এবারে আমরা স্পেস শাটলের মহাকাশচারীদের ওজনহীন অনুভব করার বিষয়টি ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করতে পারি, কিন্তু সেটা করার আগে আমরা একবার চট করে নিউটনের অভিজ্ঞতাটুকুর কথা বলে নিই। সত্য-মিথ্যা জানা নেই, গল্প প্রচলিত রয়েছে যে একবার নিউটন আপেল গাছের নিচে বসে ছিলেন তখন তার সামনে টুপ করে একটা আপেল এসে পড়ল। প্রচলিত গল্প অনুযায়ী তিনি ভাবতে লাগলেন আপেলটি উপরে উঠে না গিয়ে নিচে কেন পড়ল এবং সেখান থেকেই তিনি মাধ্যাকর্ষণ শক্তির বিষয়টি আবিষ্কার করলেন। তার এই ভাবনার কথা বিশ্বাসযোগ্য নয় বরং যেটা হতে পারে সেটা এরকম : যখন আপেলটি নিচে এসে পড়ল তখন তিনি আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখলেন সেখানে একটি চাঁদ। তিনি ভাবলেন পৃথিবীর মাধ্যাকর্ষণের কারণে আপেলটি টুপ করে নিচে এসে পড়ছে। পৃথিবী তো চাঁদটাকেও টানছে, তাহলে আকাশ থেকে চাঁদটা টুপ করে না হলেও ধপাস করে নিচে এসে পড়ছে না কেন?
আসলে এটা অত্যন্ত যুক্তিসঙ্গত প্রশ্ন। পৃথিবী যেভাবে আপেলটাকে নিচে টানছে, চাঁদটাকেও সেভাবে নিচে টানছে। আপেলটা মাটিতে পড়ে যায় কিন্তু চাঁদটা পড়ে যায় না, এর মাঝে রহস্যটা কী?
আসলে এর মাঝে কোনো রহস্য নেই–চাঁদটাও কিন্তু পৃথিবীতে পড়ে যাচ্ছে। আপেল যেরকম মুক্তভাবে পড়ে, চাঁদটাও হুবহু সেভাবে পৃথিবীতে পড়ে যাচ্ছে। আমি জানি সকল পাঠক এবারে ভুরু কুঁচকে বলছেন সেটা যদি পড়েই যাচ্ছে তাহলে আমরা সেটা দেখাত পাচ্ছি না কেন? উত্তরটা খুবই সহজ, আমরা এটা দেখতে পেতাম যদি কেউ চাঁদটাকে থামিয়ে দিতে পারত–চাঁদটা শুধু যে পৃথিবীর দিকে পড়ে যাচ্ছে তা নয় একই সাথে সেটা সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। যদি সেটা না হতো তাহলে আপেলের মতোই চাঁদটা পৃথিবীতে ধপাস করে পড়ত।
ব্যাপারটা বোঝার জন্যে আমরা 23.3 নং ছবিটা দেখতে পারি। ছবির প্রথম অংশে দেখানো হচ্ছে যদি পৃথিবী চাঁদটাকে নিজের দিকে না টানত–অর্থাৎ চাঁদটা যদি শুধু সামনের দিকে এত তাহলে কী হতো। আমরা দেখতে পাচ্ছি তাহলে চাঁদটা ই থেকে ঈতে এসে পৌঁছাত। এর পরের ছবিতে আমরা দেখতে পাচ্ছি যদি চাঁদটার সামনের দিকে কোনো গতি না থাকত (অর্থাৎ চাঁদটাকে থামিয়ে দেয়া যেত) তাহলে কী হতো। আমরা দেখতে পাচ্ছি তাহলে চাঁদটা ঈ থেকে উতে এসে পৌঁছাত। তৃতীয় ছবিটাতে আমরা দেখাচ্ছি যদি চাঁদটা একই সাথে সামনের দিকে অগ্রসর হয় এবং নিচের দিকে নেমে আসে তাহলে কী হতো, আমরা দেখছি সেটা ই থেকে ঈ এবং ঈ থেকে উতে এসে পৌঁছাত! যেটা হচ্ছে পৃথিবীকে ঘিরে একটা গোলাকার কক্ষপথের ক্ষুদ্র একটা অংশ। চাঁদটা আবার একইভাবে সামনে এগিয়ে যেতে যেতে নিচে পড়তে থাকবে এবং সম্মিলিতভাবে বৃত্তাকার কক্ষপথে ঋ বিন্দুতে পৌঁছাবে। অর্থাৎ সেটা বৃত্তাকারে পৃথিবীকে তার কক্ষপথে ঘুরতে থাকবে! স্কুলের পদার্থবিজ্ঞান জানলেই আমরা এক মিনিটের মাঝে হিসেব করে বের করে ফেলতে পারব কোন কক্ষপথে থাকার জন্যে চাঁদকে কত বেগে ঘুরতে হবে ইত্যাদি ইত্যাদি!
