পাকিস্তানের জাতীয় পতাকাতে আরো একটা সমস্যা রয়েছে–সেখানে যে চাঁদটি রয়েছে সেটি কী উজ্জ্বলতর হওয়ার প্রতীক্ষায় থাকা নূতন চাঁদ, নাকী অমাবস্যার অন্ধকারে ডুবে যাবার আগের মুহূর্তের ক্ষয়িষ্ণু চাঁদ? অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি এটা নূতন চাঁদ নয়–এটা ক্ষয়িষ্ণু চাঁদ!
ভাগ্যিস 1971 সালে স্বাধীনতা যুদ্ধে পাকিস্তানকে পরাজিত করে আমরা বাংলাদেশ স্বাধীন করে নূতন জাতীয় পতাকা পেয়েছিলাম, তা না হলে এই অবৈজ্ঞানিক পতাকার দায়ভার আমাদের বয়ে বেড়াতে হতো!
৩০. সূর্যগ্রহণ ও একজন সুপার স্টার
2009 সালের জুলাই মাসের 22 তারিখ বহুদিন পর পূর্ণ সূর্যগ্রহণ হয়েছিল। আমাদের খুব সৌভাগ্য বাংলাদেশের পঞ্চগড় এলাকা থেকে এ দেশের মানুষ সেটি পরিষ্কারভাবে দেখতে পেরেছিল। এর পরেরটি দেখা যাবে এক শতাব্দী থেকেও বেশি পরে–কাজেই এ সূর্যগ্রহণটি নিঃসন্দেহে এ দেশের ইতিহাসের একটা বড় ঘটনা হিসেবে বিবেচনা করা যায়।
আমরা এখন জানি চাঁদটা যখন ঠিক সূর্যের সামনে এসে হাজির হয় তখন সূর্যটা ঢাকা পড়ে যায় আমরা সেটাকেই বলি সূর্যগ্রহণ। আমরা খুবই সৌভাগ্যবান যে আমাদের চঁদটার আকার মোটামুটি সঠিক এবং এটা সঠিক দূরত্বের একটা কক্ষপথে ঘুরছে। যদি এটা আরো ছোট হতে কিংবা কক্ষপথটা আরো বড় হতো তাহলে এটা কখনোই সূর্যটাকে পুরোপুরি ঢেকে ফেলতে পারত না আর পৃথিবীর মানুষ কখনোই পূর্ণ সূর্যগ্রহণ দেখতে পেত না। ঠিক কী কারণে সূর্যগ্রহণ হয় মানুষ যখন জানত না তখন এ ব্যাপারটি নিয়ে যে তাদের ভেতর এক ধরনের আতঙ্ক ছিল সেটা খুব অবাক ব্যাপার নয়। দিনদুপুরে ঝলমলে আলোর মাঝে হঠাৎ করে সূর্য নিভে যেতে যেতে পুরোপুরি অন্ধকার হয়ে যায় মানুষ আতঙ্ক অনুভব করতেই পারে। এখনও পৃথিবীর অনেক মানুষই সূর্যগ্রহণ শেষ না হওয়া পর্যন্ত নানারকম উপাসনা প্রার্থনা করতে থাকে! যখন সূর্য ঢেকে যাওয়া চাঁদের আড়াল থেকে সরে এসে আবার আলো ঝলমল হয়ে ওঠে সেই মানুষেরা তখন স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে।
সূর্যগ্রহণ কেন হয় সেটি জেনে যাবার পর পৃথিবীর মানুষের দুশ্চিন্তা কমেছে এবং যখন পূর্ণ সূর্যগ্রহণ হয় তখন তারা সেই চমকপ্রদ ঘটনার সৌন্দর্যটি উপভোগ করতে পারে। সূর্য এত উজ্জ্বল যে যদি একেবারে পুরোপুরি পরিপূর্ণ সূর্যগ্রহণ না হয়, যদি তার খুব ছোট একটা অংশও দৃশ্যমান থেকে যায় তাহলে কিন্তু পূর্ণ সূর্যগ্রহণের সৌন্দর্যটুকু দেখা যায় না। সূর্যের চারপাশে উজ্জ্বল আলোর একটি ছটা থাকে, এটি আসলে মিলিয়ন মিলিয়ন কিলোমিটারব্যাপী সূর্য থেকেও উত্তপ্ত হাইড্রোজেন পরমাণুর একটা বলয়–এটার নাম করোনা এবং এই করোনা থেকে এ ধরনের আলোর বিকীরণ হয়, শুধুমাত্র সূর্যগ্রহণের সময়েই পৃথিবীর মানুষ এটি খালি চোখে দেখতে পারে (30.1 নং ছবি)। পূর্ণ সূর্যগ্রহণের সময় আরো একটা অভূতপূর্ব ব্যাপার ঘটে, পুরোপুরি দিনের বেলায় হঠাৎ করে আকাশে নক্ষত্রগুলো জ্বলজ্বল করে দৃশ্যমান হয়ে। পৃথিবীতে এর চাইতে চমকপ্রদ ব্যাপার খুব বেশি নেই।
বর্তমানে পৃথিবীতে পূর্ণ সূর্যগ্রহণের সময় নক্ষত্রদের দেখা একটি অভূতপূর্ব দৃশ্য কিন্তু একসময় এই বিষয়টি দিয়ে পৃথিবীর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ একটা বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা করা হয়েছিল।
