সৌরশক্তির পরই যেটি খুব দ্রুত গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে ফেলছে সেটা হচ্ছে বায়ুশক্তি। আমাদের দেশে আমরা এখনো বায়ু বিদ্যুতের বিশাল টারবাইন দেখে অভ্যস্ত নই কিন্তু ইউরোপের অনেক দেশেই সেটা খুব পরিচিত একটা দৃশ্য। যেখানে এটা বসানো হয় সেখান থেকে শুধু একটা খাম্বা উপরে উঠে যায়, তাই মোটেও জায়গা নষ্ট হয় না সে জন্যে পরিবেশবাদীরা এটা খুব পছন্দ করেন। বিস্তীর্ণ মাঠ বা সমুদ্রোপকূলে বিশাল টারবাইনের পাখাগুলো মন্থর ভঙ্গিতে ঘোরায় দৃশ্যটি বেশ সুন্দর! আজকাল একটা বায়ু টারবাইন থেকে কয়েক মেগাওয়াট বিদ্যুৎ পর্যন্ত পাওয়া সম্ভব! আমাদের দেশের সমুদ্রোপকূলেও বায়ুশক্তি ব্যবহার করে বিদ্যুৎ কেন্দ্র তৈরি করার পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে–খানিক দূর এগিয়ে সেটা কেন জানি থমকে আছে!
পৃথিবীর মানুষ বহুদিন থেকে পান করার জন্যে এলকোহল তৈরি করে আসছে–সেটা এক ধরনের জ্বালানি। ভুট্টা, আখ এ ধরনের খাবার থেকে জ্বালানির জন্যে এলকোহল তৈরি করা মোটামুটি একটা গ্রহণযোগ্য পদ্ধতি। রান্না করার জন্যে আমরা যে তেল ব্যবহার করি সেটা ডিজেলের পরিবর্তে ব্যবহার করা যায়। পৃথিবীতে অনেক ধরনের গাছপালা আছে যেখান থেকে সরাসরি জ্বালানি তেল পাওয়া যায়। পৃথিবীর অনেক দেশেই এটা নিয়ে গবেষণা হচ্ছে, অনেক দেশই (যেমন ব্রাজিল) এ ধরনের বায়োফুয়েল বেশ বড় আকারে ব্যবহার করতে শুরু করেছে। তবে পৃথিবীর অনেক মানুষ এখনো অভুক্ত, তারা যে খাবারটি খেয়ে বেঁচে থাকতে পারত সেটা ব্যবহার করে বিলাসী গাড়ি চালানোর জন্যে জ্বালানি তেল ব্যবহার করার মাঝে এক ধরনের নিষ্ঠুরতা আছে সেটা কেউ অস্বীকার করতে পারবে না।
নবায়নযোগ্য শক্তির গুরুত্বপূর্ণ আরেকটি হচ্ছে জিওথার্মাল (geothermal)। আমাদের পৃথিবীর ভেতরের অংশ উত্তপ্ত, আগ্নেয়গিরি দিয়ে যখন সেটা বের হয়ে আসে তখন আমরা সেটা টের পাই। তাই কেউ যদি কয়েক কিলোমিটার গর্ত করে যেতে পারে তাহলেই তাপশক্তির একটা বিশাল উৎস পেয়ে যায়। প্রক্রিয়াটা এখনো সহজ নয় তাই ব্যাপকভাবে ব্যবহার শুরু হয় নি। কোনো কোনো জায়গায় তার ভূ-প্রকৃতির কারণে সেখানে এ ধরনের শক্তি সহজেই পাওয়া যায় সেখানে সেগুলো ব্যবহার শুরু হয়েছে। আইসল্যান্ড খুব ঠাণ্ডা একটি দেশ তারা তাদের প্রায় সব মানুষকেই শীতের সময় এই পদ্ধতি থেকে তাপ নিয়ে উষ্ণ রাখে। শুধু তাই নয়, তারা প্রায় কয়েকশ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ তৈরি করতে পারে।
সারা পৃথিবীতেই এখন মানুষেরা পরিবেশ নিয়ে সচেতন হয়ে উঠছে। উন্নতির জন্যে দরকার শক্তি, কিন্তু শক্তির জন্যে যদি পরিবেশকে ধ্বংস করে দেয়া হয় আধুনিক পৃথিবীর মানুষ কিন্তু সেটা মেনে নেয় না। সে কারণে আমরা সারা পৃথিবীতেই একটা পরিবর্তনের সূচনা দেখতে পাচ্ছি। পৃথিবীর মানুষ এখন যে কোনো শক্তি যে কোনোভাবে ব্যবহার করতে প্রস্তুত নয়। আমাদের এই অত্যন্ত কোমল পৃথিবীটার সর্বনাশ না করে, প্রকৃতির সাথে বিরোধ না করে আমরা তার মাঝে লুকানো শক্তিটুকু ব্যবহার করতে চাই।
