ইতোমধ্যে টেক্সট বই বা প্ল্যানেটরিয়াম-এ গ্রহের তালিকা থেকে প্লুটো গ্রহকে সরিয়ে নেয়া শুরু হয়েছে। যে গ্রহটি ঐতিহাসিকভাবে এতদিন সবার মনোযোগ আকর্ষণ করে রেখেছিল হঠাৎ করে সেটাকে তুলনামূলকভাবে কম গুরুত্বপূর্ণ বামন গ্রহ হিসেবে আরো 40টি থেকে বেশি বামন গ্রহের তালিকায় ফেলে দিতে সবারই যে একটু মন খারাপ হচ্ছে সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু কিছু করার নেই, বিজ্ঞানের জগতে মনের অনুভূতিটুকু সরিয়ে যুক্তি-তর্ক আর বিশ্লেষণকে নিয়েই অগ্রসর হতে হয়।
কাজেই বিদায় প্রটো, আমরা তোমার অভাবটুকু অনুভব করব!
২৯. পৃথিবীর মানুষ ও আকাশের চাঁদ
আমাদের জীবনে উপভোগ করার জন্যে যে কয়টি জিনিস আছে তার তালিকায় চাঁদ নিশ্চয়ই একেবারে প্রথম দিকে। আমি নিশ্চিত পৃথিবীতে একজন মানুষকেও খুঁজে পাওয়া যাবে না যে কখনো না কখনো চাঁদকে দেখে মুগ্ধ হয় নি। আমার নিজের 1971 সালের একটি দিনের কথা মনে আছে, সেই ভয়াবহ দিনটিতে আমাদের পুরো পরিবার তাড়া খাওয়া পশুর মতো জীবন নিয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছিলাম, তার মাঝে হঠাৎ করে আকাশের দিকে তাকিয়ে আমি চমকে উঠেছিলাম। সন্ধেবেলা আকাশ আলো করে পূর্ণিমার চাঁদ উঠেছে, সেই ভয়ঙ্কর সৌন্দর্যের কথা আমি আজও ভুলতে পারি না।
মজার কথা হচ্ছে এই চাঁদের অত্যন্ত সহজ কিছু বিষয় কিন্তু অনেক সাধারণ মানুষই ভালো করে লক্ষ করে নি। যারা মুসলমান তারা চাঁদ দেখে রোজা রাখে, চাঁদ দেখে ঈদ করে কিন্তু কেন নূতন একটা সরু চাঁদ আস্তে আস্তে পূর্ণিমার ভরা চাঁদ হয়ে ওঠে আবার পূর্ণিমার ভরা চাঁদটা কেমন করে অমাবস্যার অন্ধকারে ডুবে যায় তাদের অনেকেই সেটা জানে না। কেউ যদি এটুকু পড়ে খানিকটা অপরাধ বোধে ভুগতে থাকে তাহলে তাদের সান্ত্বনা দিয়ে বলতে পারি, এটা নিয়ে লজ্জা পাবার কিছু নেই। পৃথিবীতে অন্তত একটি দেশ রয়েছে যে দেশটি রাষ্ট্রীয়ভাবে এই তথ্যটুকু জানে না সেটা তাদের জাতীয় পতাকার মাধ্যমে স্বীকার করে নিয়েছে! সেটি কোন দেশ এবং কীভাবে রাষ্ট্রীয়ভাবে তাদের অজ্ঞানতা প্রকাশ করে বসে রয়েছে সেটা বলার আগে আমরা চাঁদের সহজ কয়েকটা বিষয় জেনে নেই।
আমরা সবাই লক্ষ করেছি প্রতিদিন সূর্য পূর্ব দিকে উঠে আকাশ পাড়ি দিয়ে পশ্চিম দিকে অস্ত যায়। কারণটা খুব সহজ–সূর্য মোটেও ঘুরপাক খাচ্ছে না, সে তার জায়গায় স্থির, পৃথিবীটাই তার অক্ষের উপর ঘুরছে তাই মনে হচ্ছে সূর্যটা বুঝি পূর্ব দিকে উঠে পশ্চিম দিকে অস্ত যাচ্ছে। যারা আকাশের দিকে তাকাতে ভালোবাসে তারা নিশ্চয়ই লক্ষ্য করেছে চাঁদও পূর্ব দিকে ওঠে এবং পশ্চিম দিকে অস্ত যায় এবং সেই একই কারণে। সূর্যের সাথে চাঁদের একটা পার্থক্য আছে, সূর্যের পূর্ণিমা-অমাবস্যা নেই, সেটা সবসময়ই উজ্জ্বল কিন্তু চাঁদের পূর্ণিমা অমাবস্যা আছে, সেটা কখনো উজ্জ্বল থালার মতো কখনো ভাঙা কলসির মতো আবার কখনো কাস্তের মতো (উপমাগুলো আমার নয়–কবিদের!)।