কাজেই আমার ধারণা সবাই নিশ্চয়ই অনুমান করতে শুরু করেছে স্পেস শাটলে কেন মহাকাশচারীরা ওজনহীন অবস্থায় ঘুরে বেড়ায়। স্পেস শাটল যখন পৃথিবীকে ঘিরে ঘুরতে থাকে তখন তার অবস্থা ঠিক চাঁদের মতোন, এটা আসলে প্রতি মুহূর্তেই পৃথিবীর আকর্ষণে পৃথিবীর দিকে মুক্তভাবে পড়ে যাচ্ছে। কিন্তু যে সময়টাতে এটা মুক্তভাবে পড়ে যাচ্ছে সেই সময়টাতে এটা আবার সামনে এগিয়ে যাচ্ছে, সে কারণে এটা সত্যি সত্যি নিচে না পড়ে গোলাকার কক্ষপথের নূতন একটা বিন্দুতে হাজির হয়! এভাবে ব্যাপারটা চলতেই থাকে–আমরা দেখতে পাই স্পেস শাটল পৃথিবীকে ঘিরে ঘুরছে। পদার্থবিজ্ঞানের ভাষায় এটা মুক্তভাবে পৃথিবীর দিকে পড়ার চেষ্টা করছে!
আমরা জানি কেউ যখন মুক্তভাবে পৃথিবীতে পড়ার চেষ্টা করে তখন সে ওজন অনুভব করে না। (বিজ্ঞানী স্টিফান হকিংসের সেই ছবিটি সবাই দেখেছে। তিনি ভাসছেন।) স্পেস, শাটলের ভেতরে যে মহাকাশচারীরা থাকেন তারাও সেই জন্যে কোনো ওজন্য অনুভব করেন না–কারণ স্পেস শাটলের সাথে সাথে তারাও আসলে মুক্তভাবেই পড়ছেন!
কাজেই ওজনহীন হবার জন্যে আসলে মহাশূন্যে যেতে হয় না–পৃথিবীর মাটিতেই ওজনহীন হওয়া সম্ভব–তার জন্যে শুধু একটা উঁচু জায়গা থেকে লাফ দিয়ে মুক্তভাবে পড়তে হয়–আর কিছু নয়!
২৪. পৃথিবীর তাপমাত্রা : পৃথিবীর দুঃখ
গত ফেব্রুয়ারি মাসে জাতিসংঘের পক্ষ থেকে ঘোষণা করা হয়েছে যে পৃথিবীর তাপমাত্রা বেড়ে যাচ্ছে এবং দৃঢ়ভাবে সন্দেহ করা হয়েছে যে এর জন্যে দায়ী হচ্ছে পৃথিবীর মানুষ। মানুষ জ্বালানি পুড়িয়ে বাতাসে কার্বন-ডাই-অক্সাইডের পরিমাণ বাড়িয়ে দিয়েছে, এই কার্বন-ডাই অক্সাইড অনেকটা গ্রীন হাউস বা কাচ ঘরের মতো–এর ভেতর থেকে তাপ বের হতে পারে না। তাই স্বাভাবিকভাবে পৃথিবী যে তাপটুকু বিকীরণ করে ছড়িয়ে দিতে পারত সেটা আর সেভাবে করতে পারছে না, সে কারণেই পৃথিবীর তাপমাত্রা বেড়ে যাচ্ছে।
পৃথিবীর কার্বন-ডাই অক্সাইডের চার ভাগের এক ভাগই আসে মাত্র একটি দেশ থেকে, সে দেশটি হচ্ছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। মজার ব্যাপার হলো সে দেশের পরিবেশ সংক্রান্ত সিনেট কমিটির সভাপতি কিন্তু পৃথিবীর তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়া ব্যাপারটাই বিশ্বাস করতেন না, তার মতে এটা হচ্ছে, “মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মানুষের কাছে করা একটা বিশাল ধাপ্পাবাজি।” সবচেয়ে দুঃখের কথা হচ্ছে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশের বিলাসী জীবনযাপনের মূল্য দিতে হয় কিন্তু বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশের সাধারণ মানুষের। আমরা লক্ষ করেছি কী না জানি না পৃথিবীর তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়ার বিপদটা আমরা সম্ভবত টের পেতে শুরু করেছি। বাড়তি তাপমাত্রার কারণে মেরু অঞ্চলের বরফ গলে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বেড়ে গিয়েছে, এই দেশে তার সরাসরি প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। এ দেশের মানুষ বন্যার সাথে জীবনযাপন করতে অভ্যস্ত কিন্তু এখন শুধু বন্যা নয় শুরু হয়েছে জলাবদ্ধতা। আগে হয়তো বিশ বছরে একটা প্রলয়ঙ্কর বন্যা আসত এখন প্রতি চার-পাঁচ বছরে একটা প্রলয়ঙ্কর বন্যা আসে–সেই বন্যার পানিও আর সহজে নামতে চায় না!