বর্তমান পৃথিবী সেদিকেই এগিয়ে যাচ্ছে–অন্তত এগিয়ে যাবে, সেটাই আমাদের প্রত্যাশা।
২৮. প্লুটো কেন গ্রহ নয়
অন্য যে কোনো গ্রহ থেকে প্লুটোর জীবন কাহিনী বেশি চমকপ্রদ। ঊনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে ইউরেনাস এবং নেপুচন গ্রহের গতিপথে খানিকটা অস্বাভাবিকতা লক্ষ্য করে জ্যোতির্বিদরা ধারণা করলেন সৌরজগতের আরো বাইরের কোনো গ্রহের আকর্ষণে এই ব্যাপারটা ঘটছে। তারা সবাই মিলে এই গ্রহটার নাম দিলেন প্ল্যানেট এক্স বা এক্স গ্রহ এবং সেটাকে খুঁজতে শুরু করলেন। 1915 সালে একবার এবং 1919 সালে আরেকবার প্লুটোর ছবি তোলা হয়েছিল কিন্তু কেউ সেটাকে গুরুত্ব দেয় নি কারণ সেটা ছিল খুবই ছোট আর অনুজ্জ্বল। ইউরেনাস আর নেপচুনের গতিপথ পাল্টাতে পারে এরকম একটা গ্রহ হিসেবে মনে মনে সবাই আরো বড় কিছু খোঁজ করছিল।
কিছু খুঁজে না পেয়ে জ্যোতির্বিদরা মাঝখানে উৎসাহ হারিয়ে ফেললেন। যিনি প্রথমে সেই উদ্যোগ নিয়েছিলেন, পারসিভেল লোভেল মারা গেলেন 1916 সালে। ধীরে ধীরে কেমন জানি উৎসাহে ভাটা পড়তে শুরু করল।
1929 সালে আরিজনার লোভেল অবজারভেটরিতে আবার নূতন করে রহস্যময় প্ল্যানেট এক্স খোঁজা শুরু হলো। 16 ইঞ্চি। একটা টেলিস্কোপ আর ক্যামেরা নিয়ে আকাশের ছবি তোলা শুরু করা হলো, দায়িত্ব দেয়া হলো একজন কমবয়সী শখের জ্যোতির্বিদ ক্লাইড টমবোকে।
ক্লাইড টমবো-এর জীবনটা প্লুটোর জীবনীর মতোই চমকপ্রদ। খুব ছেলেবেলা থেকেই তার শখ গ্রহ-নক্ষত্রে। চাচার একটা ছোট টেলিস্কোপ দিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকতেন। একটু বড় হয়ে নিজেই আট ইঞ্চি রিফ্লেক্টর দিয়ে একটা টেলিস্কোপ বানিয়ে ফেললেন, প্রথম টেলিস্কোপটা খুব সূক্ষ্ম না হলেও ক্লাইড টমবো-এর টেলিস্কোপ তৈরি করার শখ সেটা দিয়েই শুরু। তার সারা জীবনে তিনি প্রায় চল্লিশটা টেলিস্কোপ তৈরি করেছিলেন।
1928 সালে স্লাইড টমবো 9 ইঞ্চি রিফ্লেক্টর দিয়ে খুব চমৎকার টেলিস্কোপ তৈরি করেন। সেই বছরেই তার ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হয়ে এস্ট্রোনমি পড়ার কথা। তিনি উৎসাহে টগবগ করছেন ঠিক তখন প্রচণ্ড শিলাবৃষ্টিতে তাদের পরিবারের সকল ফসল ধ্বংস হয়ে গেল। ভয়ঙ্কর আর্থিক দুরবস্থা। ক্লাইড টমবো-এর তখন আর বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে পড়াশোনা করার সামর্থ্য নেই। হতাশা বুকে চেপে রেখে তিনি পরিবারের চাষ আবাদের কাজে মন দিলেন, মনের দুঃখ মনে চেপে রেখে তিনি রাতের বেলা তার টেলিস্কোপ দিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকেন। বৃহস্পতি আর মঙ্গল গ্রহ দেখে দেখে তিনি খুর সূক্ষ্মভাবে তাদের ছবি এঁকে একদিন সেটা লোভেল অবজারভেটরিতে পাঠিয়ে দিলেন। সেই ছবি দেখে মুগ্ধ হয়ে অবজারভেটরি তখন তাকে একটা চাকরি দিল, তাদের হাতে টাকা-পয়সা ছিল কম, সত্যিকার জ্যোতির্বিদকে বেতন দিয়ে রাখার ক্ষমতা নেই তবে এই শখের কমবয়সী জ্যোতির্বিদকে কম বেতনে রাখা যায়।