“আমি ফ্লোরেন্সবাসী স্বাৰ্গীয় ভিন্সেজিও গ্যালিলিওর পুত্র সত্তর বৎসর বয়স্ক গ্যালিলিও গ্যালিলি, সশরীরে বিচারের জন্যে এসেছি এবং বিখ্যাত ও সম্মানিত ধর্মযাজক এবং ধর্মবিরুদ্ধ আচরণের অপরাধে অপরাধী। হয়ে বিচারকদের সামনে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে নিজ হাতে ধর্মগ্রন্থ স্পর্শ। করে শপথ করেছি যে, রোমের পবিত্র ক্যাথলিক খ্রিস্টধর্ম সংস্থার দ্বারা যা কিছু শিক্ষাদান এবং প্রচার করা হয়েছে আমি তা বিশ্বাস করি, আগেও করেছি, ভবিষ্যতেও করব।
আমাকে বলা হয়েছিল সূর্য সৌরজগতের কেন্দ্রস্থল এই মতবাদটি মিথ্যা এবং ধর্মগ্রন্থ বিরোধী, আমাকে এই মতবাদ সমর্থন এবং প্রচার থেকে বিরত থাকার কথা বলা হয়েছিল।
তারপরেও আমি এই মতবাদকে সমর্থন করে একটি বই লিখেছিলাম এবং সঙ্গত কারণেই সাধারণের মনে সন্দেহ হতে পারে আমি খ্রিস্টধর্ম বিরোধী। সকলের মন থেকে সন্দেহ দূর করার জন্যে আমি শপথ করে বলছি যে এই ভুল, মিথ্যা এবং ধর্মবিরুদ্ধ মত ঘৃণাভরে পরিত্যাগ করছি। আমি আরও শপথ করে বলছি যে, এ ধরনের বিষয় সম্বন্ধে ভবিষ্যতে কিছু বলব না। শপথ নিয়ে আরও প্রতিজ্ঞা করছি আমাকে প্রায়শ্চিত্যের জন্যে যে নির্দেশ দেয়া হবে আমি সেটা হুবহু পালন করব। আমি যদি এই শপথ আর প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ করি তাহলে আমার জন্যে যে সব নির্যাতন এবং শাস্তির ব্যবস্থা আছে আমি তা মাথা পেতে গ্রহণ করব।”
পৃথিবীর ইতিহাসে একজন বিজ্ঞানী এবং তার বিজ্ঞানচর্চার উপর ধর্মীয় মৌলবাদের এর চাইতে বড় নির্যাতনের আর কোনো উদাহরণ আছে বলে জানা নেই। ক্যাথলিক চার্চ গ্যালিলিওকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিয়েছিল। তবে তার বয়স, স্বাস্থ্য এসবের কথা বিবেচনা করে আমৃত্যু নিজের ঘরে আটকে রাখা হয়। তার বইটিও নিষিদ্ধ ঘোষণার করা হয় এবং 1835 সালের আগে সেই বইটি আর নূতন করে ছাপা হয় নি। শুধু তাই নয় গ্যালিলিওর মৃত্যুর পর তাকে মর্যাদার সাথে সমাহিত না করে খুব সাদাসিধেভাবে কবর দেয়া হয়।
মহামতি গ্যালিলিও গ্যালিলির প্রতি যে অবিচার করা হয়েছিল সেটি বুঝতে ক্যাথলিক চার্চের সময় লেগেছিল মাত্র সাড়ে তিনশত বৎসর। পৃথিবীর কত বড় বড় মনীষীর হাঁটুর সমান মেধা নিয়ে শুধুমাত্র ধর্মের লেবাস পরে তাদের উপর নিপীড়ন করার উদাহরণ শুধু যে ক্যাথলিক চার্চে ছিল তা নয় অন্য ধর্মেও ছিল। শুধু যে অতীতে ছিল তাই নয় এখনও আছে।
০৩. প্রযুক্তি
6. তথ্যপ্রযুক্তি
