তিন ধরনের নিউট্রিনো নিয়ে যখন পদার্থবিজ্ঞানীদের ভেতর নানা ধরনের উত্তেজনা তখন একই সাথে সবার ভেতরে আরেকটা প্রশ্ন কাজ করছে। সেটা হলো, নিউট্রিনোর কী ভর আছে? একটা কণা যার কোনো ভর নেই কল্পনা করা শক্ত। আমরা সে রকম একটা কণাকেই জানি, সেটা হচ্ছে আলোর কণা, তার কোনো ভর নেই বলে সেটা ছুটে আলোর গতিতে। নিউট্রিনোর যদি ভর না থাকে তাহলে সেটাও ছুটবে আলোর গতিতে। নিউট্রিনোর ভর যদি থেকেও থাকে সেটা হবে খুবই কম–এত কম যে ল্যাবরেটরিতে সেটা খুঁজে বের করা রীতিমতো দুঃসাধ্য একটা কাজ।
দুঃসাধ্য হলেও বিজ্ঞানীরা থেমে থাকেন না। কাজেই সারা পৃথিবীতে বিজ্ঞানীরা নিউট্রিনোর ভর আছে কী নেই সেটা বের করার কাজে লেগে গেলেন। 1998 সালে শেষ পর্যন্ত বিজ্ঞানীরা সন্দেহাতীতভাবে দেখালেন যে নিউট্রিনোর ভর আছে, ভরটি খুবই কম, তারা যেরকম কল্পনা করেছিলেন কিন্তু শূন্য নয়।
একই সাথে সূর্যের নিউট্রিনো সমস্যাটির সমাধান হয়ে গেল। নিউট্রিনোর যদি ভর থাকে তাহলে এক ধরনের নিউট্রিনো অন্য ধরনের নিউট্রিনোতে পাল্টে যেতে পারে। কাজেই সূর্য থেকে যে নিউট্রিনোগুলো বের হচ্ছিল পৃথিবীতে আসতে আসতে তারা অন্য ধরনের নিউট্রনোতে পাল্টে যাচ্ছিল–বিজ্ঞানীরা তাই সেগুলোকে আর খুঁজে পাচ্ছিলেন না। নিউট্রিনোর ভর খুঁজে পেয়ে ত্রিশ বছর ধরে বিজ্ঞানীদের ব্যতিব্যস্ত করে রাখা সূর্যের নিউট্রিনো সমস্যার সমাধান খুঁজে বের করার জন্যে সেই পদার্থবিজ্ঞানীদের নোবেল পুরস্কার দেয়া হয় 2002 সালে!
রহস্যময় নিউট্রিনো সত্যিই রহস্যময় তাই প্রায় অদৃশ্য এই রহস্যময় কণাকে বোঝার জন্য বুঝি এতগুলো বিজ্ঞানীকে নোবেল প্রাইজ দিতে হয়েছে!
২১. ম্যানহাটান প্রজেক্ট
পৃথিবীর গুরুত্বপূর্ণ যে কয়টা জিনিসের ভুল নামকরণ করা হয়েছে তার একটা হচ্ছে এটম বোমা। এর সঠিক নাম হওয়া উচিত নিউক্লিয়ার বোমা এবং মাঝে মাঝে এই নামটাও যে ব্যবহার করা হয় না তা নয় কিন্তু কীভাবে জানি এটম বোমা নামটাই অনেক বেশি ভয়ঙ্কর বলে মনে হয়।
এটম বোমার (বা শুদ্ধ করে বললে নিউক্লিয়ার বোমার) সাথে বিজ্ঞানী আইনস্টাইনের যোগাযোগ দুই ভাবে। প্রথমত, এই বোমায় বস্তুর ভরকে আইনস্টাইনের বিখ্যাত সূত্র E = mc^2 অনুযায়ী শক্তিতে রূপান্তর করা হয়। দ্বিতীয় যোগাযোগটি অনেক বেশি বাস্তব, দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের ঠিক আগে আগে 1937 সালের 2 আগস্ট আইনস্টাইন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ফ্রাঙ্কলিন রুজভেল্টকে একটা চিঠি লিখে বলেছিলেন হিটলার জার্মানিতে সম্ভবত নিউক্লিয়ার বোমা বানানোর চেষ্টা করছে কাজেই আমেরিকারও এই ধরনের প্রস্তুতি থাকা দরকার। তার কিছুদিনের ভেতরেই সেখানে ম্যানহাটান প্রজেক্ট নামে নিউক্লিয়ার বোমা তৈরির খুব গোপন একটি প্রজেক্ট শুরু হয়। হিরোশিমা এবং নাগাসাকিতে পৃথিবীর মানুষের উপর ফেলা বোমা দুটি এই প্রজেক্ট থেকে তৈরি করা হয়েছিল।
