সত্যেন বোস সুদীর্ঘ 24 বছর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কাজ করেছেন। তার আগ্রহ ছিল বহুমাত্রিক, বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্থবিজ্ঞানের নানা ধরনের যন্ত্রপাতিও গড়ে তুলেছিলেন। আমরা যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র তখন কার্জন হলের বিভিন্ন কোনায় পুরানো যন্ত্রপাতি পড়ে থাকতে দেখেছি, পুরানো মানুষদের জিজ্ঞেস করে জানতে পেরেছি সেগুলো নাকি সত্যেন বোসের হাতে তৈরি নানা এক্সপেরিমেন্টের অংশ।
অসাধারণ প্রতিভাময় এই মানুষটি দেশ বিভাগের ঠিক আগে আগে কলকাতা ফিরে গিয়েছিলেন। তার কর্মময় জীবনের একটা অংশে তিনি শান্তিনিকেতনে বিশ্বভারতীর উপাচার্যের দায়িত্বও পালন করেছেন। শুধু বিজ্ঞানচর্চা নয় বিজ্ঞানের শিক্ষার জন্যেও তিনি অনেক কাজ করেছেন। 1974 সালে ফেব্রুয়ারির 4 তারিখ এই কর্মময় মানুষের জীবনাবসান হয়।
আমরা যখন আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যান্য ভবনের সাথে সাথে পদার্থবিজ্ঞান ভবনের নাম করেছিলাম সত্যেন বোস ভবন–তখন সেটা যেন আমরা না করতে পারি সে জন্যে সিলেট শহরের সকল ধর্মান্ধ শক্তি বিশ্ববিদ্যালয়কে দীর্ঘদিন অবরুদ্ধ করে রেখেছিল।
ভাগ্যিস সত্যেন বোস ততদিনে মারা গেছেন–তাকে এই ঘটনাটি নিজের কানে শুনতে হয় নি!
০৪. একটি নিরুদ্দেশের কাহিনী
আমরা যখন ছোট ছিলাম তখন গাছের পাতা ছিঁড়তে বা তার ডাল ভাঙতে আমরা খুব সতর্ক থাকতাম। কারণ সেই জন্ম থেকে শুনে আসছি বিজ্ঞানী জগদীশচন্দ্র বসু বলেছেন গাছের প্রাণ আছে, গাছও মানুষের মতো ব্যথা পায়। পৃথিবীর কত বিজ্ঞানীই তো কত কথা বলেছেন তাদের সবার কথাই যে এরকম বেদবাক্য হিসেবে নেয়া হতো তা নয়, কিন্তু জগদীশচন্দ্র বসুর কথার একটা আলাদা গুরুত্ব ছিল, তার কারণ তিনি ছিলেন বাঙালি। শুধু যে বাঙালি তা নয়–তার জন্ম হয়েছিল আমাদের বাংলাদেশের মুন্সীগঞ্জে। বড় হয়ে জানতে পেরেছি গাছের প্রাণ আছে কথাটি সত্যি কিন্তু মানুষের মতো গাছের স্নায়ু নেই, তাই সেটা ব্যথা পায় কথাটি পুরোপুরি ঠিক নয়। সেই সময় প্রচলিত বিশ্বাস ছিল গাছের ভেতর তথ্যগুলো যায় রাসায়নিক বিক্রিয়া দিয়ে, জগদীশচন্দ্র বসু দেখিয়েছিলেন সেটা আসলে যায় বৈদ্যুতিক সংকেতের ভেতর দিয়ে। প্রায় একশ বছর আগে আমাদের দেশের একজন বিজ্ঞানীর পক্ষে এরকম গবেষণা করে কিছু একটা বের করে ফেলা খুব সহজ কাজ ছিল না।
আমরা জগদীশচন্দ্র বসুর কথা মনে রেখেছি, বইপত্রে তার কথা পড়ি, তাকে নিয়ে আলোচনা করি, তার প্রধান কারণ তিনি একজন বাঙালি বিজ্ঞানী। পৃথিবীর অন্যান্য দেশের মানুষের তার কথা আলোচনা করার সে রকম কোনো কারণ নেই। কিন্তু 1998 থেকে হঠাৎ করে তার নামটা ঘুরেফিরে বিজ্ঞানী মহলে উঠে আসছে তার কারণ সেই বছর IEEE-এর প্রসিডিংয়ে একটা যুগান্তকারী প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে, সেই প্রতিবেদনে লেখা হয়েছে রেডিও-এর প্রকৃত আবিষ্কারক মার্কোনি নন, রেডিও এর প্রকৃত আবিষ্কারক হচ্ছেন আমাদের মুন্সীগঞ্জের বাঙালি বিজ্ঞানী স্যার জগদীশচন্দ্র বসু। মার্কোনিকে রেডিও-এর আবিষ্কারক বলা হয় কারণ 1901 সালে তিনি কোনো তার ছাড়া আটলান্টিক মহাসাগরের এক তীর থেকে অন্য তীরে প্রথমবার একটা সংকেত পাঠিয়েছিলেন। রেডিও বলতে আমরা আজকাল গান বা খবর শোনার জন্যে যে ছোট যন্ত্রটা বোঝাই, যেটা আমরা আমাদের পকেটে রেখে দিতে পারি, 1901 সালে সেটা মোটেও সেরকম কিছু ছিল না। সংকেতটা পাঠানোর জন্যে যে এন্টেনা ব্যবহার করা হয়েছিল সেটা প্রায় দুইশ ফিট উঁচু ছিল, সেটাকে চালানোর জন্যে 25 কিলোওয়াট বিদ্যুৎ লাগত, ভেতরে যে ক্যাপাসিটর ছিল সেটা ছিল প্রায় এক মানুষ সমান উঁচু!
