যারা এখন পর্যন্ত এই লেখাটা খুব মনোযোগ দিয়ে পড়ে এসেছে তারা নিশ্চয়ই এখন বলবে, তাই যদি সত্যি হবে তাহলে প্রতি অমাবস্যায় কেন সূর্যগ্রহণ হয় না আর প্রতি পূর্ণিমায় কেন চন্দ্রগ্রহণ হয় না? এর কারণ চাঁদের কক্ষপথটা আসলে পৃথিবী আর সূর্যের সাথে এক সমতলে নয়, এটা তার সাথে 5° কোণ করে রেখেছে (29.2 নং ছবি) তাই প্রতি অমাবস্যায় এটা ঠিক পৃথিবী আর সূর্যের মাঝখানে আসতে পারে না আবার প্রতি পূর্ণিমায় চাঁদটি ঠিক সূর্য আর পৃথিবীর সাথে এক সরলরেখায় থাকতে পারে না। মাঝে মাঝে থাকে আর ঠিক তখন সূর্য বা চন্দ্রগ্রহণ হয়। যখন এই গ্রহণ হয় তখন সারা পৃথিবী থেকে সেটা সমানভাবে দেখা যায় না। 2009 সালের জুলাই মাসের 22 তারিখে যে সূর্যগ্রহণ হয়েছে বাংলাদেশ থেকে সেটা পরিপূর্ণভাবে দেখা গেছে।
নূতন চাঁদ বলতে আমরা কী বোঝাই এতক্ষণে সেটাও নিশ্চয়ই সবার কাছে স্পষ্ট হয়ে গেছে। খাঁটি অমাবস্যায় চাঁদটা থাকে সূর্যের ঠিক বিপরীতে। চাঁদটা যখন একটু সরে আসে এবং পৃথিবী থেকে আমরা চাঁদের আলোকিত অংশের একটা কিনারাকে দেখতে পাই আমরা সেটাকেই বলি নূতন চাঁদ। নূতন চাঁদ ওঠার কয়েকদিনের ভেতরেই চাঁদ আরো সরে আসে এবং পৃথিবী থেকে আমরা চাঁদের আলোকিত অংশের আরো অংশ বিশেষ দেখতে শুরু করি। আমরা সেটাকে বলি শুক্লপক্ষ। পূর্ণিমার পর আবার উল্টো ব্যাপার ঘটতে শুরু করে, চাঁদের আলোকিত অংশটা আবার আমাদের আড়ালে চলে যেতে থাকে, আমরা সেটাকে বলি কৃষ্ণপক্ষ। যারা আকাশের চাঁদ দেখতে ভালোবাসেন তারা চাঁদের কোন অংশ আলোকিত সেটা দেখেই বলে দিতে পারবেন কখন শুক্লপক্ষ কখন কৃষ্ণপক্ষ। আমি নিজে সেটি করি দুটো অক্ষর দিয়ে। শুক্লপক্ষে যেহেতু চাঁদ উজ্জ্বল থেকে উজ্জ্বলতর হয় তার জন্যে bright। শব্দের প্রথম অক্ষর b ব্যবহার করি, শুক্লপক্ষে চাঁদ থাকে b-এর বাঁকা অংশের মতো (29.3 নং ছবি)। আবার কৃষ্ণপক্ষে চাঁদ ধীরে ধীরে অন্ধকার হতে থাকে তার জন্যে ইংরেজি শব্দ dark-এর প্রথম অক্ষর d ব্যবহার করা যায়। এই সময় চাঁদ থাকে b-এর বাঁকা অংশের মতো!