নিউক্লিয়ার বোমার শক্তিটুকু আসে পরমাণু বা এটমের মাঝখানে থাকা নিউক্লিয়াস থেকে এবং এরকম একটা নিউক্লিয়াস হচ্ছে ইউরেনিয়াম 235, এখানে 235 সংখ্যাটি দিয়ে বোঝানো হচ্ছে এর নিউক্লিয়াস প্রোটন এবং নিউট্রনের মোট সংখ্যা হচ্ছে 235 (এর মাঝে 92টি প্রোটন বাকি সব নিউট্রন)। এটি অনেক বড় নিউক্লিয়াস এবং বলা যেতে পারে এটা কোনোরকমে আস্ত অবস্থায় রয়েছে। যদি কোনোভাবে এর মাঝে আরো একটি নিউট্রন ঢুকিয়ে দেয়া যায় তাহলেই এটা আর আস্ত থাকবে না, ভেঙে দুই টুকরো হয়ে যাবে–তার সাথে কিছু খুচরা নিউট্রনও বের হয়ে আসবে (21.1 নং ছবি)। নিউক্লিয়াস এবং তার মাঝে ঢুকে যাওয়া নিউট্রনের যে ভর ছিল দেখা যাবে যে ভেঙে যাওয়ার পর তার দুই টুকরো এবং খুচরা কিছু নিউট্রনের ভর কিন্তু তার থেকে কম। যেটুকু ভর কম সেটাই আইনস্টাইনের বিখ্যাত E = mc সূত্র মেনে শক্তি হিসেবে বের হয়ে আসে। পারমাণবিক শক্তি কেন্দ্র বা পারমাণবিক চুল্লি বলতে আমরা যেটা বোঝাই সেখানে ঠিক এই প্রক্রিয়ায় শক্তি বের হয়ে আসে। সেখানে বাকিটাকে বের করা হয় নিয়ন্ত্রিতভাবে ধীরে ধীরে, যখন পুরো শক্তিটাকে অনিয়ন্ত্রিতভাবে মুহূর্তের মাঝে বের করে আনা হয় সেটাকে বলে এটম বোমা (অথবা শুদ্ধ করে বললে নিউক্লিয়ার বোমা।)
তাহলে বোঝাই যাচ্ছে নিউক্লিয়ার বোমা বানানোর প্রথম ধাপ হচ্ছে ইউরেনিয়াম 235 সংগ্রহ করা। কাজটা খুব সহজ নয়, প্রথমত এক গ্রাম ইউরেনিয়াম পাওয়ার জন্যে দরকার 500 গ্রাম ইউরেনিয়ামের খনিজ, সেখানে ইউরেনিয়ামের প্রায় পুরোটাই–শতকরা প্রায় নিরানব্বই ভাগ হচ্ছে ইউরেনিয়াম 238 যেটা দিয়ে বোমা বানানো যায় না। যে আইসোটোপ দিয়ে বোমা বানানো যায় সেটা হচ্ছে ইউরেনিয়াম 235 সেটা থাকে শতকরা এক ভাগ। শতকরা হিসেবে সেটা খুব বড় সমস্যা হবার কথা নয় কিন্তু সেটা বিশাল সমস্যা অন্য কারণে ইউরেনিয়াম 235 এবং ইউরেনিয়াম 238 দুটোই একই পরমাণুর আইসোটপ, অর্থাৎ রাসায়নিক পরিচয় হুবহু এক, পার্থক্য হচ্ছে নিউক্লিয়াসে নিউট্রনের তিনটা সংখ্যায়! সে কারণে কোনো রাসায়নিক প্রক্রিয়ায় ইউরেনিয়াম 235কে ইউরেনিয়াম 238 থেকে আলাদা করা যায় না। সেটা আলাদা করতে হয় অত্যন্ত জটিল যান্ত্রিক পদ্ধতিতে। নিউক্লিয়ার রি-এক্টরে ব্যবহার করার জন্যে যেটুকু ইউরেনিয়াম 235 আলাদা করতে হয় তার থেকে অনেক বেশি আলাদা করতে হয় বোমা বানানোর জন্যে। তাই যখনই কোনো দেশ ইউরেনিয়াম 235 আলাদা করার চেষ্টা করে তখনই সারা পৃথিবী সতর্ক হয়ে যায়। ইরানকে নিয়ে পশ্চিমা দেশগুলো হইচই করছে ঠিক এই কারণে।