“আমার বক্তৃতার কিছু আগে একটা খুব বিখ্যাত টেলিগ্রাফ কোম্পানির কোটিপতি মালিক আমার কাছে একটা টেলিগ্রাম পাঠিয়ে জানাল খুব জরুরি একটা ব্যাপারে সে আমার সাথে দেখা করতে চায়। আমি তাকে জানালাম আমার কোনো সময় নেই। উত্তরে সে বলল সে নিজেই চলে আসছে, সত্যি সত্যি কিছুক্ষণের মাঝে সে আমার সাথে দেখা করতে চলে এলো, হাতে একটা পেটেন্ট ফর্ম। সে এসে আমাকে সাংঘাতিকভাবে অনুরোধ করে বলল, আমি যেন আজকের বক্তৃতায় কিছুতেই আমার গবেষণার সব তথ্য সবাইকে জানিয়ে না দিই। সে বলল, “এর মাঝে অনেক টাকা! আমি তোমার জন্যে একটা পেটেন্ট করিয়ে দিই, তুমি কল্পনাও করতে পারবে না তুমি কী পরিমাণ টাকা ছুঁড়ে ফেলে দিচ্ছ। ইত্যাদি ইত্যাদি”, মানুষটা অবশ্যই আমাকে জানিয়ে দিল, “আমি শুধু লাভের অর্ধেক টাকা নেব, পুরো খরচ আমার ইত্যাদি!” এই কোটিপতি মানুষটি আমার কাছে ভিক্ষুকের মতো হাত জোড় করে এসেছিল শুধুমাত্র আরো কিছু টাকা বানানোর জন্যে। প্রিয় বন্ধু আমার, তুমি যদি শুধু এই দেশের মানুষের লোভ আর টাকার জন্যে লালসা একটিবার দেখতে! টাকা টাকা আর টাকা–কী কুৎসিত লোভ! আমি যদি একবার এই টাকার মোহে পড়ে যাই তাহলে কোনোদিন এর থেকে বের হতে পারব না। তুমি নিশ্চয়ই বুঝতে পারছ আমি যে গবেষণাগুলো করি সেগুলো বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে নয়। আমার বয়স হয়ে যাচ্ছে, আমি যা করতে চাই আজকাল সেগুলো করার জন্যেও সময় পাই না। তাই আমি মানুষটিকে সোজাসুজি না বলে বিদায় করে দিয়েছি।”
এটি হচ্ছে তাঁর চিঠিটার ভাবানুবাদ–পড়লেই বোঝা যায় বিজ্ঞানী জগদীশচন্দ্র বসুর টাকা বা নামের জন্যে কোনো মোহ ছিল না। তাই যে গবেষণার ফলাফল পেটেন্ট করে লক্ষ লক্ষ টাকা কামাই করা সম্ভব ছিল তিনি সেই ফলাফল রয়েল সোসাইটির মিটিংয়ে সবার সামনে ঘোষণা করে দিয়ে এলেন। অন্য অনেক কিছুর সাথে সেখানে দুই টুকরো ধাতব পাতের মাঝখানে খানিকটা পারদ রেখে তার একটি নূতন ধরনের কোহেরারের নকশা ছিল। মার্কোনি উদ্যোগী মানুষ–তিনি জগদীশচন্দ্র বসুর নকশার অতি সামান্য গুরুত্বহীন একটা পরিবর্তন করে সেটা পেটেন্ট করে ফেললেন। জগদীশচন্দ্র বসু কোহেরার ছিল ইংরেজি ইউয়ের (U) মতো, মার্কোনির কোহেরারটা সোজা–ভেতরে বাকি সব একরকম! সেই কোহেরার বের করে তিনি আটলান্টিক মহাসাগরের উপর দিয়ে প্রথম বেতার সংকেত পাঠিয়ে ইতিহাসে নিজের নামটি পাকা করে নিলেন।
1901 থেকে শুরু করে পৃথিবীর বিজ্ঞানীরা মার্কোনির যুগান্তকারী রেডিও বা বেতার তরঙ্গের পরীক্ষা আলোচনা করতে গিয়ে একবারও জগদীশচন্দ্র বসুর নামটি উচ্চারণ করেন নি! তখন সাদা চামড়ার মানুষেরা পৃথিবীর সকল জ্ঞান-বিজ্ঞানকে নিয়ন্ত্রণ করে এরকম সময় বাদামি চামড়ার একজন বাঙালি বিজ্ঞানী রেডিও বা বেতার যোগাযোগের আবিষ্কারের সম্মানটুকু নিয়ে নেবেন সেটি কেমন করে হয়?
