কোথাও যখন এভাবে চার্জকে আলাদা হয়ে যেতে দেখা যায় তখন সেটাকে বলে স্থির বিদ্যুৎ। শীতকালে শুকনো মাথায় চিরুনি দিয়ে চুল আঁচড়ানোর পর আমরা প্রায় সবাই ছোট ছোট কাগজকে সেই চিরুনি দিয়ে আকর্ষণ করিয়েছি। এটা ঘটে চার্জ আলাদা হয়ে চিরুনিতে স্থির বিদ্যুৎ জমা হবার কারণে। আমাদের দেশের বাতাসে জলীয়বাষ্প তুলনামূলকভাবে বেশি, শীতের দেশের বাতাস হয় শুষ্ক, সেখানে স্থির বিদ্যুৎ আরো অনেক বেশি স্পষ্টভাবে দেখা যায়। কার্পেটে হাঁটলে জুতোর সাথে ঘষা খেয়ে শরীরে এত স্থির বিদ্যুৎ জমা হয়ে যেত যে দরজা খোলার সময় দরজার নবের কাছে হাত আনতেই শরীরের স্থির বিদ্যুৎ স্পার্ক হিসেবে দরজার নবে ছুটে যেত! দীর্ঘদিন ওরকম পরিবেশে থাকতে থাকতে নিজের অজান্তেই আমার একটা অভ্যাস হয়ে গিয়েছিল, দরজা খোলার আগে পকেট থেকে চাবি বের করে চাবির মাথাটাকে স্পার্ক হতে দেয়ার জন্যে ব্যবহার করা। স্পার্কটা যেহেতু আঙ্গুল থেকে বের না হয়ে চাবি থেকে বের হতো তাই বৈদ্যুতিক শক খাওয়ার অস্বস্তিকর অনুভূতিটা হতে অনেক কম।
যাই হোক আকাশে যখন মেঘের ভেতর প্রচুর চার্জ জমা হয়ে যায় তখন তার স্বাভাবিক পরিণতি হতে চার্জটুকু কোনোভাবে সরিয়ে দিয়ে একটা স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসে এবং সেটাই হচ্ছে বজ্রপাত। বজ্রপাতের ব্যাপারটা হঠাৎ করে ঘটে না, তার জন্যে একটা প্রস্তুতি হয়, প্রথমে মেঘের ভেতরকার নেগেটিভ চার্জের জন্যে নিচে মাটিতে এক ধরনের পজিটিভ চার্জ জমা হয়। এক সময় মেঘের নিচে থেকে “স্টেপ লিডার” নামে এক ধরনের খুব হালকা আলোকিত আভা সাপের মতো এঁকেবেঁকে নিচে নেমে আসতে থাকে, তখন মাটি থেকেও একই ধরনের একটা আলোকিত আভা উপরের দিকে উঠতে থাকে যেটাকে বলা হয় পজিটিভ স্ট্রিমার। এর ভেতর দিয়ে যে বৈদ্যুতিক কারেন্ট বা প্রবাহ হয় সেটা শ’খানেক এম্পিয়ারের মতো (আমরা আমাদের বাসায় পাঁচ থেকে দশ এম্পিয়ার কারেন্ট ব্যবহার করি) উপর থেকে নেমে আসা স্টেপ লিডার আর নিচে থেকে উপরে ছুটে যাওয়া পজিটিভ স্ট্রিমার যখন একটা আরেকটাকে স্পর্শ করে তখন তুলকালাম কাণ্ড ঘটে যায়। মেঘের ভেতর জমা হয়ে থাকা বিশাল চার্জ তখন আক্ষরিক অর্থে লক্ষ মাইল বেগে নিচে ছুটে আসে। বিদ্যুৎ প্রবাহের পরিমাণ তখন হয়ে যায় প্রায় লক্ষ এম্পিয়ার। এই বিশাল পরিমাণ বিদ্যুৎ যখন বাতাস ভেদ করে নিচে ছুটে আসে তখন বাতাসটা 20 থেকে 30 হাজার ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড পর্যন্ত গরম হয়ে যায়, যেটা সূর্যপৃষ্ঠের তাপমাত্রা থেকে বেশি!
