বোমা নিয়ে কথা বলার সময় শুধু ইউরেনিয়াম 235-এর কথা বলা হয়েছে কিন্তু শুধু যে ইউরেনিয়াম 235 দিয়ে বোমা তৈরি করা যায় তা নয়, প্লুটোনিয়াম 239 দিয়েও বোমা তৈরি করা যায়। জাপানের উপর ফেলা দ্বিতীয় বোমাটি ছিল প্লুটোনিয়াম 239 দিয়ে তৈরি, লুইস টিনের যে ঘটনাটি ঘটেছিল সেটাও ঘটেছিল প্লুটোনিয়াম 239 দিয়ে।
ম্যানহাটান প্রজেক্টের দ্বিতীয় বোমাটি তৈরি করার সময় বিজ্ঞানীরা আবিষ্কার করেছিলেন সেটি দুটি অংশকে একত্র করে বিস্ফোরিত করা যাবে না। তার জন্যে দরকার একটা বড় গোলককে চাপ দিয়ে ছোট করে সুপার ক্রিটিক্যাল করে–চারপাশে বিস্ফোরক রেখে একই মুহূর্তে বিস্ফোরণ ঘটিয়ে একত্র করে এটাকে বিস্ফোরণ করা হয় (21.3 নং ছবি।)
ম্যানহাটান প্রজেক্টের বিজ্ঞানীরা জাপানের হিরোশিমা ও নাগাসাকিতে দুটো বোমা ফেলার আগে একটি বোমা তৈরি করেছিলেন পরীক্ষা করার জন্যে। 1945 সালের 16 জুলাই সেটা নিউ মেক্সিকোর একটা মরুভূমিতে বিস্ফোরিত করা হয়েছিল। সেই বিস্ফোরণটি দেখে সকল বিজ্ঞানীরা একেবারে স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিলেন। তারা আতংকিত হয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সরকারকে অনুরোধ করেছিলেন সেটি যেন কখনোই কোনো মানুষের উপর ব্যবহার করা না হয়। যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক বাহিনী সেই অনুরোধ রক্ষা করে নি, তারা সেটা ব্যবহার করেছিল। একবার নয়–দুই বার।
ম্যানহাটান প্রজেক্টের দায়িত্বে ছিলেন রবার্ট ওপেনহাইমার নামে একজন বড় বিজ্ঞানী। নিউ মেক্সিকোর মরুভূমিতে নিউক্লিয়ার বোমার বিস্ফোরণ দেখে তিনি গীতা থেকে একটা শ্লোক আওড়ে বলেছিলেন, এখন আমি হচ্ছি পৃথিবীর ধ্বংসকারী–আমিই হচ্ছি মৃত্যু।
মানুষ নিজেই যখন নিজের মৃত্যু হয়ে দাঁড়ায় তাদের রক্ষা করা কী খুব সহজ কথা?
২২. রহস্যময় প্রতি-পদার্থ
পল ডিরাককে নিয়ে একটা মজার গল্প প্রচলিত আছে। একবার তাকে একটা গণিতের সমস্যা দেয়া হলো, সমস্যাটা এরকম : তিনজন জেলে সমুদ্রে মাছ ধরতে গিয়েছে, মাছ ধরে যখন বাড়ি ফিরে যাবে তখন সমুদ্রে ঝড় ওঠে। জেলে তিনজন তখন রাত কাটানোর জন্যে একটা দ্বীপে আশ্রয় নিয়ে ঘুমিয়ে গেল। গভীর রাতে একজন জেলের ঘুম ভেঙে গেল, তখন ঝড় থেমে গেছে। সে ভাবল অন্য জেলেদের বিরক্ত না করে সে তার ভাগের মাছ নিয়ে বাড়ি চলে যাবে। মাছগুলো তিন ভাগে ভাগ করার পর সে দেখে একটা মাছ বাড়তি রয়ে গেছে। সে বাড়তি মাছটাকে সমুদ্রে ফেলে দিয়ে নিজের এক ভাগ নিয়ে বাড়ি চলে গেল। কিছুক্ষণ পর আরেকজন জেলে ঘুম থেকে উঠেছে, ঝড় থেমে গেছে তাই সেও ভাবল সে তার ভাগের মাছ নিয়ে চলে যাবে। তাই যে মাছগুলো রয়ে গেছে সে সেগুলোকে তিন ভাগ করে দেখে একটা মাছ বেশি। বাড়তি মাছটা সমুদ্রে ফেলে দিয়ে সে তার নিজের ভাগ নিয়ে চলে গেল। শেষ জেলেও এক সময় ঘুম থেকে উঠেছে, সেও দেখে উঠেছে ঝড় থেমে গেছে। কাজেই ও ঠিক করল নিজের ভাগের মাছ নিয়ে সে চলে যাবে। রয়ে যাওয়া মাছগুলোকে তিন ভাগ করে দেখে একটা মাছ বেশি। সেও বাকি মাছ সমুদ্রের পানিতে ফেলে দিয়ে নিজের ভাগটুকু নিয়ে চলে গেল। এটুকু হচ্ছে গণিতের সমস্যাটার বর্ণনা–এখন প্রশ্ন হচ্ছে সবচেয়ে কম কতগুলো মাছ হলে তিনজন জেলে এইভাবে মাছ ভাগ করে নিতে পারবে?
