একটা ঘূর্ণিঝড়ের মাঝে অকল্পনীয় পরিমাণ শক্তি সঞ্চিত থাকে। বিজ্ঞানীরা অনুমান করেছেন ঘূর্ণিঝড় যে পরিমাণ তাপশক্তি তৈরি করে (বিলিয়ন মেগাওয়াট) সেটা সারা পৃথিবীতে যে পরিমাণ বিদ্যুৎ ব্যবহার হয় তার একশ গুণ! প্রকৃতি যে পদ্ধতিতে একটা ঘূর্ণিঝড়ের মাঝে এই বিশাল শক্তি সঞ্চয় করে সেটা অত্যন্ত চমকপ্রদ। শক্তিটা আসে সমুদ্রের পানি থেকে। সমুদ্রের পানির তাপমাত্রা যখন ২৬.৫ডিগ্রিতে পৌঁছায় তখন সমুদ্রের পানি থেকে শক্তিটা ঘূর্ণিঝড়ের যেতে পারে। সে জন্যে আমরা কখনো শীতকালে ঘূর্ণিঝড় হতে দেখি না–এটা সবসময়েই হয় গ্রীষ্মের শুরুতে যখন তাপমাত্রা এখানে পৌঁছায় আবার শীতের শুরুতে যখন তাপমাত্রা এখানে নেমে আসে। বাংলাদেশকে উত্তর ভারত মহাসাগর এলাকার মাঝে ফেলা হয়, এই এলাকায় ঘূর্ণিঝড়ের আনুষ্ঠানিক সময় এপ্রিল থেকে ডিসেম্বর। বাংলাদেশের বড় বড় সব ঘূর্ণিঝড় হয়েছে মে মাস কিংবা অক্টোবর-নভেম্বর মাসে।
ঘূর্ণিঝড় তৈরি হওয়ার জন্য প্রথমে নিম্নচাপের সৃষ্টি হতে হয়। “নিম্নচাপ” কথাটার অর্থ হচ্ছে বাতাসের চাপ কমে যাওয়া–সেই চাপ পূরণ করার জন্যে আশেপাশের অঞ্চল থেকে বাতাস সেখানে ছুটে আসতে থাকে। বাথটাব কিংবা বেসিনের পানি ছুটে আসার সময় যেরকম ঘূর্ণন শুরু হয়–এখানেও সেভাবে, বাতাসের একটা ঘূর্ণন শুরু হতে পারে। বাতাসের ঘূর্ণনকে পুরোপুরি তৈরি করতে হলে তার মাঝে শক্তি দিতে হবে এবং এই শক্তি দেয়ার প্রক্রিয়াটি ঠিকভাবে শুরু হলো কী না তার উপরেই নির্ভর করে একটা ঘূর্ণিঝড় জন্ম নেবে কী নেবে না।
যে প্রক্রিয়ায় একটা ঘূর্ণিঝড়ে সমুদ্রের পানি থেকে শক্তি দেয়া হয় সেটা খুব সহজ এবং চমকপ্রদ। গরমের দিনে আমরা যখন খুব ভিড়ের ভেতর থেকে হঠাৎ করে খোলা জায়গায় এসে হাজির হই তখন আমরা এক ঝলক শীতল অনুভব করি। তার কারণ ভিড়ের মাঝে গরমে আমরা ঘেমে যাই, যখন হঠাৎ ফাঁকা জায়গায় যাই বাতাসে সেই ঘাম শুকায়, যার অর্থ ঘামের পানিটুকু বাস্পীভূত হয়। পানি বাষ্পীভূত হওয়ার জন্যে তাপের দরকার, পানি সেই তাপটুকু নেয় শরীর থেকে, তাই শরীরটা শীতল হয়ে যায়।
আমরা যদি বিশ্বাস করে নিই যে পানিকে বাস্পীভূত করা হলে পানিটুকু তাপ নিয়ে নেয় তাহলে তার উল্টোটাও নিশ্চয়ই সত্যি। বাস্পীভূত জলীয়বাষ্প যদি পানির ফোঁটায় পাল্টে যায় তাহলে তাকে তাপ দিতে হবে। ঘূর্ণিঝড় সৃষ্টি হওয়ার সময় ঠিক সেটা ঘটে, সমুদ্রের বাষ্পীভূত পানি উপরে উঠে গিয়ে পানির ফোঁটায় পরিণত হয় তখন সে তাপ দিতে থাকে। সেই তাপ শক্তি তখন বাতাসকে গতিশীল করে তোলে, সেই বাতাস তখন দ্রুত ছুটতে থাকে (শক্তি বেশি তাই গতি বেশি!) বাতাস যখন আরো দ্রুত ঘুরতে থাকে তখন নিচের সমুদ্রের পানি আরো দ্রুত বাস্পীভূত হতে থাকবে–যদি আরো দ্রুত বাস্পীভূত হয় তাহলে সেই বাষ্প উপরে উঠে আরো দ্রুত তাপ ছড়াতে থাকবে–আরো বেশি শক্তি সঞ্চিত হবে ঘূর্ণিঝড়ের মাঝে।
