সূচালো শলাকায় শুধু যে বজ্রপাত হয় তা নয়, এই সূচালো শলাকার ভেতর দিয়ে বিপরীত চার্জ বের হয়ে উপরে মেঘের মাঝে জমে থাকা চার্জকে কমিয়ে দিতে পারে। কাজেই অনেক সময়েই বজ্রপাতের আশঙ্কাটাকেও এই ধাতব শলাকা কমিয়ে আনতে পারে।
বিদ্যুৎ পরিবাহী ধাতব শলাকার ভেতর দিয়ে চার্জকে প্রবাহিত করে মাটির গভীরে নিয়ে যাওয়ার এই ধারণাটা দিয়েছিলেন বেঞ্জামিন ফ্লাংকলিন। একটা উঁচু গির্জার উপরে তার একটা ধাতব শলাকা লাগানোর পরিকল্পনা ছিল, গির্জাটা তৈরি হতে দেরি হচ্ছিল বলে এক মেঘলা দিনে তিনি তার ছেলেকে নিয়ে আকাশে একটা ঘুড়ি ওড়ালেন। ঘুড়ির সুতোয় একটা চাবি লাগিয়ে তিনি অপেক্ষা করতে লাগলেন, এমনিতে ঘুড়ির সুতো বিদ্যুৎ অপরিবাহী তাই আকাশের মেঘ থেকে কোনো বিদ্যুৎ নেমে আসছিল না, কিন্তু বৃষ্টিতে সুতো ভেজা মাত্র বিদ্যুৎ পরিবাহী হয়ে মেঘের মাঝে জমে থাকা বিদ্যুৎ নেমে এলো, সুতোর সাথে বেঁধে রাখা চাবি থেকে বিদ্যুতের স্ফুলিঙ্গ (স্পার্ক) বের হতে থাকে! যে বিষয়টা দেখতে চেয়েছিলেন সেটা সন্দেহাতীতভাবে দেখেছেন সত্যি কিন্তু এই বিপজ্জনক পরীক্ষাটা করতে গিয়ে আরেকটু হলে তিনি নিজে এবং তার ছেলে মারা পড়তে পারতেন!
বজ্রপাতে প্রতি বছরই কিছু মানুষ মারা যায়। মজার কথা হলো বজ্রপাতের শিকার হয়ে শতকরা নব্বই জন মানুষ কিন্তু বেঁচেও যায়। রয় সুলিভান নামে একজন মানুষের সাত সাত বার বজ্রপাত হওয়ার পরও সে বেঁচে ছিল। কেউ যেন তাই বলে বজ্রপাতকে হেলাফেলা করে না নেয়–বজ্রপাতের সময় যে বিপুল পরিমাণ বিদ্যুৎ প্রবাহিত হয় সেটা কিন্তু ছেলেখেলা নয়!
মানুষ সেই আদিকাল থেকে বজ্রপাত দেখে আসছে কিন্তু এখনো যে এটাকে পুরোপুরি বুঝতে পেরেছে তা নয়। আগে বলা হয়েছে মেঘের নিচের অংশে থাকে নেগেটিভ চার্জ, সেটা থেকে বজ্রপাত হয়। কিন্তু উপরের পজিটিভ চার্জটুকু কী করে, সেখান থেকে কী বজ্রপাত হয়ে পারে না? আমরা সবাই মেঘ থেকে মেঘে বজ্রপাত হতে দেখেছি, সেখানে এই পজিটিভ চার্জটুকু ব্যবহার হয় কিন্তু কখনো কখনো এই পজিটিভ চার্জ থেকে সরাসরি বজ্রপাত ঘটে যায়। এই বজ্রপাতগুলো সাধারণ বজ্রপাত থেকে প্রায় দশগুণ বেশি শক্তিশালী, তাই প্রায় দশগুণ বিধ্বংসীকারী। সবচেয়ে যেটা ভয়ের কথা, পৃথিবীর মানুষ এই পজিটিভ বজ্রপাতের খবর পেয়েছে মাত্র বছর ত্রিশেক আগে। আকাশে যে প্লেন উড়ে সেগুলোতে সাধারণ বজ্রপাত থেকে রক্ষা পাবার মতো নিরাপত্তার ব্যবস্থা আছে, কিন্তু পজিটিভ বজ্রপাত থেকে নিরাপত্তার ব্যবস্থা পুরোপুরি নেই!
বজ্রপাতে শুধু যে আলো, শব্দ এবং ধ্বংস হয় তা নয়, এর মাঝে আরো কিছু ব্যাপার ঘটে, যেটা বিজ্ঞানীরা কখনো কল্পনা করেন নি। ধারণা করা হতো শক্তিশালী গামা রে আসে শুধু পৃথিবীর বইরের মহাজগৎ থেকে। মাত্র কিছুদিন হলো বিজ্ঞানীরা দেখেছেন বজ্রপাত থেকেও কোনো একটা বিচিত্র উপায়ে শক্তিশালী গামা রে বের হয়ে আসে!
