এবারে মনে হয় একটা বিষয় নিয়ে সময় একটু সতর্ক করে দেয়া ভালো, একটু আগে বলেছি আমাদের চারপাশে যা কিছু দেখি তার সবকিছুই তৈরি হয়েছে ইলেকট্রন, প্রোটন আর নিউট্রন দিয়ে কিন্তু আমরা যা কিছু দেখি শুধুমাত্র সেগুলো দিয়েই যে আমাদের জগৎ সেটি সত্যি নয়–অনেক কিছুই আছে যেগুলো আমরা আমাদের দৈনন্দিন জগতে দেখি না, কিন্তু সেগুলো খুব ভালোভাবে আছে, বিজ্ঞানীরা নানাভাবে সেগুলো খুঁজে বের করেছেন। এখন পর্যন্ত যে থিওরিটি সবচেয়ে ভালোভাবে কাজ করেছে সেটা অনুযায়ী আমাদের এই সৃষ্টি জগৎ বারোটি কণা (Particle এবং তাদের প্রতি কণা (anti-Particle) দিয়ে তৈরি (22.1 নং ছবি)। যারা পদার্থবিজ্ঞান নিয়ে পড়াশোনা করে না আমি আশা করি না তারা এই কণাগুলোর নাম মনে রাখার চেষ্টা করবে কিংবা তার গভীরে যাবার চেষ্টা করবে। বারোটি কণার দিকে একঝলক চোখ বুলিয়ে গেলেই যথেষ্ট। যারা একটু খুঁতখুঁতে তারা হয়তো ভুরু কুঁচকে বলবে, বলা হয়েছিল আমরা যা কিছু দেখি তার সবই ইলেকট্রন, প্রোটন আর নিউট্রন দিয়ে তৈরি। তালিকায় অনেক কষ্টে ইলেকট্রনকে খুঁজে পাওয়া গেল (লেপটনের নিচের সারিতে বাম দিকে) কিন্তু নিউট্রন, প্রোটন কোথায়? নিউট্রন, প্রোটন এখানে নেই কারণ এই তালিকায় শুধু মৌলিক কণাগুলো দেয়া হয়েছে–নিউট্রন, প্রোটন মৌলিক কণা নয়, সেগুলো তৈরি কোয়ার্ক দিয়ে। যেমন নিউট্রন তৈরি হয় একটি আপ কোয়ার্ক এবং দুটি ডাউন কোয়ার্ক দিয়ে (udd) ঠিক সে রকম প্রোটন তৈরি হয় দুটি আপ কোয়ার্ক আর একটি ডাউন কোয়ার্ক দিয়ে (udd)। কাজেই আমরা এবারে আরো সঠিকভাবে বলতে পারি আমাদের দৃশ্যমান জগৎ তৈরি হয়েছে তিনটি মৌলিক কণা দিয়ে, ইলেকট্রন, আপ কোয়ার্ক এবং ডাউন কোয়ার্ক দিয়ে!
যাই হোক, 22.1 নং ছবির বারোটি কণা এবং তাদের প্রতি-কণা দিয়ে সৃষ্টি জগতের সকল পদার্থ এবং প্রতি-পদার্থের একটা খুবই বড় বিশেষত্ব হচ্ছে যখন একই ধরনের পদার্থ এবং প্রতি-পদার্থ একে-অপরের সংস্পর্শে আসে সাথে সাথে একটা আরেকটাকে ধ্বংস করে শক্তিতে রূপান্তরিত হয়ে যায়। সেই শক্তির পরিমাণ কত হবে সেটা আইনস্টাইনের বিখ্যাত E= mc^2 সূত্র দিয়ে খুব সহজেই বের করা যায়। এটি কোনো কল্পকাহিনী নয়, আমাদের চারপাশে সবসময়ই সেটা ঘটছে।
সৃষ্টি জগৎ যেহেতু বারোটি মৌলিক কণা এবং তাদের প্রতি কণা দিয়ে তৈরি হয়েছে কাজেই আমরা ধরে নিতে পারি এই জগতে আমরা যে রকম পদার্থ দেখতে পাব ঠিক সে রকম প্রতি-পদার্থও দেখতে পাব। কিন্তু এখানে একটি বড় রহস্য এখানে উন্মোচিত হয় নি। কোনো একটি অজ্ঞাত কারণে আমাদের দৃশ্যমান সৃষ্টি জগৎ পুরোটাই তৈরি হয়েছে পদার্থ দিয়ে, এখানে কোনো প্রতি-পদার্থ নেই। এটা গোপনে কোথাও রয়ে গেছে, আমরা দেখতে পাচ্ছি না, তার কোনো সম্ভাবনা নেই, কারণ পদার্থ প্রতি-পদার্থ একে-অপরের সংস্পর্শে এলেই দুটোই ধ্বংস হয়ে শক্তিতে রূপান্তরিত হয়ে যাবে। কাজেই এটা কোনোভাবেই বিজ্ঞানীদের চোখকে ফাঁকি দিতে পারবে না।