বড় কেটলির মাঝখানে তাপ দিলে গরম পানিটুকু উপরে উঠে যায়, ঠাণ্ডা পানি কেটলির কিনারা দিয়ে নিচে নেমে আবার কেটলির মাঝখানে হার্ট হয়–সেখান থেকে গরম হয়ে আবার উঠে যায়। এভাবে ক্রমাগত একটা পরিবহন হতে থাকে আর তাপটুকু খুব চমৎকারভাবে পানির মাঝে সঞ্চালিত হয়। ঘূর্ণিঝড়েও এরকম তাপের পরিবহনের একটা ব্যাপার ঘটে–সমুদ্রের বাষ্পীভূত পানি তাপটাকে উপরে নিয়ে যায়, উপরে সেটা পানির ফোঁটায় পাল্টে গিয়ে তাপটুকু ছড়িয়ে দেয়। ঘূর্ণিঝড়ের বাইরের অংশ দিয়ে বাতাস আবার নিচে নেমে আসে-ঘূর্ণনের মাঝে দিয়ে মাঝখানে এসে আবার উপরে উঠে যায়। পুরো ব্যাপারটা একটানা ঘটতে থাকে। যতই সেটি ঘটে ততই আরো বেশি ঘটার প্রক্রিয়া শুরু হয়। একটা ব্যাপার যখন সেটা আরো বেশি ঘটাতে শুরু করে তখন সেটাকে বলে “পজিটিভ ফিড ব্যাক” আর এই প্রক্রিয়ায় একটা ঘূর্ণিঝড়ের মাঝে বিশাল একটা শক্তি সঞ্চয় হয়। ঘূর্ণিঝড় তখন তার সেই বিশাল শক্তি নিয়ে অগ্রসর হতে থাকে–পৃথিবীর মানুষ হতবাক হয়ে সেই ঘূর্ণিঝড়ের দিকে তাকিয়ে থাকে।
একটা ঘূর্ণিঝড় যখন পরিপূর্ণভাবে বিকশিত হয় তখন ঠিক তার কেন্দ্রে তৈরি হয় ঘূর্ণিঝড়ের “চোখ” বা eye, সেটি হচ্ছে 30 থেকে 40 km বিস্তৃত একটা এলাকা যেটা আশ্চর্য রকম শান্ত! এই কেন্দ্রকে ঘিরে ঘূর্ণিঝড়ের প্রচণ্ড তুলকালাম ঘটতে থাকে কিন্তু ঠিক মাঝখানে কিছু নেই–এমন কী অনেক সময় সেটা থাকে মেঘমুক্ত, শান্ত। সমুদ্রে মহাসমুদ্রে যখন ঘূর্ণিঝড় ধীরে ধীরে অগ্রসর হয় তখন সেটা মানুষের কোনো ক্ষতি করতে পারে না–সেটা মানুষের ক্ষতি করে যখন সেটা স্থলভূমিতে মানুষের লোকালয়ে হাজির হয়। যারা নিজের চোখে ঘূর্ণিঝড়ের সরাসরি আঘাত দেখেছেন তারা সবাই ঘূর্ণিঝড়ের “চোখ” বা eyeটি দেখেছেন। প্রথমে দেখা যায় বাতাস একদিক থেকে অন্যদিকে প্রচণ্ড বেগে ছুটে যাচ্ছে। ঠিক যখন ঘূর্ণিঝড়ের কেন্দ্রটি হাজির হয় তখন মনে হয় ঝড় থেমে গেছে। আকাশে মেঘ নেই, পরিষ্কার আকাশ। যারা ব্যাপারটা জানে না তারা ঘর থেকে বের হয়ে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাপ করতে শুরু করে। দেখতে দেখতে ঘূর্ণিঝড়ের চোখ এলাকাটাকে অতিক্রম করে আবার প্রচণ্ড বেগে বাতাস বইতে শুরু করে–এবারে সম্পূর্ণ অন্যদিক থেকে–মানুষের বিস্ময়ের সীমা থাকে না!