সমস্যাটা এমন কিছু কঠিন নয় যে কেউ একটু মাথা ঘামালে এর উত্তরটা বের করে ফেলতে পারবে। কথিত আছে পল ডিরাককে যখন এই সমস্যাটা দেয়া হলো তখন তিনি এক মুহূর্তও চিন্তা না করে বললেন, “-2টি (মাইনাস দুই) মাছ!” মাছ কেমন করে ‘মাইনাস’ হয় সেটা পরের ব্যাপার কিন্তু গণিতের দৃষ্টিকোণে এটি খাঁটি একটা সমাধান। প্রথম জেলে 2টি মাছ থেকে + 1টি মাছ পানিতে ফেলে দিল তাই তার হাতে থাকল-3টি মাছ। (-2=3+1) সে তিন ভাগে ভাগ করে তার ভাগ (-1টি মাছ) নিয়ে গেল, বাকি রইল 2টি মাছ! কাজেই পুরো প্রক্রিয়াটা আবার গোড়া থেকে শুরু করা সম্ভব। তিনজন জেলেই এটা করতে পারবে এবং শেষ পর্যন্ত ২টি মাছ রয়ে যাবে।
যিনি গণিতের এই সমস্যাটি দিয়েছিলেন তিনি মোটেও এই উত্তর আশা করেন নি (তিনি আশা করেছিলেন প্রচলিত উত্তরটি–সেটা হচ্ছে 25) কিন্তু আমরা এখন অনুমান করতে পারি কেমন করে পল ডিরাকের মাথায় এরকম একটা উত্তর খেলা করেছে। পল ডিরাক সবার আগে প্রতি-পদার্থের অস্তিত্বের ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন। প্রতি-পদার্থ অনেকটা নেগেটিভ সংখ্যার মতো, পজিটিভ সংখ্যার সাথে নেগেটিভ সংখ্যা যোগ করলে যেমন কিছুই থাকে না, ঠিক সেরকম পদার্থের সাথে প্রতি-পদার্থ মিলিত হলে দুটোই অদৃশ্য হয়ে যায়! থাকে শুধু শক্তি।
আধুনিক পদার্থবিজ্ঞানের একটা ভাষা হচ্ছে কোয়ান্টাম মেকানিক্স এবং যে কয়জন পদার্থবিজ্ঞানী প্রথম কোয়ান্টাম মেকানিক্স গড়ে তুলেছেন তার অন্যতম হচ্ছেন পল ডিরাক। তিনি ইলেকট্রনের জন্যে কোয়ান্টাম মেকানিক্স ব্যবহার করার সময় সেখানে আইনস্টাইনের থিওরি অব রিলেটিভিটি ব্যবহার করে 1931 সালে
প্রথমবার ইলেকট্রনের প্রতি-পদার্থ পজিট্রনের অস্তিত্বের কথা ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন। পরের বছরেই কার্ল এন্ডারসন পজিট্রন আবিষ্কার করে দেখালেন ডিরাকের অনুমান একশতভাগ সত্যি।
প্রতি-পদার্থ সম্ভবত প্রকৃতির সবচেয়ে রহস্যময় একটি বিষয়। আমাদের পরিচিত যে জগৎ সেগুলো তৈরি হয়েছে অণু-পরমাণু দিয়ে আর অণু-পরমাণু তৈরি হয়েছে ইলেকট্রন, প্রোটন আর নিউট্রন দিয়ে। কাজেই আমরা আমাদের চারপাশে যা কিছু দেখি তার সবকিছু ইলেকট্রন, প্রোটন আর নিউট্রন দিয়ে তৈরি বললে একটুও অত্যুক্তি হয় না। ইলেকট্রনের যেরকম প্রতি পদার্থ হচ্ছে পজিট্রন ঠিক সে রকম প্রোটন আর নিউট্রনেরও প্রতি-পদার্থ রয়েছে, বিজ্ঞানের ভাষায় তার নাম এন্টি-প্রোটন (anti-proton) এবং এন্টি-নিউট্রন (anti-neutron)। সব প্ৰতি পদার্থই সামনে এন্টি শব্দ বসিয়ে বোঝানো হয়, শুধু ইলেকট্রনের প্রতি-পদার্থের আলাদা একটা নাম আছে–পজিট্রন। কাজেই আমরা সহজেই অনুমান করতে পারি একটি প্রোটন আর একটি পজিট্রন দিয়ে তৈরি হয় একটি এন্টিহাইড্রোজেন! ঠিক সেভাবে আমরা আমাদের চারপাশে যা কিছু দেখি তার সবকিছুরই “এন্টি” থাকা সম্ভব। পদার্থবিজ্ঞান সেটা মেনে নিয়েছে এবং ইলেকট্রন বিজ্ঞানীরা এক্সেলেটরে মোটামুটি নানারকম এন্টি-ম্যাটার (anti-matter) বা প্রতি-অণু প্রতি-পরমাণু তৈরি করে দেখিয়েছেন।