তাই প্রায় একশ বছর সেটি নিয়ে কোনো আলোচনা হয় নি। শেষ পর্যন্ত 1998 সালে বিজ্ঞানের ইতিহাস ঘেঁটে নূতন করে সত্য উঘাটন করা হলো। পৃথিবীর ইঞ্জিনিয়ারিং বিষয়ে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সংগঠন (IEEE) আই ট্রিপল ইয়ের জার্নালে পুরো ইতিহাসটা খুঁটিনাটিসহ ছাপা হয়েছে। প্রথমবারের মতো স্বীকার করে নেয়া হয়েছে জগদীশচন্দ্র বসু আবিষ্কৃত কোহেরার ব্যবহার করে মার্কোনি তার রেডিও যোগাযোগ করেছিলেন। তাই রেডিওর আবিষ্কারক এককভাবে মার্কোনি নন-রেডিওর আবিষ্কারক একাই সাথে আমাদের মুন্সীগঞ্জের বাঙালি বিজ্ঞানী জগদীশচন্দ্র বসু! বিষয়টি এখনো সব জায়গায় পৌঁছে নি, নূতন যুগ তথ্য বিনিময়ের যুগ, তাই শুধু সময়ের ব্যাপার যখন আমরা দেখব পৃথিবীর মানুষ রেডিও আবিষ্কারক হিসেবে মার্কোনির নাম উচ্চারণ করার আগে জগদীশচন্দ্র বসুর নাম উচ্চারণ করছে!
স্যার জগদীশচন্দ্র বসু অনেক কিছুই করেছিলেন সবার আগে! সবাই কী জানে বাংলা সাহিত্যের প্রথম সায়েন্স ফিকশান লিখেছিলেন তিনি? 1896 সালে তার লেখা প্রথম সায়েন্স ফিকশানটি প্রকাশিত হয়–শিরোনাম ছিল ‘নিরুদ্দেশের কাহিনী’!
মাঝে মাঝে মনে হয় পৃথিবীর ইতিহাসে তার অবস্থানটি আবার খুঁজে বের করা সত্যিই বুঝি একটি নিরুদ্দেশের কাহিনী।
০৫. ন্যানোটেক
আমি যখন ক্যালিফোরনিয়া ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজিতে (সংক্ষেপে ক্যালটেক) কাজ করি তখন সেখানে সবচেয়ে আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্ব ছিলেন প্রফেসর রিচার্ড ফাইনম্যান। পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন কিন্তু সে জন্যে তাকে আকর্ষণীয় বলছি না (কারণ তখন সেখানে কমপক্ষে আরো এক ডজন নোবেল পুরস্কার পাওয়া বিজ্ঞানী ছিলেন!) তাকে আকর্ষণীয় বলছি তার আচার-আচরণের জন্যে। প্রাতিষ্ঠানিক বা গুরুতর বিষয়ে তার এলার্জির মতো ছিল–অথচ প্রচুর সময় কাটাতেন ছাত্রদের নিয়ে (ছাত্রদের অভিনীত নাটকে আমি তার মেথরের ভূমিকায় অভিনয় দেখে মুগ্ধ হয়েছি।) হাসি-তামাশা করতেন, মজা করতেন এবং সারাক্ষণই নানা ধরনের পাগলামো করতেন। ক্যালটেকে যোগ দেয়ার পরপরই পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের প্রবেশ পথে একটা ছোট যন্ত্র সাজানো যন্ত্র চোখে পড়ল। নিচে লেখা রয়েছে যে প্রফেসর ফাইনম্যান বিশ্বাস করেন ক্ষুদ্র যন্ত্রপাতির এক ধরনের গুরুত্ব আছে তাই তিনি একটা প্রতিযোগিতার আয়োজন করেছেন–ক্ষুদ্র মোটর তৈরির প্রতিযোগিতা। প্রতিযোগিতায় বিজয়ী মোটরটা সেখানে রাখা আছে–সেটা এত ছোট যে খালি চোখে ভালো করে দেখা যায় না, সেটা দেখার জন্যে একটা মাইক্রোস্কোপ রাখা আছে। মাইক্রোস্কোপে চোখ রেখে সুইচ টিপে ধরলে দেখা যায় অত্যন্ত ক্ষুদ্র মোটরটা পাই পাই করে ঘুরছে।