সবচেয়ে মজার ব্যাপার হচ্ছে বইটি প্রকাশিত হলে দেখা যায় যে, বইটির প্রকাশক কোপার্নিকাসের অনুমতি নিয়েই বইয়ের ভূমিকায় লিখে দিয়েছেন যে এই বইয়ে যে বিষয়টির কথা উল্লেখ করা হয়েছে সেটি সত্যি নয়। গণনার সুবিধার জন্যে এটি একটি বিকল্প পদ্ধতি, এর সাথে সত্যের কোনো সম্পর্ক নেই! ধর্মযাজক এবং চার্চকে ভয় পেয়েই এই কাজটি করা হয়েছিল সেটি বলাই বাহুল্য। কোপার্নিকাসের এই জগদ্বিখ্যাত আবিষ্কারটি কিন্তু সবার চোখের অগোচরেই রয়ে গিয়েছিল দুটি কারণে প্রথমত, বিষয়বস্তুটি এত অবিশ্বাস্য যে, সেটা কেউই বিশ্বাস করতে প্রস্তুত ছিল না। দ্বিতীয়ত, কোপার্নিকাস বইটি লিখেছিলেন ল্যাটিন ভাষায় এবং ল্যাটিন তখন জানত খুব অল্পসংখ্যক মানুষ। গ্যলিলিওর কারণে কোপার্নিকাসের মৃত্যুর 73 বছর পরে তার বইটির দিকে প্রথমে সবার নজর পড়ে এবং ক্যাথলিক চার্চ সাথে সাথে 1616 সালে বইটাকে নিষিদ্ধ করে দেয়। এই যুগে আমরা রাজনৈতিক কারণে বা অশ্লীলতার কারণে বইকে নিষিদ্ধ হতে দেখেছি কিন্তু প্রচলিত বিশ্বাসকে আঘাত করেছে বলে বই নিষিদ্ধ করার বিষয়টি তখন এমন কিছু বিস্ময়কর ছিল না।
গ্যালিলিওর জন্ম হয় 1558 সালে এবং মৃত্যু হয় 1642 সালে–যে বৎসর নিউটনের জন্ম হয়। আধুনিক বিজ্ঞানকে যারা গড়ে তুলেছিলেন তাদের মাঝে গ্যালিলিও ছিলেন অন্যতম। বিজ্ঞানের নানা বিষয়ের সাথে সাথে তার জ্যোতির্বিজ্ঞানেও খুব আগ্রহ ছিল। তখন টেলিস্কোপ আবিষ্কৃত হয়েছে কিন্তু এর গুরুত্বটি কেউ ধরতে পারে নি, দূরের জিনিসকে কাছে দেখার একটা মজার খেলনা ছাড়া এর আর কোনো গুরুত্ব ছিল না। গ্যালিলিও যখন জানতে পারলেন টেলিস্কোপ বলে একটা যন্ত্র তৈরি হয়েছে যেটা দিয়ে দূরের জিনিস কাছে দেখা যায় তখনই তিনি বুঝে গেলেন ওটার সত্যিকার ব্যবহার কী হতে পারে। অনেক খাটাখাটুনি করে তিনি একটা টেলিস্কোপ তৈরি করে আকাশের গ্রহ-নক্ষত্র দেখা শুরু করলেন। তিনি চাঁদের খানাখন্দ দেখলেন, বৃহস্পতির চাঁদ দেখলেন, শুক্রের কলা দেখলেন, এমনকি সূর্যের কলঙ্কও দেখলেন। (গ্যালিলিও তখন জানতেন না সূর্যের দিকে সরাসরি তাকানো যায় না, সূর্যের আলোতে খালি চোখে দেখা যায় না সে রকম অতিবেগুনী রশ্মি থাকে। তাই সূর্য পর্যবেক্ষণের কারণে জীবনের শেষভাবে তিনি অন্ধ হয়ে গিয়েছিলেন।) টেলিস্কোপকে একটা বৈজ্ঞানিক গবেষণার যন্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে তিনি যে সব জিনিস দেখেছেন সেগুলো নিয়ে তিনি 1610 সালে একটা বই লিখলেন। এই বইটিতে আসলে কোপার্নিকাসের মতবাদকে সমর্থন করা হয়েছিল এবং এতদিন যে কোপার্নিকাসের কথা কেউ জানত না, গ্যালিলিওর কারণে সেটি সবাই জানতে পারল। যার পরিণাম হলো ভয়াবহ। কোপার্নিকাসের বইটি নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হলো এবং গ্যালিলিওকে বলা হলো তিনি যেন এইসব মতবাদ প্রকাশ করা থেকে বিরত থাকেন।