আইনস্টাইন 1905 সালে তাঁর স্পেশাল থিওরি অব রিলেটিভিটি প্রকাশ করেছিলেন। স্পেশাল থিওরি অব রিলেটিভিটি প্রকাশ করার সাথে সাথেই তিনি জেনারেল থিওরি অব রিলেটিভিটি নিয়ে কাজ শুরু করেছিলেন। এখন আমরা সবাই জানি এই জেনারেল থিওরি অব রিলেটিভিটি মহাকর্ষ বলের সঠিক ব্যাখ্যা কিন্তু সেই সময় পৃথিবীর বিজ্ঞানীরা সেটা মেনে নিতে রাজি ছিলেন না। এর আগে মহাকর্ষ বলের জন্যে নিউটন যে সূত্রটি দিয়েছিলেন সেটি দুই শতাব্দী সৌরজগতের চন্দ্র সূর্য গ্রহের আবর্তন থেকে শুরু করে পৃথিবীতে একটা গাছ থেকে একটা আপেল নিচে এসে পড়ার গতিপ্রকৃতি পর্যন্ত সার্বিকভাবে ব্যাখ্যা করতে পারত। মহাকর্ষবলের জন্যে নূতন যে একটা সূত্রের প্রয়োজন আছে সেটা কেউ জানত না। নিউটনের সূত্র মহাকর্ষ সংক্রান্ত সবকিছু ব্যাখ্যা করতে পেরেছিল–শুধুমাত্র বুধ গ্রহের কক্ষপথে আবর্তনে একটা অত্যন্ত ক্ষুদ্র একটা বিচ্যুতি সেটা ব্যাখ্যা করতে পারত না। (বিচ্যুতিটা এত ছোট যে সেটা নিয়ে যে বৈজ্ঞানিকেরা মাথা ঘামাতেন সেটাই অবিশ্বাস্য! একশ বছরে বুধ গ্রহের কক্ষপথে এক ডিগ্রির ছয় ভাগের এক ভাগের একটা বিচ্যুতি হতো।) বৈজ্ঞানিকেরা ভাবতেন হয়তো তাদের চোখে পড়ে নি এরকম একটা গ্রহ রয়ে গেছে, যার টানাপোড়েনে বুধ গ্রহের কক্ষপথে এই বিচ্যুতিটা ঘটছে।
আইনস্টাইন তার জেনারেল থিওরি অব রিলেটিভিটি দিয়ে বুধ গ্রহের কক্ষপথের এই বিচ্যুতিটা ব্যাখ্যা করে ফেললেন কিন্তু পৃথিবীর প্রতিষ্ঠিত বিজ্ঞানীরা সেটাকে খুব গুরুত্ব দিলেন না। মহামতি নিউটনের মতো বড় একজন বিজ্ঞানীর অত্যন্ত সফল মহাকাশের সূত্রটা ফেলে দিয়ে আইনস্টাইন নামের কমবয়সী অপরিচিত একজন বৈজ্ঞানিকের অবস্থান এবং সময়ের (Space time) সম্মিলিত একটা বিচিত্র সূত্র গ্রহণ করতে কেউ খুব আগ্রহী ছিলেন না।
আইনস্টাইন এক ধরনের অস্থিরতায় ভুগছিলেন, তিনি তখন একটা জিনিস বুঝতে পেরেছিলেন। পৃথিবীর পুরানো সমস্যা ব্যাখ্যা করে তিনি বিজ্ঞানীদের বোঝাতে পারবেন না, তিনি যদি কোনো একটা ভবিষ্যদ্বাণী করেন এবং সেই ভবিষ্যদ্বাণীটা যদি অক্ষরে অক্ষরে মিলে যায় তাহলে হয়তো বিজ্ঞানীরা তার জেনারেল থিওরি অব রিলেটিভিটি বিশ্বাস করবেন। আইনস্টাইন তখন একটা চমকপ্রদ পরীক্ষার কথা ভেবে বের করলেন। আমরা সাধারণভাবে জানি আলো সরলরেখায় যায়। কিন্তু সূর্যের বিশাল ভরের কারণে তার চারপাশের “স্থানটুকু বাঁকা হয়ে যাবে, সেই বাঁকা স্থানের কারণে আলোটা যখন যাবে সে আর সোজা যেতে পারবে, আলোটা বাঁকা হয়ে যাবে। (30.2 নং ছবি) এই পরীক্ষাটা করার জন্যে দরকার নক্ষত্রের আলো-সূর্যের পাশ দিয়ে সেই আলোটা বাঁকা হয়ে যাবে। কিন্তু এই পরীক্ষাটা করার একটা গুরুতর সমস্যা আছে, সূর্য এত উজ্জ্বল যে তার চোখ ধাঁধানো আলোর কারণে তার আশেপাশে নক্ষত্রকে দেখার কোনো প্রশ্নই আসে না। আইনস্টাইন বুঝতে পারলেন এই পরীক্ষাটা করার একটা মাত্র উপায়, সেটা হচ্ছে–যখন পূর্ণ সূর্যগ্রহণ হবে তখন সূর্যের পাশে দিয়ে আসা নক্ষত্রের আলোগুলোকে দেখা। সূর্যের পাশে দিয়ে আসার সময় নক্ষত্রের আলো ঠিক কতটুকু বেঁকে যাবে আইনস্টাইন সেটা হিসেব করে বের করে রাখলেন।