বিষয়টা বোঝার জন্যে বিজ্ঞানীরা মাঠে নেমেছেন, আমরাও আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করছি সেটা তাদের মুখ থেকে শোনার জন্যে!
২৬. ঘূর্ণিঝড়
ঘূর্ণিঝড়ের সাথে আমাদের নিত্য বসবাস। পৃথিবীর ইতিহাসের সবচেয়ে ভয়ঙ্কর ঘূর্ণিঝড় হিসেবে এখনো 1910 সালের 12 নভেম্বরের ঘূর্ণিঝড়টির কথা বলা হয়–অনুমান করা হয় সে রাতে প্রায় দশ লক্ষ লোক মারা গিয়েছিল। (আমি সেটা দেখেছিলাম–জোছনার এক ধরনের আলো ছিল, তার মাঝে প্রচণ্ড ঝড়ে গাছপালা মাথা কুটছে, এরকম একটা দৃশ্য আমার স্মৃতির মাঝে গেঁথে আছে।) এই ঘূর্ণিঝড়ের সাথে বাংলাদেশের জন্মের একটা সম্পর্ক আছে। তখন এই দেশটা ছিল পাকিস্তানের অংশ, ইয়াহিয়া খান প্রেসিডেন্ট–এরকম ভয়ঙ্কর একটা ঘূর্ণিঝড় হয়েছে জানার পরও এই মানুষটি চীন থেকে ফেরার পথে উপদ্রুত এলাকা দেখতে যায় নি। এই দেশের মানুষ সেদিন বুঝে গিয়েছিল পাকিস্তানের সাথে তাদের থাকা যাবে না। এর পরের নির্বাচনেই বাংলাদেশের মানুষ নূতন রাষ্ট্রের সূচনাটি করে দিয়েছিল।
ঘূর্ণিঝড় সম্ভবত প্রকৃতির চমকপ্রদ কিছু বিষয়গুলোর মাঝে একটি। যখন উপগ্রহ থেকে পৃথিবীর ছবি ভোলা যেত না তখন সেটা এত স্পষ্ট করে মানুষ দেখে নি। এখন উপগ্রহের ছবিতে মানুষ স্পষ্ট দেখতে পায় একটা ঘূর্ণিঝড় জন্ম নিচ্ছে তারপর তার বিশাল ব্যাপ্তি নিয়ে ধীরে ধীরে অগ্রসর হচ্ছে। তার ভেতর সঞ্চিত রয়েছে কী অমিত শক্তি, কার সাধ্যি আছে তার সাথে যুদ্ধ করে। ভূমিকম্পের মতো সেটি গোপনে এসে আঘাত করে না, সে তার উপস্থিতির কথা জানিয়ে ধীরে ধীরে এগিয়ে আসে, মানুষকে তার অদম্য ক্রোধের হাত থেকে রক্ষা পাবার একটা সুযোগ দিয়ে রাখে।
যারা ঘূর্ণিঝড়ের ছবি দেখেছে তারা সবাই জানে এর মাঝে আসলেই একটা ঘূর্ণন আছে। উত্তর গোলার্ধে সেটা হয় ঘড়ির কাঁটার বিপরীতে দক্ষিণ গোলার্ধে সেটা ঘড়ির কাঁটার দিকে। পৃথিবী তার অক্ষে ঘুরপাক খাচ্ছে বলে এটা ঘটে এবং এরকম যে হবে সেটা কেউ ইচ্ছে করলে ঘরে বসেই পরীক্ষা করতে পারবে! বাথটাব বা বেসিনে পানি ভরে হঠাৎ করে নিচের ফুটোটুকু খুলে পানিটাকে চলে যেতে দিলে দেখা যায় সেটা সোজাসুজি না গিয়ে ঘুরপাক খেতে খেতে যাচ্ছে এবং উত্তর গোলার্ধে সেটা সবসময়েই হয় ঘড়ির কাঁটার বিপরীতে! (ঘূর্ণন বোঝানোর জন্যে সবসময়েই বলা হয় ঘড়ির কাঁটার দিকে কিংবা ঘড়ির কাঁটার বিপরীতে। আজকাল ডিজিটাল ঘড়ি এসেছে, কিছুদিন পর যদি শুধু ডিজিটাল ঘড়িই থাকে তাহলে ঘূর্ণনের দিক বোঝাব কেমন করে?) আমি এখনো দক্ষিণ গোলার্ধে যাই নি তাই সেখানে যে ঘূর্ণনটা হয় ঘড়ির কাঁটার দিকে সেটা এখনো পরীক্ষা করে দেখতে পারি নি!