সংকেতটাকে শোনার জন্যে যেটা ব্যবহার করা হয়েছিল সেটা ছিল আরো চমকপ্রদ! প্রায় সাড়ে চারশ ফুট লম্বা একটা এন্টেনাকে ঘুড়ি দিয়ে আকাশে উড়িয়ে দিয়ে সংকেতটাকে ধরতে হয়েছিল। আটলান্টিক মহাসাগর পাড়ি দিয়ে আসা সেই ওয়ারলেস বা বেতার সংকেতটা ছিল খুব দুর্বল, তার জন্যে দরকার ছিল খুবই সূক্ষ্ম যন্ত্রপাতি। যদি সূক্ষ্ম যন্ত্রপাতি না থাকত তাহলে এই ঐতিহাসিক পরীক্ষাটা কখনোই করা সম্ভব হতো না। মার্কোনি এই সূক্ষ্ম পরীক্ষাটি করার জন্যে যে যন্ত্রটা ব্যবহার করেছিলেন সেই সময় তাকে বলা হতো কোহেরার (coherer)। তখন যে কোহেরার ব্যবহার করা হতো সেগুলো খুব ভালো কাজ করত না–একটা সংকেত পাওয়ার পরপরই কোহেরারকে ছোট হাতুড়ি দিয়ে আঘাত করে পরের সংকেত পাবার জন্যে প্রস্তুত করতে হতো। মার্কোনি তার পরীক্ষায় যে কোহেরার ব্যবহার করেছিলেন সেটাই ছিল রেডিও বা তারহীন সংকেত পাঠানোর প্রক্রিয়ার একেবারে মূল বিষয়। মার্কোনি কিংবা তার সমসাময়িক বিজ্ঞানীদের কেউ কখনো ভুলেও স্বীকার করেন নি যে সেটা আসলে আবিষ্কার করেছিলেন বিজ্ঞানী জগদীশচন্দ্র বসু! তাই বিজ্ঞানের জগতে রেডিও-এর আবিষ্কারক হিসেবে জগদীশচন্দ্র বসুর পরিবর্তে মার্কোনির নামটা ঢুকে গিয়েছে।
মজার কথা হচ্ছে এর প্রায় দশ বছর আগে 1899 সালে লন্ডনের রয়েল সোসাইটিতে বিজ্ঞানী জগদীশচন্দ্র বসু তার এই কোহেরারটি নিয়ে একটা নিবন্ধ পড়েছিলেন। তিনি যে যন্ত্রপাতিগুলো তৈরি করেছিলেন তার অনেকগুলোই কোলকাতার বোস ইনস্টিটিউটে রাখা আছে। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় মার্কোনির অনেক আগেই তিনি কোলকাতায় ওয়ারলেস বা বেতার দিয়ে সংকেত পাঠিয়েছিলেন। সাধারণ মানুষের মনে প্রশ্ন জাগতে পারে তা-ই যদি সত্যি হয় তাহলে পৃথিবীর ইতিহাসে রেডিও-এর আবিষ্কারক হিসেবে জগদীশচন্দ্র বসুর নাম নেই কেন? উত্তরটাও খুব সোজা, এর মূল সমস্যা হচ্ছে জগদীশচন্দ্র বসু নিজেই! 1901 সালে মার্কোনির ঐতিহাসিক পরীক্ষার পর জগদীশচন্দ্র বসু কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে একটা চিঠি লিখেছিলেন, সেই চিঠিটা পড়লেই কারণটা পরিষ্কার হয়ে যাবে। মূল চিঠিটা সম্ভবত বাংলাতেই লেখা হয়েছিল, তার ইংরেজি অনুবাদ থেকে আবার বাংলায় অনুবাদ করা হলে সেটা হয় এ রকম :