ছয় সাত বছর আগের কথা। আমি যুক্তরাষ্ট্রের বেল কমিউনিকেশান্স রিসার্চে একটা সার্কিট ডিজাইন করছি। সেখানে একটা আই.সি. ব্যবহার করব তাই আই.সি.-টার কোন পিন কোন কাজ করে জানা দরকার হয়ে পড়ল। আই.সি.র সেই তথ্যগুলো যে মোটা বইটাতে আছে সেটা আমার ঘরে শেলফের উপরের ব্যাকে। আমি দাঁড়িয়ে বইটি শেফ থেকে নামিয়ে সেটা খুলে আই.সি.টার তথ্যগুলো পেয়ে যেতে পারি কিন্তু আমি সেটি না করে অনেকটা অন্যমনস্কভাবে আমার সামনে রাখা কম্পিউটারে কিছু অক্ষর টাইপ করলাম। ইন্টারনেট ব্যবহার করে আই.সি.টার পিন আউট সংক্রান্ত তথ্য সরাসরি ডাইনলোড করে নিলাম। সার্কিট ডিজাইনে সেই তথ্যগুলো ব্যবহার করার সময় আমি হঠাৎ একটু চমকে উঠে নিজেকে জিজ্ঞেস করলাম, আমি কী করেছি? যে তথ্যটি আমার নাগালের ভেতরে, উঠে দাঁড়ালেই নেয়া যায় সেই তথ্যটি সেখান থেকে না নিয়ে আমি নিয়েছি হাজার হাজার মাইল দূরের কোনো এক সার্ভার থেকে? হাতের কাছে রাখা একটি বই থেকে তথ্য নেয়া আর কয়েক হাজার মাইল দূরের কোনো এক কোম্পানির সার্ভারের তথ্যভাণ্ডার থেকে তথ্য নেয়া এখন একই ব্যাপার?
বলা যেতে পারে, এই ঘোট ঘটনাটির পর আমি নিজে ব্যক্তিগতভাবে অনুভব করেছিলাম যে–আমরা, পৃথিবীর মানুষেরা সভ্যতার একটি নূতন ধাপে এসে দাঁড়িয়েছি। তথ্যপ্রযুক্তি নামে যে কথাটি শুনতে শুনতে আমাদের সবার কানের পোকা নড়ে যাবার অবস্থা সত্যিই সেটি এসেছে এবং বলা যেতে পারে বিষয়টি পৃথিবীর সকল মানুষকে কোনো-না কোনোভাবে স্পর্শ করছে।
তথ্যপ্রযুক্তি নামে পৃথিবীব্যাপী একটি নূতন ধরনের “বিপ্লব” এর পিছনে রয়েছে একটি যন্ত্র এবং এই যন্ত্রটির নাম কম্পিউটার। শুধু কম্পিউটারের কারণে এই বিপ্লবটি হয় নি, তার সাথে আরো যন্ত্রপাতি এবং প্রযুক্তির প্রয়োজন হয়েছে, তবে কম্পিউটার বিষয়টি না থাকলে এটি ঘটতো না। কম্পিউটার নামটি এক সময় সম্ভবত যথাযথ ছিল কারণ এটি প্রথমে দাঁড়া করানো হয়েছিল হিসেব করার (comput) জন্যে। এখন এই যন্ত্রের এই নামটি আর যথাযথ নয় ।
কম্পিউটারের খুঁটিনাটির ভেতরে না গিয়ে বলা যায় এটি হচ্ছে একটা সহায়ক যন্ত্র (tool) বা টুল। ক্রু ড্রাইভার একটা টুল যেটা দিয়ে কোনো জায়গায় স্কু লাগানো যায় বা ঔ তুলে ফেলা যায়। ক্রু ড্রাইভার ছাড়া স্কু লাগানো বা তোলা খুব কঠিন, ঠিক উল্টোভাবে বলা যায় স্কু তোলা বা লাগানো ছাড়া ক্রু ড্রাইভার দিয়ে অন্য কোনো কাজ করা যায় না। এটা হচ্ছে টুলের বৈশিষ্ট্য, বিশেষ একটা কাজ করার জন্যে সেটা তৈরি হয় এবং সেই কাজ ছাড়া অন্য কোনো কাজ সেটা করতে পারে না। সেই হিসেবে ঝাঁটা একটা টুল, চামচ একটা টুল। ঝাঁটার কাজ চামচ দিয়ে করা যাবে না, সে-রকম চামচের কাজও ঝাঁটা দিয়ে করা যাবে না।