আপাতদৃষ্টিতে মনে হতে পারে নিউক্লিয়ার বোমা বানানো খুব সহজ, খানিকটা ইউরেনিয়াম 235-এর মাঝে কিছু নিউট্রন ছেড়ে দেয়া বাস্তবে কাজটা এত সহজ না। প্রথমত বোমা মানেই হচ্ছে মুহূর্তের মাঝে বিস্ফোরণ, কাজেই পুরো ঘটনাটা হবে এক সেকেন্ডের একশ কোটি এক কোটি ভাগ সময়ে। দ্বিতীয়ত, প্রত্যেকটা নিউক্লিয়াসে একই সাথে একটা করে বাড়তি নিউট্রন দিতে হবে, সেটা অত্যন্ত জটিল ব্যাপার। তবে আমরা আগেই বলেছি একটা ইউরোনিয়াম 235কে ভাঙতে পারলে শক্তির সাথে সাথে কিছু খুচরা নিউট্রন পাওয়া যায়, সেই নিউট্রনগুলো আবার অন্য নিউক্লিয়াসকে ভাঙতে পারে সেখান থেকে আবার আরো নিউট্রন পাওয়া যায়। সব নিউট্রন আবার ব্যবহার করা যায় না–কিছু কিছু খোয়া যায়। কাজেই গবেষণা করে দেখা গেছে একটা নির্দিষ্ট ভরের ইউরেনিয়াম 235 একত্র করতে পারলেই ইউরেনিয়াম 235 ভেঙে শক্তি পাওয়ার ব্যাপারটা একটানা চলতে থাকে। এই ভরটার নাম ক্রিটিক্যাল মাস এবং এই ক্রিটিক্যাল মাস বের করা হচ্ছে বোমা বানানোর প্রথম শর্ত। এক সময় এটা বের করা খুব সহজ ছিল না। আজকাল কম্পিউটার এবং ইন্টারনেট যুগে এটা প্রায় ছেলেখেলার মতো হলেও পরিমাণটুকু গোপন রাখা হয়। কেউ ঘরে বসে হিসেব করে বের করলেও নিরাপত্তা কর্মীরা এসে এই কাগজপত্র জব্দ করে নিয়ে যাবে!
ক্রিটিকাল মাস বা ভরের সমান ইউরেনিয়াম 235 একত্র করতে পারলেই তার ভেতর থেকে শক্তি বের হতে থাকে। বোমা বানানোর জন্যে দরকার সুপার ক্রিটিক্যাল মাস, যে ভরের ইউরেনিয়াম 235 একত্র করতে পারলে আসলে নিউক্লিয়ার বিক্রিয়ার ঘটনাটি অস্বাভাবিক গতিতে বাড়তে শুরু করে একটা প্রচণ্ড বিস্ফোরণ ঘটায়।
1939 থেকে 1945 সাল পর্যন্ত এই ছয় বছর প্রায় দুই বিলিয়ন ডলার খরচ করে আমেরিকায় দুটি বোমা তৈরি করেছিল যার একটি ফেলেছিল হিরোশিমাতে 1945 সালের 6 আগস্ট। অন্যটি ফেলেছিল নাগাসাকিতে, তার তিনদিন পর আগস্টের 9 তারিখ–পরের দিন, আগস্টের 10 তারিখ জাপান মিত্রবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করেছিল। এই বোমাগুলো যেখানে ফেলা হয়েছিল তার নিচের আধ মাইল ব্যাসের পুরো এলাকাটা আক্ষরিক অর্থে ভস্মীভূত হয়ে গিয়েছিল, এক মাইল ব্যাসের ভেতর সবকিছু ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল। দুই থেকে আড়াই মাইল ব্যাসের ভেতর যা কিছু দাহ্য পদার্থ ছিল সবকিছু পুড়ে ছাই হয়ে গিয়েছিল। বোমা বিস্ফোরণের মুহূর্তে মারা গিয়েছিল প্রায় সত্তর হাজার মানুষ আরো সত্তর হাজার মানুষ আহত হয়েছিল। বোমার পরে শুরু হয়েছিল তেজস্ক্রিয়তার কারণে মানুষের অচিন্তনীয় সর্বনাশ।