সেই যুগে ওরকম একটা বই লেখা ছিল খুব সাহসের কাজ। তিনি যখন তার বইটি প্রকাশ করেছেন তার মাত্র দশ বৎসর আগে জিওদানো ব্রুনো নামে এক জ্যোতির্বিজ্ঞানীকে জীবন্ত পুড়িয়ে মারা হয়। ব্রুনোর অপরাধ তিনি কোপার্নিকাসের মতবাদ বিশ্বাস করতেন। ব্রুনোকে তার বিশ্বাসের জন্যে প্রথমে আট বৎসর জেলে আটকে রাখা হয়েছিল এবং পুড়িয়ে মারার আগের মুহূর্ত পর্যন্ত ব্রুনোকে চাপ দেয়া হয়েছিল তিনি যেন কোপার্নিকাসের মতবাদকে ত্যাগ করে বাইবেলের মতবাদে ফিরে আসেন। ব্রুনো রাজি হন নি। শুধু যে রাজি হন নি তা-ই নয় বিচারকদের দিকে তাকিয়ে শ্লেষভরে বলেছিলেন, “বিচারক মহোদয়রা আমাকে শাস্তি দেয়ায় আমি যেটুকু ভয় পাচ্ছি আপনারা মনে হয় তার থেকে অনেক বেশি ভয় পাচ্ছেন!” (গ্যালেলিওকে ক্ষমা করলেও ব্রুনোকে কিন্তু ক্যাথলিক চার্চ এখনও ক্ষমা করে নি!)
এ-রকম একটা পরিবেশে কোপার্নিসাকের মতবাদ প্রচার করা খুব সাহসের ব্যাপার। তবে চার্চ নিষেধ করে দেয়ার কারণে গ্যালিলিও কয়েক বছর একটু চুপচাপ থাকলেন। তখন তার এক পুরানো বন্ধু পোপ হিসেবে নির্বাচিত হন, গ্যালিলিও ভাবলেন এটাই তার সুযোগ। তিনি তখন আরেকটা বই লিখলেন, বইটি তিনজন মানুষের কথোপকথন হিসেবে লেখা, একজন টলেমির মতবাদ বিশ্বাস করে (পৃথিবী হচ্ছে সৌরজগতের কেন্দ্র), আরেকজন কোপার্নিকাসের মতবাদ বিশ্বাস করে (সূর্য হচ্ছে সৌর জগতের কেন্দ্র) এবং তৃতীয় জন একজন নিরপেক্ষ মানুষ। (আমাদের সৌভাগ্য আজকাল বিজ্ঞানের বই এভাবে আলাপচারিতা হিসেবে লিখতে হয় না। যেটা সত্যি সেটা কাটখোট্টা ভাষায় লিখলেও জার্নালগুলো ছাপিয়ে দেয়।) গ্যালিলিওর এই বইটি লেখা হয় ইতালীয় ভাষায়, বইয়ে কোপার্নিকাসের সমর্থকের তুখোড় যুক্তির কাছে টলেমির সমর্থক বারবার অপদস্ত হয় এবং এই বইটির কারণে গ্যালিলিও ধর্মযাজকদের বিষ নজরে পড়লেন।
1633 সালে ক্যাথলিক চার্চ গ্যালিলিওর বিরুদ্ধে ধর্মোদ্রোহিতার অভিযোগ দিয়ে ডেকে পাঠাল। গ্যালিলিও তখন বৃদ্ধ, প্রায় অন্ধ। এই বৃদ্ধ জ্ঞান তাপসকে তিনদিন একটি টর্চার সেলে অত্যাচার করা হয় এবং শেষ পর্যন্ত হাঁটু ভেঙে জোড় হাতে মাথা নিচু করে তাকে ক্ষমা চাইতে বাধ্য করা হয়। পোপ এবং ধর্মযাজকদের সামনে তিনি যে লিখিত বক্তব্য পড়েন সেটি ছিল এরকম: