এখন এই পরীক্ষাটা করার জন্যে দরকার একটা পূর্ণ সূর্যগ্রহণ–কিন্তু সমস্যা হচ্ছে সূর্যগ্রহণ ইচ্ছেমতো তৈরি করা যায় না। আইনস্টাইন ক্যালেন্ডার ঘেঁটে দেখলেন 1914 সালের 21 আগস্ট রাশিয়ার ক্রিমিয়াতে একটা পূর্ণ সূর্যগ্রহণ হবে। আইনস্টাইনের একজন বিজ্ঞানী বন্ধু আরউইন ফ্রিয়োনডিৗচ ঠিক করলেন তিনি রাশিয়াতে যাবেন সূর্যগ্রহণের সময় নক্ষত্রের ছবি তোলার জন্যে।
বিজ্ঞানীদের জীবনে কী ধরনের দুর্ঘটনা ঘটতে পারে এই অভিযানটি ছিল তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ। ঠিক তখন প্রথম মহাযুদ্ধ শুরু হতে যাচ্ছে এবং বিজ্ঞানী আরউইন ফ্রিয়োনডিৗচ যখন তার টেলিস্কোপ ক্যামেরা এবং যন্ত্রপাতির লটবহর নিয়ে রাশিয়াতে ঘুরে বেড়াচ্ছেন ঠিক তখন জার্মানি রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে বসেছে! রাশিয়ার পুলিশ গুপ্তচর সন্দেহ করে তাকে গ্রেপ্তার করে ফেলল এবং যখন ক্রিমিয়াতে পূর্ণ সূর্যগ্রহণ হচ্ছে তখন এই বিখ্যাত বৈজ্ঞানিক জেলখানায়। আরউইন ফ্রিয়োনডিীচের কপাল ভালো ঘটনাক্রমে ঠিক সেই সময় কিছু রাশিয়ান অফিসার জার্মানিতে গ্রেপ্তার হয়েছে এবং দুই দেশের যুদ্ধবন্দি বিনিময়ের মাঝে দিয়ে তিনি ছাড়া পেয়েছিলেন!
সূর্যগ্রহণের সময় নক্ষত্রের অবস্থানের বিচ্যুতি মাপার প্রথম পরীক্ষাটা এভাবে বৃথা যাওয়ায় আইনস্টাইনের যে খুব আশাভঙ্গ হলো সেটা বলার অপেক্ষা রাখে না। তিনি আবার ক্যালেন্ডার ঘেঁটে আবিষ্কার করলেন এর পরের পূর্ণ সূর্যগ্রহণ হবে 1919 সালের 29 মে এবং সেটা দেখা যাবে দক্ষিণ আমেরিকা আর মধ্য আফ্রিকা থেকে। সূর্যগ্রহণের সময় নক্ষত্রের আলোকচিত্র তুলে এই সূক্ষ্ম পরীক্ষাটা করার সবচেয়ে উপযুক্ত মানুষ ছিলেন কেমব্রিজ অবজারভেটরির আর্থার এডিংটন। কিন্তু তিনি একটা ঝামেলায় পড়ে গেলেন, তখন যুদ্ধ চলছে এবং ব্রিটিশ সরকার তাকে যুদ্ধে পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিয়ে বসে রইল। এডিংটন নীতিগত কারণে যুদ্ধে অংশ নেবেন না কিন্তু সরকার তাকে যুদ্ধে পাঠাবেই–শেষ পর্যন্ত আরো বড় বড় বিজ্ঞানীরা তাকে যুদ্ধ থেকে রক্ষা করলেন এবং এডিংটন সূর্যগ্রহণের ছবি তোলার জন্যে জাহাজে করে আফ্রিকা রওনা দিলেন!