এই সৃষ্টি জগৎ তৈরি হয়েছিল বিগ ব্যাং (Big Bang)-এর ভেতর দিয়ে, সেই বিগ ব্যাংয়ের পর সৃষ্টি জগতে কিন্তু সমান পরিমাণ পদার্থ এবং প্রতি-পদার্থ তৈরি হওয়ার কথা, সেই সমান পরিমাণ পদার্থ এবং প্রতি-পদার্থ একে-অপরকে ধ্বংস করে সৃষ্টি জগতে শুধু শক্তি থাকার কথা। এই গ্রহ-নক্ষত্র, গ্যালাক্সি কিছুই থাকার কথা নয়, থাকার কথা শুধু শক্তির–কিন্তু আমরা খুব ভালো করে জানি বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে পদার্থ রয়ে গেছে, গ্রহ-নক্ষত্র, গ্যালাক্সি রয়ে গেছে। কোনো একটি অজ্ঞাত কারণে প্রতি-পদার্থ পদার্থের কাছে হেরে গেছে এবং সৃষ্টি জগতের সকল প্রতি-পদার্থকে ধ্বংস করার পরও বাড়তি পদার্থ রয়ে গেছে যেটা দিয়ে আমাদের এই দৃশ্যমান জগৎ তৈরি হয়েছে। কিন্তু বিজ্ঞানীরা এখনো সঠিকভাবে জানেন না ঠিক কীভাবে ব্যাপারটা ঘটেছে। (CP Violation নামে কিছু ধারণা দিয়ে এটাকে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করা হয় কিন্তু সেটা এখনো পুরোপুরি ব্যাখ্যা করতে পারে নি।)
পৃথিবীর সবাই ইতোমধ্যে নিশ্চয়ই LHC (Large Hadron Collider)-এর নাম শুনে গেছে। প্রায় পঞ্চাশ হাজার কোটি টাকা খরচ করে ফ্রান্স ও সুইজারল্যান্ডের। সীমানায় এটা তৈরি করা হয়েছে। বৃত্তাকার এই এক্সেলেরেটরের পরিসীমা 27 কিলোমিটার। আমরা জানি যার ভর আছে তার গতিবেগ কখনো আলোর বেগের সমান হতে পারে না, বড় জোর তার কাছাকাছি হতে পারে। এই এক্সেলেটরে প্রোটিনের গতিবেগ আলোর গতিবেগের 99.999999 (আটটা নয় পাশাপাশি!) শতাংশ। এটি মোটামুটিভাবে একটি অচিন্তনীয় ব্যাপার।
এল. এইচ. সি. পদার্থবিজ্ঞানের অনেকগুলো গুরুত্বপূর্ণ অমীমাংসিত বিষয়ের উত্তর খুঁজে বের করার চেষ্টা করবে এবং পৃথিবীর পুরো বিজ্ঞানী সমাজ তার জন্যে অধীর আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করছে। বিগ ব্যাংয়ের পর . কেমন করে পদার্থের পরিমাণ প্রতি-পদার্থ থেকে বেড়ে গেছে সেই প্রশ্নের উত্তরটিও এল, এইচ. সি. খুঁজে বের করার চেষ্টা করবে।
এবারে পদার্থ এবং প্রতি-পদার্থের একটা অভূতপূর্ব বিশেষত্বের কথা বলে শেষ করা যাক। 22.3 নং ছবিতে দেখানো হয়েছে A এবং B বিন্দু থেকে যথাক্রমে একটি ইলেকট্রন এবং তার প্রতি-পদার্থ পজিট্রন রওনা দিয়ে C বিন্দুতে একে-অপরকে আঘাত করে শক্তিতে রূপান্তরিত হয়েছে। এই বিষয়টাকে আসলে সম্পূর্ণ অন্যভাবে বলা যায়। আমরা বলতে পারি A বিন্দু থেকে একটা ইলেকট্রন রওনা দিয়ে দিয়ে C বিন্দুতে এসে সময়ের উল্টো দিকে যাত্রা শুরু করে অতীতে B বিন্দুতে এসে হাজির হয়েছে! পদার্থবিজ্ঞানের চোখে দুটি হুবহু একই ব্যাপার।