তেজস্ক্রিয়তা যে মানুষের জন্যে কী ভয়াবহ হতে পারে সেটি অবশ্য ম্যানহাটান প্রজেক্টের বিজ্ঞানীরা হিরোশিমা-নাগাসাকির বোমা বিস্ফোরণের আগেই জানতেন একজন খ্যাপা ধরনের বিজ্ঞানীর জন্যে। তার নাম লুইস টিন, জন্মসূত্রে কানাডার মানুষ। আমরা আগেই বলেছি ইউরেনিয়াম 235 যদি একটা নির্দিষ্ট ভর বা ক্রিটিক্যাল মাসে নিয়ে যাওয়া হয় তাহলে সেটাতে নিউক্লিয়ার বিক্রিয়া শুরু হয়ে যায় এবং সেটা আর থেমে যায় না। কাজেই খুব সঙ্গত কারণেই ইউরেনিয়াম 235 কখনোই ক্রিটিক্যাল মাস করা হয় না–নিরাপত্তার জন্যে সেটাকে দুই ভাগ করে আলাদা রাখা হয়। আলাদাভাবে দুটোই ক্রিটিক্যাল মাস থেকে কম, একসাথে একত্র করলেই সেটা বিপজ্জনক।
বিজ্ঞানী লুইস টিন এই বিপজ্জনক কাজটা নিয়ে খেলা করতে পছন্দ করতেন। অর্ধেকটা ক্রিটিক্যাল মাসের উপর বাকি অর্ধেকটা পড়তে দিতেন এবং একেবারে শেষ মুহূর্তে নিচে একটা স্ক্রু ড্রাইভার দিয়ে দুটো অংশকে আলাদা করে রাখতেন। এরকম খেলা করতে করতে হঠাৎ একদিন ক্রু ড্রাইভারটা সময়মতো দিতে পারলেন না এবং দুটো অংশ একত্র হয়ে মুহূর্তে পুরোটাতে নিউক্লিয়ার বিক্রিয়া শুরু হয়ে গেল। ঘরে যারা ছিল তারা সবাই দেখল ক্রিটিক্যাল ভরের সেই নিউক্লিয়ার জ্বালানি থেকে নীল আলো ঝলসে উঠেছে–মনে হলো ঘরের ভেতর একটা আগুনের হলকা ছুটে যাচ্ছে। লুইস টিন প্রাণপণ চেষ্টা করে ভেতরে ক্রু ড্রাইভার ঢুকিয়ে দুটো অংশ আলাদা করে বিক্রিয়াটি থামালেন কিন্তু ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে গেছে। লুইস টিনের মনে হলো তার হাতটি আগুনে ঝলসে গেছে, তিনি মুখে এক ধরনের টক টক স্বাদ অনুভব করলেন। লুইস টিন তখন ঘরের ভেতর দাঁড়ানো সব বিজ্ঞানীদের বললেন, “তোমরা কেউ নড়বে না, যে যেখানে আছ দাঁড়িয়ে থাকো, কে কতটুকু তেজস্ক্রিয় বিকীরণ পেরেছ জানা দরকার। আমি বাঁচব না, তোমাদের কেউ কেউ বেঁচে যাবে।”
দুই দিন পর লুইস টিন মারা গেলেন, সেই মৃত্যুর মতো যন্ত্রণাদায়ক মৃত্যু পৃথিবীর ইতিহাসে খুব বেশি নেই। তীব্র তেজস্ক্রিয় রশ্মি তার সারা শরীরকে একেবারে ভেতর থেকে ঝলসে দিয়েছিল। একজন লুইস টিন যত কষ্ট পেয়ে মারা গিয়েছিলেন জাপানের প্রায় এক লক্ষ মানুষ সেরকম কষ্ট পেয়ে মারা গিয়েছিল!
লুইস সুটিনের হাত ফসকে দুটো অংশ একত্র হয়ে ক্রিটিক্যাল ভর হয়ে গিয়েছিল। নিউক্লিয়ার বোমার ভেতরে সেটা করা হয় ইচ্ছে করে। লুইস টিন যে দুটো অংশ নিয়ে খেলা করছিলেন সেটা শুধুমাত্র বিক্রিয়াটা শুরু করেছিল, নিউক্লিয়ার বোমায় সেটা শুরু হয়ে মাত্রার বাইরে চলে যায় মুহূর্তে। নিউক্লিয়ার বোমার ভেতরে দুটো অংশ আলাদা রাখা হয়, যখন বিস্ফোরণের মুহূর্তটি আসে তখন দুটি অংশ প্রচণ্ড বেগে একটি আরেকটির দিকে ছুটে আসে। দুটি অংশ স্পর্শ করা মাত্রই প্রচণ্ড বিস্ফোরণে সেটা বিস্ফোরিত হয় (21.2 নং ছবি)। হিরোশিমার বোমাটি ছিল এরকম একটি বোমা।