এই প্রচণ্ড তাপমাত্রার কারণে আমরা নীলাভ সাদা আলোর একটা জ্বালানি দেখতে পাই। তাপমাত্রার কারণে আরো একটা ব্যাপার ঘটে, বাতাসটুকু ফুলে-ফেঁপে বাইরের দিকে ছড়িয়ে পড়ে প্রচণ্ড গতিতে এবং তার কারণে গগনবিদারি একটা শব্দ হয় যেটাকে আমরা বজ্রপাতের শব্দ হিসেবে শুনি। যে কোনো শব্দের জন্যে কোনো কিছুকে নড়তে-চড়তে হয়, কাঁপতে হয় যদি সেই নাড়াচাড়া বা কাঁপাটুকু শব্দের গতি থেকে দ্রুতগতিতে হয় তাহলে সেটাকে বলে শক ওয়েভ। বজ্রপাতের শব্দটা আসলে শক ওয়েভ, শক ওয়েভের মাঝে আসলে অনেক শক্তি থাকে, কাছাকাছি কোথাও বজ্রপাত হলে প্রচণ্ড শব্দে ঘরের দরজা-জানালা ভেঙে যাওয়া তাই এত বিচিত্র কিছু না।
বজ্রপাত থেকে আলো আর শব্দ দুটি বের হওয়ার কারণে আমরা সাধারণত একটা মজার জিনিস করতে পারি, বজ্রপাতটা কত দূরে বের হয়েছে সেটা মোটামুটি নিখুঁতভাবে বের করে ফেলতে পারি। আলোর গতি সেকেন্ডে তিন লক্ষ কিলোমিটার, কাজেই বজ্রপাতের আলোর ঝলকানিটা আমরা বলতে গেলে সাথে সাথেই দেখি। বাতাসে শব্দের গতি সেকেন্ডে মাত্র সাড়ে তিনশ মিটার অর্থাৎ এক কিলোমিটার যেতে প্রায় তিন সেকেন্ড সময় লাগে। কাজেই আলোর ঝলকানির কত সেকেন্ড পর শব্দটা শোনা গেছে সেটা দেখে তাকে তিন দিয়ে ভাগ দিলেই বজ্রপাতটা কত কিলোমিটার দূরে হয়েছে মোটামুটি নিখুঁতভাবে বের করে ফেলা যায়। সত্যি কথা বলতে কী সময় মাপার জন্যে ঘড়ি দেখারও প্রয়োজন নেই, “এক হাজার এক” “এক হাজার দুই” এভাবে বলতে এক সেকেন্ড করে সময় লাগে, কাজেই যত সংখ্যা পর্যন্ত গোনা যায় তত সেকেন্ড পার হয়েছে ধরে নেয়া যায়। অন্যদের কথা জানি না, বজ্রপাতে আলোর ঝলকানি দেখলেই আমি নিজের অজান্তে “এক হাজার এক” “এক হাজার দুই” গুনতে শুরু করে দিই।
বজ্রপাতে আমরা সবসময়ই দেখি আলোর ঝলকানিটি কেঁপে কেঁপে ওঠে, ব্যাপারটা এত দ্রুত ঘটে যে আমরা সবসময় চোখে দেখে আলাদা করতে পারি না। ভিডিও ক্যামেরা বা অন্য কিছু দিয়ে আলোর ঝলকানিটুকু ধরে রাখলে দেখা যাবে বজ্রপাতের সময় পুরো ব্যাপারটা সেকেন্ডের একটা ক্ষুদ্র ভগ্নাংশের মাঝেই কয়েকবার ঘটে যেতে পারে।
পৃথিবীতে গড়ে প্রতি সেকেন্ডে 100টা বজ্রপাত হয়–পৃথিবীর কোথাও হয় বেশি কোথাও হয় কম। আকাশের মেঘ থেকে যেহেতু বিদ্যুৎ নিচে নেমে আসে তাই এটা সাধারণত উঁচু জিনিসকে সহজে আঘাত করে। বজ্রপাত থেকে রক্ষা করার জন্যে উঁচু বিল্ডিংয়ের উপর ধাতব একটা সূচালো শলাকা লাগিয়ে রাখা হয়, সেটা মোটা বিদ্যুৎ সুপরিবাহী তার দিয়ে মাটির গভীরে নিয়ে যাওয়া হয়। পেছনের বিজ্ঞানটুকু খুব সহজ, আকাশ থেকে নেমে আসা বিদ্যুৎ অনিয়ন্ত্রিতভাবে না গিয়ে এই মোটা তারের ভেতর দিয়ে মাটির গভীরে চলে যাবে। অর্থাৎ অনিয়ন্ত্রিতভাবে না হয়ে বজ্রপাতটা হবে এই সূচালো শলাকার উপর।