তারপর অনেক দিন পার হয়েছে, ক্ষুদ্র যন্ত্রপাতির গুরুত্ব এতদিনে এতটুকু কমে নি বরং বেড়েছে। এখন যেসব ক্ষুদ্র যন্ত্রপাতি তৈরি হচ্ছে সেগুলো আসলে মাইক্রোস্কোপ দিয়েও দেখা যায় না। এই যন্ত্রপাতিগুলো তৈরি করার প্রযুক্তির নাম দেয়া হয়েছে ন্যানো টেকনোলজি, সংক্ষেপে ন্যানোটেক। মজার ব্যাপার হচ্ছে ন্যানোটেকের ইতিহাস ঘেঁটে দেখলে দেখা যায় এটা নিয়ে প্রথম বক্তব্য রেখেছিলেন প্রফেসর রিচার্ড ফাইনম্যান-1959 সালে আমেরিকান ফিজিক্যাল সোসাইটির এক সভায়, বক্তব্যের শিরোনামটি ছিল এরকম : তলানিতে প্রচুর জায়গা!
ন্যানো কথাটি আমরা আজকাল প্রায়ই শুনতে পাই, এবং শব্দটার যে আসলে অপব্যবহার হয় না তা নয়। তবে ন্যানো টেকনোলজি বোঝানোর সময় ন্যানো শব্দটা ঠিকভাবেই ব্যবহার হয়েছে। হাজার ভাগের এক ভাগ বোঝানোর জন্যে আমরা বলি মিলি (103)। যে রকম পিনের উপরের মাথাটার সাইজ এক মিলিমিটার। মিলিমিটারকে হাজার ভাগে ভাগ করলে হয় মাইক্রোমিটার (105), আমাদের শরীরের লোহিত রক্তকণিকার আকার কয়েক মাইক্রোমিটার। মাইক্রোমিটারকে হাজার ভাগে ভাগ করলে হয় ন্যানোমিটার (10)। যখন কোনো কিছুর আকার ন্যানোমিটারের কাছাকাছি হয়ে যায় তখন সেটা সাধারণ মাইক্রোস্কোপ দিয়ে আর দেখা যায় না। তার কারণ সাধারণ মাইক্রোস্কোপ আলো দিয়ে কাজ করে আর দৃশ্যমান আলোয় তরঙ্গ দৈর্ঘ্য ন্যানোমিটারের চার থেকে সাতশত গুণ বেশি বড়! যাদের আগ্রহ রয়েছে তাদের জন্যে বলা যায় ন্যানো থেকে হাজার গুণ ছোট হলে তাকে বলে পিকো (10^-12) এবং পিকো থেকে হাজার গুণ ছোট হলে তাকে বলে ফ্যামটো (10^-15)। যদি কোনো যন্ত্র তৈরি করা হয় যার আকার 1 থেকে 100 ন্যানোমিটারের ভেতর তাহলে সেটাকে বলা হয় ন্যানো টেকনোলজি।
বোঝাই যাচ্ছে ন্যানো টেকনোলজি সহজ কোনো বিষয় নয় এবং বিজ্ঞানের কোনো একটি নির্দিষ্ট শাখা দিয়ে নানো টেকনোলজি গড়ে তোলা সম্ভব না! ন্যানো টেকনোলজি গড়ে উঠেছে একই সাথে পদার্থবিজ্ঞান, রসায়ন, জীববিজ্ঞান এবং অবশ্যই অনেকগুলো ইঞ্জিনিয়ারিং বিষয়ের সাহায্যে। যে জিনিস সাধারণ মাইক্রোস্কোপ দিয়েও চোখে দেখা যায় না বিজ্ঞানীরা সেটা কেমন করে তৈরি করেন সেটা নিঃসন্দেহে কৌতূহলের বিষয়। কিন্তু অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি আধুনিক সিনথেটিক রসায়ন এমন পর্যায়ে পৌঁছে গেছে যে বিজ্ঞানীরা অণু-পরমাণু সাজিয়ে সাজিয়ে যে কোনো আকার গড়ে তুলতে পারেন। সেই 1999 সালেই কর্নেল বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানীরা একটা নির্দিষ্ট লোহার পরমাণুর ওপর একটা নির্দিষ্ট কার্বন মনো অক্সাইডের অণু বসিয়ে তার ভেতর দিয়ে একটা বিদ্যুৎ ঝলক পাঠিয়ে সেটাকে পাকাপাকিভাবে সেখানে জুড়ে দিতে পেরেছিলেন। লরেন্স বার্কলে ল্যাবরেটরিতে কমপক্ষে তিনটা যন্ত্র রয়েছে যার আকার মাত্র কয়েক ন্যানোমিটার, কম্পিউটার ব্যবহার করে সেই যন্ত্রগুলো নিয়ন্ত্রণ করা যায়।
