ঘূর্ণিঝড় তৈরি হয় সমুদ্রে, তাই সেটা যখন উপকূলে আঘাত হানে তখন সাথে নিয়ে আসে জলোচ্ছাস। সেই বিশাল জলোচ্ছাসে তলিয়ে যায় উপকূলের বিস্তৃত এলাকা! আমরা জানি আমাদের দেশে সেই জলোচ্ছাসের আকার হয় বিশ থেকে ত্রিশ মিটার–কার সাধ্যি আছে সেই বিশাল জলরাশিকে আটকে রাখার?
ঘূর্ণিঝড় হচ্ছে প্রকৃতির একটা ইঞ্জিন, তাপশক্তির ইঞ্জিন। সমুদ্রের পানি থেকে তাপ নিয়ে সেই ইঞ্জিন বাতাসে ঘূর্ণিঝড় তৈরি করে। যদি কোনোভাবে সেই তাপ নেয়ার প্রক্রিয়াটা বন্ধ করে দেয়া যায় তাহলেই এই বিশাল ইঞ্জিন বন্ধ হয়ে যাবে। আসলেও সেটা হয় যখন ঘূর্ণিঝড়টি স্থলভূমিতে উপস্থিত হয়। তখন নিচে সমুদ্রের উষ্ণ পানি নেই, সেই পানি থেকে জলীয়বাষ্প হিসেবে উপরে তাপ পাঠানোর কোনো উপায় নেই। তাই আমরা দেখতে পাই স্থলভূমিতে আসার পর ঘূর্ণিঝড় দেখতে দেখতে দুর্বল হয়ে যায়–সাধারণ ঝড় বৃষ্টিতে পাল্টে গিয়ে সেটা শেষ হয়ে যায়।
আগে ঘূর্ণিঝড়ের নাম ছিল না, ইদানীং তাদের নাম দেয়া শুরু হয়েছে। প্রথমে ঘূর্ণিঝড়ের নাম হতো মেয়েদের নামে। খুব সঙ্গত কারণেই মেয়েরা আপত্তি করল, প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড়ের নাম কেন মেয়েদের নামে হবে? এখন নামকরণের পদ্ধতি পরিবর্তন করা হয়েছে–একটা ছেলের নাম এরপর একটা মেয়ের নাম। এক এলাকায় যেসব দেশে ঘূর্ণিঝড় আঘাত করে সেই সব দেশ নামগুলো দেয়। বাংলাদেশের দেয়া নামগুলোর মাঝে আছে অনিল, অগ্নি, নিশা, গিরি বা চপলার মতো নাম। কিছুদিন আগে বাংলাদেশে আঘাত হানা ঘূর্ণিঝড় সিডর” নামটি ছিল ওমানের দেয়া, তার পরের নাম নার্গিস’ নামটি পাকিস্তানের।
আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি যেসব নাম মানুষের নাম হিসেবে প্রচলিত সেই নামগুলো ঘূর্ণিঝড়ের জন্যে ব্যবহার করা ঠিক নয়। সেই নামে কোনো মানুষ থাকলে সে আহত হয় এবং একটা ভয়ঙ্কর ঘূর্ণিঝড়ের পর সেই নামটি পৃথিবী থেকে মুছে যায়। ক্যাটারিনা খুব সুন্দর একটা নাম কিন্তু 2005 সালে আমেরিকার ইতিহাসে সবচেয়ে বড় সম্পদ ধ্বংসকারী (100 বিলিয়ন ডলার) ঘূর্ণিঝড় হওয়ার পর সেই দেশে কেউ তার কন্যা সন্তানের নাম ক্যাটারিনা রাখে না।
ঘূর্ণিঝড়ের মূল বিষয়টা বিজ্ঞানীরা বুঝতে পারেন বলে সেটাকে থামানোর জন্যে কিছু যে চেষ্টা করা হয় নি তা নয়। আকাশে সিলভার আয়োডাইড ছড়িয়ে পানিকে শীতল করে দিয়ে ঘূর্ণিঝড়কে দুর্বল করার চেষ্টা হয়েছে। ঠিক যেখান থেকে উষ্ণ পানির তাপ আকাশে উঠে যায় সেখানে বরফের চাই (হিম শৈল) টেনে আনার চেষ্টা করা হয়েছে–এমন কী নিউক্লিয়ার বোমা ফাটিয়ে ঘূর্ণিঝড়কে ছিন্নভিন্ন করার কথাও যে আলোচিত হয় নি তা নয়! কিন্তু মানুষ পর্যন্ত টের পেয়েছে প্রকৃতির সাথে যুদ্ধ চারটিখানি কথা নয়। প্রকৃতিকে বিরক্ত না করে তার সাথে তাল মিলিয়ে বেঁচে থাকাই হচ্ছে সবচেয়ে বুদ্ধিমানের কাজ!