পৃথিবীর বিজ্ঞানীরা ল্যাবরেটরিতে অনেক সূক্ষ্ম এবং জটিল পরীক্ষা করেছেন, কিন্তু এই পরীক্ষাটি সম্পূর্ণ অন্যরকম! এর জন্যে বিজ্ঞানীদের পুরোপুরি প্রকৃতির উপর নির্ভর করে থাকতে হয়। সূর্যগ্রহণ শুরু হয় ধীরে ধীরে এবং সেটা কয়েক ঘণ্টা স্থায়ী হয় কিন্তু পূর্ণ সূর্যগ্রহণ থাকে মাত্র কয়েক মিনিট। যদি সেই কয়েক মিনিট কোনো কারণে মেঘ এসে সূর্যকে ঢেকে ফেলে তাহলে বিজ্ঞানীদের হয়তো আরো এক যুগ অপেক্ষা করতে হবে! এডিংটন তার দলবল নিয়ে সব প্রস্তুতি নিয়ে রাখলেন এবং সূর্যগ্রহণের ঠিক আগে আসা কালো মেঘ এসে আকাশ ঢেকে ফেলল। শুধু তাই নয় রীতিমতো বস্ত্র বিজলিসহ প্রচণ্ড ঝড় শুরু হলো। বিজ্ঞানীদের কী পরিমাণ হতাশা হয়েছিল সেটা অনুমান করা কঠিন নয়। কিন্তু তারা আবিষ্কার করলেন ঠিক পূর্ণ সূর্যগ্রহণের আগে আগে আকাশ পরিষ্কার হতে শুরু করেছে এবং মেঘের ফাঁকে ফাঁকে সূর্য উঁকি দিতে শুরু করেছে। এডিংটন একটিবারও আকাশের দিকে না তাকিয়ে তার সহকর্মীদের নিয়ে আলোকচিত্র নিতে শুরু করলেন এবং পূর্ণ সূর্যগ্রহণের 302 সেকেন্ড সময়ে ষোলটা আলোকচিত্র নিয়ে রাখলেন। আলোকচিত্রগুলো ডেভেলপ করার পর দেখা গেল মেঘের ফাঁকে ফাঁকে মাত্র একটা ছবি এসেছে যেটাকে এই অসাধারণ বৈজ্ঞানিক পরীক্ষার কাজে ব্যবহার করা যাবে! সেটাকেও বিশ্লেষণ করা হলো এবং দেখা গেল আইনস্টাইন যে ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন সেটা অক্ষরে অক্ষরে সত্যি। নক্ষত্রের আলো সূর্যের পাশে দিয়ে আসার সময় যেটুকু বেঁকে যাবার কথা ঠিক সেটুকু বেঁকে গেছে।
1919 সালের নভেম্বরের 6 তারিখ সেই বিখ্যাত পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশিত হলো এবং সাথে সাথে আইনস্টাইন নামের একজন তরুণ বিজ্ঞানী বিজ্ঞান জগতের “সুপারস্টার” হয়ে গেলেন!
তিনি এখনো বিজ্ঞান জগতের সুপারস্টার এবং যতদিন পৃথিবীর সভ্যতা টিকে থাকবে তিনি সুপারস্টার হিসেবেই থাকবেন।
৩১. অতিকায় হীরক খণ্ড
প্রদীপের তেল ফুরিয়ে গেলে সেটা কয়েক বার দপদপ করে জ্বলে নিভে যায়। সেভাবে আমাদের সূর্যের জ্বালানিও কখনো শেষ হয়ে যাবে কী না, আর সেটাও কয়েক বার দপদপ করে জ্বলে চিরদিনের মতো নিভে যাবে কী না সেটা নিয়েও পৃথিবীর মানুষ নিশ্চয়ই দুশ্চিন্তা করেছে। প্রাচীনকালে কিছুক্ষণের জন্যে যখন সূর্যগ্রহণের সময় সূর্যটি ঢেকে যেত মানুষের তখন দুশ্চিন্তার শেষ থাকত না–সূর্যগ্রহণ শেষে যখন সূর্য আবার তার পুরো ঔজ্জ্বল্য নিয়ে ফিরে আসত মানুষ তখন স্বস্তির নিশ্বাস ফেলত। পৃথিবীর মানুষ যখন আবিষ্কার করেছে যে সূর্যের জ্বালানি প্রদীপের তেলের মতো নয়–এটা হচ্ছে নিউক্লিয়ার বিক্রিয়া, ভরটুকু আইনস্টাইনের E = mc^2 হিসেবে শক্তিতে রূপান্তরিত হচ্ছে তখন তাদের দুশ্চিন্তার অবসান হয়েছে–সূর্যের ভেতরে প্রতি সেকেন্ডে 40 লক্ষ টন পদার্থ শক্তিতে রূপান্তরিত হচ্ছে, সূর্যের ভর তিন লক্ষ পৃথিবীর সমান, কাজেই সেটা চট করে ফুরিয়ে যাবে না। সেটা হতে এখনো প্রায় পাঁচ বিলিয়ন বছর বাকি!