এখানে একটা জিনিস মনে রাখতে হবে, ন্যানো টেকনোলজি ব্যবহার করে তৈরি করা এই যন্ত্রগুলো শুধু যে ক্ষুদ্র তা নয়–অণু-পরমাণুর আকার হয়ে যাওয়ার কারণে তাদের ধর্ম পরিচিত জগৎ থেকে অনেক ভিন্ন। যেমন আমরা কখনোই একটা দেওয়ালের সামনে দাঁড়িয়ে দুশ্চিন্তায় ভুগি না যে হঠাৎ করে আমরা বুঝি দেওয়াল কুঁড়ে অন্যদিকে চলে যাব! অণু-পরমাণুর জগতে সেটা খুবই স্বাভাবিক ঘটনা কারণ সেই জগৎটি আমাদের পরিচিত জগৎ থেকে অনেক ভিন্ন, সেটা নিয়ন্ত্রণ হয় কোয়ান্টাম কেমানিক্স দিয়ে। কোয়ান্টাম মেকানিক্স অনুযায়ী একটা ইলেকট্রন প্রায় রুটিন মাফিক তার সামনে দাঁড়া করানো দেওয়ালের মতো বাধা ভেদ করে অন্য পাশে চলে যায়। তাই আমাদের পরিচিত জগতে যেটা খাঁটি বিদ্যুৎ নিরোধক ন্যানো টেকনোলজির জগতে সেটার ভিতর দিয়ে কম-বেশি বিদ্যুৎ প্রবাহিত হতে পারে। আমাদের পরিচিত জগতে যেটা নিষ্ক্রিয় পদার্থ ন্যানো টেকনোলজির জগতে হঠাৎ করে সেটাই সক্রিয় হয়ে ওঠে, সোনা তার একটি উদাহরণ। পরিচিত জগতে সোনা একটা নিষ্ক্রিয় পদার্থ তাই সেটা কোনো কিছুর সাথে বিক্রিয়া করে না, হাজার বছরেও তার কোনো বিকৃতি হয় না। ন্যানো টেকনোলজির জগতে সোনা মোটেও নিষ্ক্রিয় নয়, সেটা অত্যন্ত সক্রিয় একটা অণু!
ন্যানো টেকনোলজির জগন্টা সবে মাত্র উন্মোচিত হতে শুরু করেছে কাজেই তার ১ ভবিষ্যতা কী হবে সেটা কেউ খুব ভালো করে জানে না। অতীতে অনেক বার দেখা গেছে কোনো একটা প্রযুক্তিকে খুবই আশাব্যঞ্জক মনে হলেও শেষ পর্যন্ত প্রযুক্তিগত সমস্যা এমন বাড়াবাড়ি পর্যায়ে থাকে যে সেটা শেষ পর্যন্ত আর সাফল্যের মুখ দেখে না। তার একটা উদাহরণ উচ্চ তাপমাত্রার সুপার কন্ডাক্টর, আশির দশকে সারা পৃথিবীতে এটা নিয়ে যে উচ্ছ্বাসের জন্ম দিয়েছিল শেষ পর্যন্ত সেটা আর ধরে রাখা যায় নি। অনেক চেষ্টা করেও ব্যবহারযোগ্য উচ্চ তাপমাত্রার সুপার কন্ডাক্টর তৈরি করতে না পেরে পৃথিবীর প্রায় সব বিজ্ঞানী আর গবেষকই এটাকে পরিত্যাগ করেছেন। কাজেই ন্যানো টেকনোলজি নিয়ে এখন পৃথিবীতে যে উচ্ছ্বাস রয়েছে সেটাকে শেষ পর্যন্ত ধরে রাখা যাবে কী না সেটা নিয়ে অনেকের ভেতরেই। খানিকটা দুর্ভাবনা আছে।