ল্যাবরেটরিতে করা এই পরীক্ষার ত্রিশ বছর পর সারা পৃথিবীর মানুষ ইরাকের আবু গারিব জেলখানার ঘটনাটা জানতে পেরেছিল, যেখানে আমেরিকার নারী এবং পুরুষ গার্ডেরা ইরাকি কয়েদিদের উপর অমানুষিক একটা নির্যাতন চালিয়েছিল। মনোবিজ্ঞানের বইয়ে আবু গারিব জেলখানার ঘটনা এখন ফিলিপ জিমবার্ডোর সাড়া জাগানো পরীক্ষার বাস্তব রূপ বলে ধরে নেয়া হয়।
যে পরীক্ষাটার কথা বলে শেষ করা হবে সেটা আসলে মনোবিজ্ঞানীদের কোনো পরীক্ষা নয় কিন্তু বহুল আলোচিত একটা ঘটনা, যেটা মানুষের মনোজগতের একটা বিশেষ দিকে উঁকি দেয়। ঘটনাটি ঘটিয়েছিলেন জশুয়া বেল নামে পৃথিবীর একজন সর্বশ্রেষ্ঠ বেহালাবাদক। 2007 সালের 7 এপ্রিল তিনি জীর্ণ-শীর্ণ পোশাক পরে একটা বেহালা নিয়ে ওয়াশিংটন ডি.সি.র পাতাল ট্রেনের একটা স্টেশনের গেটের কাছে এসে দাঁড়ালেন। বেহালার বাক্সটা সামনে খুলে রেখে তিনি বেহালা বাজাতে লাগলেন, সেই দেশের দরিদ্র ভিখারিরা যেভাবে ভিক্ষা করে সেভাবে। তিনি যেই বেহালটি বাজাচ্ছিলেন সেটি ছিল অত্যন্ত মূল্যবান একটা বেহালা এবং বেহালায় তিনি যে সুর তুলছিলেন সেই সুর শোনার জন্যে পৃথিবীর অসংখ্য মানুষ হাজার হাজার ডলার খরচ করে তার অনুষ্ঠানে যায়।
কিন্তু মজার ব্যাপার হলো প্রায় পঁয়তাল্লিশ মিনিট তিনি সেখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বেহালা বাজালেন, কেউ তার দিকে ঘুরেও তাকাল না। ভিক্ষে যেটুকু পেলেন সেটি না পাওয়ার মতোই। কেউ তাকে চিনল না এবং হাজার হাজার মানুষ ব্যস্তভাবে ট্রেন ধরতে কিংবা ট্রেন থেকে নেমে ছুটে গেল, কেউ তার বেহালার সুর শোনার জন্যে থমকে দাঁড়াল না।
থমকে দাঁড়াল শুধু শিশুরা–তারা মন্ত্রমুগ্ধের মতো দাঁড়িয়ে সেই অপূর্ব বেহালার সুর শুনতে চাইছিল। মায়েরা তাদের সেটা শুনতে দেয় নি, স্টেশনে ছেঁড়া কাপড় পরা এক ভিখিরির বেহালা শোনার তাদের সময় নেই, মায়েরা তাদের সন্তানদের টেনেহিঁচড়ে নিয়ে চলে গিয়েছিল।
তার পরেও আমরা কী শিশুদের বিচারবুদ্ধিকে অবহেলা করব?
