা করেন এবং আমাদের পরিচিত কম্পিউটারকে মানুষের মস্তিষ্কের সমান ক্ষমতায় পৌঁছুতে কতদিন লাগতে পারে সেটি নিয়ে ভাবনাচিন্তা করতে থাকেন। কম্পিউটারের ক্ষমতা যে হারে বাড়ছে সেটি দেখে অনুমান করা হয় আমরা আমাদের জীবদ্দশাতেই সে ধরনের একটি কম্পিউটার দেখতে পাব। তারপরের প্রশ্নটি গুরুতর, সত্যি সত্যি যদি সেরকম কিছু তৈরি হয়ে যায় তাহলে কী সেখানে মানুষের ভাবনা-চিন্তা বা অস্তিত্বের একটা বীজ বপন করা যাবে? বিজ্ঞানীরা সে ব্যাপারে এখনো দ্বিধাভিভক্ত। কেউ কেউ বলেন যাবে, কেউ কেউ বলেন যাবে না! আমাদের কোনো ভবিষ্যৎ বংশধর হয়তো এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পাবেন।
তবে আমাদের দৈনন্দিন জীবনে কম্পিউটারের ভূমিকা নিয়ে কারো কোনো প্রশ্ন নেই। কম্পিউটার বলতেই আমাদের চোখের সামনে যে মনিটর, কী বোর্ড বা সি.পি.ইউ এর ছবি ভেসে উঠে সেটা তার একমাত্র রূপ নয়। ক্যামেরা বা মোবাইল ফোন থেকে শুরু করে গাড়ি জাহাজ বা প্লেন প্রযুক্তির এমন কোনো ক্ষেত্র নেই যেখানে এটি জায়গা করে নেয় নি। যে বিষয়টি একসময় প্রায় অসম্ভব একটি বিষয় ছিল এখন সেটি সহজ একটি ব্যাপার। পৃথিবীর সকল কম্পিউটারকে যুক্ত করে কম্পিউটারের একটা বিশাল নেটওয়ার্ক তৈরি করা হয়েছে। এই নেটওয়ার্ককে ব্যবহার করে অনেক কিছু করা সম্ভব তার সব আমরা এখনো দেখি নি। যেটি দেখে আমরা সবাই অভ্যস্ত সেটাকে ইন্টারনেট বলি। আমার ব্যক্তিগত ধারণা নূতন পৃথিবীর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রযুক্তি হিসেবে কয়েকটি বিষয়কে বলতে হলে ইন্টারনেট হবে তার একটি। ইন্টারনেট তার প্রাথমিক নতুনত্বের উত্তেজনার ভেতর দিয়ে যাচ্ছে, আগামী দশকের ভেতর তার নতুনত্বটুকু ফুরিয়ে যাবার পর আমরা যে তার স্থায়ী ভূমিকাটি দেখতে পাব সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। মানবসভ্যতায় সেটি কী অবদান রাখবে সেটি দেখার জন্য পৃথিবীর মানুষ কৌতূহল নিয়ে অপেক্ষা করছে।