যারা আকাশের চাঁদ উপভোগ করেন তাদের পেটের ভেতরে এতক্ষণে আরেকটা প্রশ্ন দানা বেঁধে ওঠার কথা। সেটা হচ্ছে পূর্ণিমার চাঁদ যখন দিগন্ত থেকে প্রথম উদিত হয় তখন সেটা থাকে বিশাল, সেটা যখন মাথার উপরে উঠে যায় তখন সেটা কেন এত ছোট হয়ে যায়? এই অত্যন্ত যৌক্তিক প্রশ্নের উত্তরটি একটু বিচিত্র, সেটি হচ্ছে আসলে এটি সত্যি নয়। চাঁদ যখন প্রথম ওঠে এবং যখন মাথার উপর উঠে তার আকারের পরিবর্তন হয় না–পুরোটাই আমাদের দৃষ্টিবিভ্রম! আমি জানি এটা মেনে নেয়া কঠিন কিন্তু কেউ যদি আমার কথা বিশ্বাস না করে তাহলে যন্ত্রপাতি দিয়ে মেপে দেখতে পারে–ক্যামেরা দিয়ে ছবি তুলে দেখতে পারে, সে আবিষ্কার করবে কথাটি সত্যি।
চাঁদ নিয়ে তথ্যের কোনো শেষ নেই, কাজেই চমকপ্রদ তথ্যটা দিয়ে শেষ করা যাক। যারা 29.1 নং ছবিটি দেখেছে তারা নিশ্চয়ই প্রশ্ন করতে পারে চাঁদটা যেহেতু পৃথিবীকে ঘিরে ঘুরছে তাই নিশ্চয়ই একেক সময় চাঁদের একেক অংশ পৃথিবীর দিকে মুখ করে আছে। তাই আমরা যদি নিয়মিতভাবে চাঁদকে লক্ষ করি তাহলে আগে হোক পরে হোক, একটু একটু করে হলেও আমরা নিশ্চয়ই পুরো চাঁদটাকেই দেখতে পারব। কিন্তু মজার ব্যাপার হলো সেটা সত্যি নয়। চাঁদ যখন পৃথিবীকে ঘিরে ঘুরে সে সবসময়েই তার একটা নির্দিষ্ট অংশ পৃথিবীর দিকে মুখ করে রাখে। আমরা শুধু সেই অংশটাই দেখতে পাই অন্য অংশটা কখনোই দেখি না। চন্দ্রে অভিযান করে মহাকাশযান পাঠিয়ে প্রথম চাঁদের উল্টো পিঠের ছবি তুলে আনা হয়েছিল। (আমরা চাঁদের যে অংশটা দেখি সেখানে “কলংক” অনেক বেশি–চাঁদের কালো অংশকে কেন কলংক বলা হয় আমার কাছে তার সদুত্তর নেই!)। এখানে একটা বিষয় উল্লেখ করা দরকার, কেউ যেন মনে না করে পৃথিবীর সাথে চাঁদের এই ব্যবহার খুব বিচিত্র কিছু। যখন দুটি গ্রহ বা উপগ্রহ একটা আরেকটাকে ঘিরে ঘুরতে থাকে, ধীরে ধীরে তারা প্রায়ই এরকম একটা অবস্থানে চলে যায়, জ্যোতির্বিজ্ঞানে এরকম আরো অনেক উদাহরণ আছে।
লেখার শুরুতে আমরা বলেছিলাম পৃথিবীতে অন্তত একটি দেশ আছে যে দেশটি চাঁদ সম্পর্কে তাদের অজ্ঞতা রাষ্ট্রীয়ভাবে প্রচার করে আসছে–সেই দেশটির নাম পাকিস্তান। তাদের জাতীয় পতাকায় সরু চাঁদের পাশে একটি তারা আঁকা আছে (29.4 নং ছবি)। আমরা এতক্ষণে জেনে গেছি চাঁদ কখনো সরু হয়ে যায় না, তার পুরো আলোকিত অংশের খানিকটা দেখি বলে সরু মনে হয়–পুরো চাঁদটা কিন্তু সেখানে আছে। পুরো চাঁদ যদি থাকে তাহলে তার মাঝখানে একটা তারা দেখার কোনো উপায় নেই! পাকিস্তানের জাতীয় পতাকায় যেভাবে চাঁদ-তারা আঁকা আছে সেভাবে তারাটা দেখতে হলে চাঁদের ঠিক মাঝখানে বিশাল এক ফুটো করে রাখতে হবে যেন সেই ফুটো দিয়ে পিছনের তারাকে দেখা যায়।
পৃথিবীর বিজ্ঞানমনস্ক দেশ যখন তাদের জাতীয় পতাকায় চাঁদ তারা বসিয়েছে তখন কিন্তু তারাটাকে ঠিক জায়গায় বসানোর জন্যে সেটাকে বসিয়েছে চাঁদের বৃত্তাকারের বাইরে তুরস্কের জাতীয় পতাকাটা দেখলেই সেটা বোঝা যায়!