২৭. শক্তির নবায়ন
পৃথিবীর সভ্যতার ইতিহাসকে সহজভাবে বলা যায় শক্তি ব্যবহারের ইতিহাস–এখানে শক্তি শব্দটা কিন্তু সাধারণ অর্থে ব্যবহার করা হয় নি, বিজ্ঞানের সুনির্দিষ্ট অর্থে ব্যবহার করা হয়েছে। এখানে শক্তি বলতে বোঝানো হচ্ছে তাপ কিংবা বিদ্যুতের মতো শক্তিকে, রাজনৈতিক বা সামাজিক শক্তির মতো শক্তিকে নয়। মোটামুটিভাবে বলা যায়, কোনো দেশ কতটা উন্নত সেটা বোঝার একটা সহজ উপায় হচ্ছে মাথাপ্রতি তারা কতটুকু বিদ্যুৎ শক্তি ব্যবহার করে তার একটা হিসেব নেয়া। উদাহরণ দেবার জন্যে বলা যায় আমরা মাথাপিছু যেটুকু বিদ্যুৎ খরচ করি–যুক্তরাষ্ট্র খরচ করে তার থেকে একশগুণ বেশি। কাজেই এটা অনুমান করা কঠিন নয় আমাদের দৈনন্দিন জীবন থেকে তাদের দৈনন্দিন জীবন সম্ভবত, একশগুণ বেশি আরাম আয়েশের।
আমরা আমাদের জীবনে যে কয় ধরনের শক্তি ব্যবহার করি তার মাঝে চট করে যে দুটোর নাম মনে আসে সেগুলো হচ্ছে তাপ আর বিদ্যুৎ। আমরা রান্নাবান্না করার জন্যে তাপ শক্তি ব্যবহার করি। কখনো সেটা আসে গ্যাসের চুলোর আগুনে, কখনো লাকড়ির আগুনে কখনোবা বৈদ্যুতিক হিটারে। জীবনকে আরামদায়ক করার জন্যে যে শক্তিটা ব্যবহার করি সেটা হচ্ছে বিদ্যুৎ শক্তি। লোড শেডিংয়ের কারণে যখন বিদ্যুৎ চলে যায় তখন আমরা এর গুরুত্বটা হাড়ে হাড়ে টের পাই। তখন ঘরে আলো জ্বলে না, ফ্যান ঘুরে না, টেলিভিশন চলে না। সত্যি কথা বলতে কী আমাদের চারপাশে যা কিছু আছে তার সবকিছুই মোটামুটি বিদ্যুৎ দিয়ে চলে। সে জন্যে আমরা বিদ্যুৎকে বৈদ্যুতিক তার দিয়ে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় নিয়ে যাই। যে কয় ধরনের শক্তি আমরা ব্যবহার করি তার মাঝে বিদ্যুৎ সবচেয়ে জনপ্রিয় শক্তি কারণ বিদ্যুৎকে সবচেয়ে সহজে অন্য রূপে পরিবর্তন করা যায়। আমরা লাইট বাল্ব ব্যবহার করে বিদ্যুৎকে আলোতে রূপান্তর করি। হিটার দিয়ে তাপে রূপান্তর করি, ফ্যান দিয়ে যান্ত্রিক শক্তিতে আর স্পিকার দিয়ে শব্দ শক্তিতে। শুধু যে ভিন্ন ভিন্ন রূপে পাল্টে দিতে পারি তা নয়–এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় সেটা খুব সহজে নিয়ে যেতে পারি। প্রয়োজন হলে ব্যাটারির মাঝে আমরা বিদ্যুৎ শক্তিকে জমা করেও রাখতে পারি, যারা মোবাইল ফোন ব্যবহার করেছে তারা সবাই সেটা জানে!