১৮. পশু মানব
বেশ কয়েক বছর আগে আমি সিলেট থেকে ঢাকা আসার জন্যে রেল স্টেশনে গিয়েছি। সময়টা শীতকাল এবং সম্ভবত তখন কোনো একটা শৈত্যপ্রবাহ চলছে। কুয়াশা ঢাকা ঘোলাটে সূর্যে কোনো উত্তাপ নেই, সারাদেশ শীতের দাপটে জবুথবু হয়ে আছে। আমি সোয়েটার, জ্যাকেট এবং গলায় মাফলার জড়িয়েও শীতে ঠকঠক করে কাঁপছি। তখন আমি একটা অবিশ্বাস্য দৃশ্য দেখতে পেলাম, তিন-চার বছরের একটি বাচ্চা সম্পূর্ণ উদোম গায়ে রেললাইনের উপর খেলছে, তার শরীরে একটা সুতোও নেই। এই প্রচণ্ড শীতে যখন প্রতিটি মানুষ জাব্বাজোব্বা জড়িয়েও শীত থেকে রেহাই পাচ্ছে না তখন এই শিশুটি প্রচণ্ড শীতের বাতাসে কেমন করে নির্বিকারভাবে উদোম শরীরে ঘুরে বেড়াচ্ছে সেটি একটি অবিশ্বাস্য দৃশ্য।
একটা শিশুকে কতদিন না খাইয়ে রাখা যায়, কিংবা কত কম তাপমাত্রায় একটা শিশু বেঁচে থাকতে পারে বা কত কম বাতাসে একটা শিশু নিশ্বাস নিতে পারে এই। ধরনের প্রশ্ন মানুষের মাথায় ঘুরপাক খেলেও কোনো মানুষ কখনোই কোনো পরীক্ষা করে এই প্রশ্নগুলোর উত্তর বের করার চেষ্টা করে নি। (নাৎসি ডাক্তার ম্যাঙ্গেলাকে আমি মানুষ হিসেবে বিবেচনা করি না।) কিন্তু মাঝে মাঝেই লোকচক্ষুর আড়ালে বড় হওয়া কোনো অপ্রকৃতস্থ পিতামাতার সন্তান, বড় দুর্ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্ত কোনো শিশু কিংবা ভূমিকম্পে আটকে পড়া কোনো নবজাতকদের দেখে বিজ্ঞানীরা মানব শিশু সম্পর্কে কিছু বিচিত্র তথ্য পেয়ে যান। সিলেট রেল স্টেশনের উদোম গায়ের শিশুটি ছিল একজন অপ্রকৃতস্থ মায়ের সন্তান, অবহেলায় বড় হওয়া সেই শিশুটিকে দেখে আমি অনুমান করেছিলাম একটা শিশুকে জন্মের পর থেকেই অভ্যাস করানো হলে সে নিশ্চয়ই ভয়ঙ্কর শীতেও উদোম গায়ে থাকতে পারে।
তবে মানুষ সম্পর্কে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কিছু তথ্য জানা সম্ভব হয়েছে বনের পশুর কাছে বড় হওয়া কিছু শিশুদের কাছ থেকে। ইতিহাসে এ রকম অনেক ঘটনার বর্ণনা আছে, সবচেয়ে বিখ্যাতটি সম্ভবত গ্রিক উপাখ্যানের রমুলাস এবং রিমাসের কাহিনী। এই দুইজন যমজ ভাইকে হত্যা করার নির্দেশ দেয়া হয়েছিল কিন্তু নিষ্পাপ শিশু দুটিকে হত্যা না করে তাদেরকে একটা ঝুড়িতে করে নদীতে ভাসিয়ে দেয়া হয় এবং শেষ পর্যন্ত একটি নেকড়ে মা তাদের দুধ খাইয়ে বড় করে। রমুলাস শেষ পর্যন্ত রোমে রাজত্ব করেছিল এবং তার নামানুসারেই রোমের নামকরণ করা হয়েছিল।
গ্রিক উপাখ্যানের এই কাহিনীটি চমকপ্রদ কিন্তু এখন আমরা জানি এটি পুরোপুরি সত্যি হতে পারে না। মানুষ কীভাবে মানুষ হয়ে ওঠে সেটি নিয়ে বিজ্ঞানীদের অনেক কৌতূহল। তারা এখন জানেন যে মানুষের বয়স প্রায় এক লক্ষ বিশ হাজার হলেও কথা বলার জন্যে পরিপূর্ণ ভাষা ব্যবহার করতে পারে এ রকম আধুনিক মানুষ তুলনামূলকভাবে অনেক নতুন, মাত্র চল্লিশ হাজার বছর। ভাষা ব্যবহার করা বা একজনের সাথে আরেকজনের ভাব বিনিময়ের এই প্রক্রিয়াটা মানুষ কেমন করে শিখেছে সেটা নিয়ে অনেক গবেষণা হয়েছে। যে কোনো পরিবেশেই মানুষ কী ভাষা ব্যবহার করতে পারে নাকি এটা মানুষকে সামাজিক পরিবেশে রাখলেই সে ভাষা শিখতে পারে সেটি নিয়ে বিজ্ঞানীদের মাঝে এক ধরনের কৌতূহল ছিল। পশুদের কাছে বড় হওয়া শিশুদের থেকে বিজ্ঞানীরা জানেন, ভাষা বা ভাব বিনিময়ের প্রক্রিয়াটা শেখার জন্যে সামাজিক পরিবেশ বা মানুষের সাহচর্য খুব গুরুত্বপূর্ণ। সত্যি কথা বলতে কী ভাষা শেখার জন্যে শিশুদের যে ছোট একটা সময় রয়েছে কোনোভাবে সেই সময়টুকু যদি ব্যবহার করতে না পারে তাহলে পরে যত চেষ্টাই করা যাক না কেন তারা আর ভাষাটুকু শিখতে পারে না।