এই ব্যাপারটা ঘটে কারণ চাঁদ সূর্যের মতো স্থির নয়, চাঁদ আসলে পৃথিবীকে ঘিরে ঘুরছে। আমাদের দিনের হিসেবে পৃথিবীকে পুরো এক ভাগ ঘুরে আসতে চাঁদের সময় লাগে 29.5 দিন। কেউ যদি ব্যাপারটা মেনে নেয় তাহলেই সে বুঝতে পারবে কেন চাঁদটা বাড়ে-কমে। 29.1 নং ছবিতে পৃথিবীকে ঘিরে চাঁদের কক্ষপথকে দেখানো হয়েছে–(ছবিটি সঠিক স্কেলে আঁকা হয় নি, যদি সঠিক স্কেলে আঁকা হতো তাহলে পৃথিবী থেকে চাঁদের দূরত্ব হতো 60টি পৃথিবীর ব্যাসার্ধের সমান!)। প্রতি 29.5 দিনে একবার করে চাঁদ পৃথিবীকে ঘিরে তার কক্ষপথে যেতে যেতে যখন পৃথিবী আর সূর্যের মাঝখানে এসে হাজির হয় তখন যে অংশটুকু পৃথিবীর দিকে মুখ করে থাকে সেই অংশটি থাকে ছায়া ঢাকা অন্ধকার। আমরা এটাকে বলি অমাবস্যা, তাই (রাতের বেলাও) চাঁদকে আমরা প্রায় দেখতেই পাই না, ছায়া ঢাকা অংশটা পৃথিবীর দিকে মুখ করে আছে, আমরা কেমন করে দেখব? আবার চাঁদ তার কক্ষপথ ধরে যখন পৃথিবীর অন্য পাশে হাজির হয় তখন চাঁদের আলোকিত অংশটা পৃথিবীর দিকে মুখ করে থাকে, আমরা তাই পুরো চাঁদটাকে দেখতে পাই, সেটাকে আমরা বলি পূর্ণিমা। পূর্ণিমার নরম আলো দেখে আমরা সবাই কখনো না কখনো মুগ্ধ হয়েছি এবং আমি নিশ্চিত অনেকেই মনে করে চাঁদের শরীর থেকে সূর্যের আলো বেশ ভালোই প্রতিফলিত হয়–মজার কথা হচ্ছে ব্যাপারটা মোটেও সত্যি নয়। চাঁদের প্রতিফলন ক্ষমতা খুবই কম, এটা একটা কয়লার মতো, সূর্যের আলোর মাত্র 7% প্রতিফলিত করতে পারে! চাঁদ যদি কয়লার মতো কালো না হয়ে আরেকটু উজ্জ্বল হতো, তাহলে পূর্ণিমার আলোতেই আমাদের চোখ ধাঁধিয়ে যেতে পারত।
যারা এই লেখাটি একটু মনোযোগ দিয়ে পড়ছে নিশ্চিতভাবেই তাদের মনের ভেতর দুটো প্রশ্ন দানা বেঁধেছে। সেটি হচ্ছে অমাবস্যার সময় সত্যি সত্যি যদি 29.1 নং ছবির মতো চাঁদটা পৃথিবীর আর সূর্যের মাঝখানে থাকে তাহলে চাঁদ নিশ্চয়ই সূর্যের আলোটাকে আটকে দেবে এবং ঠিক একই কারণে পূর্ণিমার সময় নিশ্চয়ই পৃথিবীটাই সূর্যের আলোটাকে আটকে দিয়ে চাঁদটাকে অন্ধকার করে ফেলবে। কথা বলতে কী আসলেই এই ব্যাপারগুলো ঘটে এবং এই প্রক্রিয়া দুটোর নাম হচ্ছে সূর্যগ্রহণ এবং চন্দ্রগ্রহণ। যারা সূর্যগ্রহণ-চন্দ্রগ্রহণ লক্ষ করে থাকে তারা সবাই জানে সূর্যগ্রহণ হয় অমাবস্যায় এবং চন্দ্রগ্রহণ হয় পূর্ণিমায় ।