মনোবিজ্ঞানীরা গম্ভীরভাবে শিক্ষকের দায়িত্ব নেয়া স্বেচ্ছাসেবককে বলে দিলেন প্রতিবার ছাত্র একটা ভুল করবে ততবার তাকে ইলেকট্রিক শক দিতে হবে। শুধু তাই নয়, প্রত্যেকবার ভুল করার পর ইলেকট্রিক শকের মাত্রা 15 ভোল্ট করে বাড়িয়ে দিতে হবে। এখানেই শেষ নয়, মনোবিজ্ঞানীরা বলে দিলেন, পরীক্ষাটা শুরু করার পর শেষ না করে কেউ উঠে যেতে পারবে না। ছাত্র এবং শিক্ষক দুজনেই রাজি হলো। ছাত্রটাকে তখন একটা ঘরে একটা চেয়ারে রীতিমতো বেঁধে ফেলা হলো। তার শরীরে ইলেকট্রিক তার লাগানো হলো ইলেকট্রিক শক দেওয়ার জন্য।
শিক্ষকে তখন অন্য একটা ঘরে ইলেকট্রিক শক দেওয়ার যন্ত্রটাসহ বসানো হলো, যন্ত্রটা কীভাবে কাজ করে তাকে শেখানো হলো এবং 45 ভোল্টের একটা ছোট শক দিয়ে তাকে ইলেকট্রিক শক খেলে কেমন লাগে তার অনুভূতি দেওয়া হলো। তারপর মনোবিজ্ঞানীরা শিক্ষক এবং ছাত্রকেই পুরো পরীক্ষাটা শেষ করার নির্দেশ দিলেন, তাদেরকে মনে করিয়ে দিলেন, পরীক্ষার নিয়ম অনুযায়ী একবার শুরু করা হলে পুরো পরীক্ষা শেষ করতে হবে।
পরীক্ষা শুরু হলো। শিক্ষকের দায়িত্ব পাওয়া স্বেচ্ছাসেবক একটা করে শব্দ উচ্চারণ করেন এবং ছাত্রের দায়িত্ব পাওয়া স্বেচ্ছাসেবক তার জোড় শব্দটি বলেন। যদি উত্তর সঠিক হয় তাহলে ভালো কিন্তু যখনই উত্তরটা ভুল হয় তখনই ছাত্রকে একটা ইলেকট্রিক শক দিয়ে ভোল্টেজের মাত্রাটা বাড়িয়ে দেয়া হয়। প্রথম দিকে কাজটা সহজ ছিল কিন্তু যখন ছাত্র একটু পরে পরে ভুল করতে লাগল তখন ভোল্টেজের মাত্রা বেড়ে যেতে লাগল এবং ইলেকট্রিক শক খেয়ে যন্ত্রণায় ছাত্রটা গগনবিদারি চিৎকার করতে থাকে। রীতিমতো অমানুষিক ব্যাপার–শিক্ষকের দায়িত্ব পাওয়া স্বেচ্ছাসেবক এই ভয়ঙ্কর অমানবিক পরীক্ষা বন্ধ করার অনুমিত চাইল কিন্তু মনোবিজ্ঞানীরা রাজি হলেন না। শিক্ষকের দায়িত্ব পাওয়া স্বেচ্ছাসেবক একেবারে শেষ পর্যন্ত পরীক্ষাটা চালিয়ে গেলেন, শেষের দিকে ভোল্টেজ এত বেড়ে গেল যে ইলেকট্রিক শক খেয়ে “ছাত্র” বেচারা জ্ঞান হারিয়ে ফেলল কিন্তু তবু তার মুক্তি নেই।
এই ছিল বিখ্যাত স্ট্যানলি মিলগ্রামের বিখ্যাত পরীক্ষা এবং যারা এটা পড়ছেন তারা নিশ্চয়ই ভাবছেন বিজ্ঞানী হয়ে কেমন করে এরকম অমানবিক একটা পরীক্ষা করতে পারলেন? পরীক্ষাটা আসলেই ভয়ঙ্কর অমানবিক একটা পরীক্ষা হতো যদি না পুরো ব্যাপারটা আসলে একটা সাজানো নাটক হতো। এই পুরো পরীক্ষাটাই সাজানো, প্রকৃতপক্ষে শক দেওয়ার যন্ত্রটি মোটেও ইলেকট্রিক শক দেয় না, ছাত্রকে কখনোই শক দেয়া হয় নি, সে ইলেকট্রিক শক খাওয়ার ভান করে গগনবিদারি চিৎকার করেছে। শিক্ষকের দায়িত্বপ্রাপ্ত স্বেচ্ছাসেবক কখনোই অনুমান করতে পারে নি যে লটারি করে তাকে শিক্ষক হিসেবে বেছে নেওয়া হয়েছে সেটাও ছিল সাজানো। মূল পরীক্ষাটা মোটেও ছাত্র-শিক্ষক এবং শেখার ব্যাপার নয়। মূল পরীক্ষাটা ছিল ধোপদুরস্ত বৈজ্ঞানিকের চেহারার মানুষ একজন সাধারণ মানুষকে কোনো আদেশ দিলে তারা সেই আদেশ কতটুকু মানে। অন্য একজনকে নির্মম যন্ত্রণা দেওয়ার আদেশ তারা মানতে রাজি হয় কী না। স্ট্যানলি মিলগ্রাম দেখিয়েছেন সাধারণ মানুষ একটা অন্যায় আদেশ দেয়া হলে সেটা না মানার মনোবল বা দৃঢ়তা দেখাতে পারে না। যুদ্ধে সাধারণ সৈনিকেরা যে অবলীলায় সাধারণ মানুষকে গুলি করে মেরে ফেলতে পারে, তার কারণটাও আসলে এর মাঝে লুকিয়ে রয়েছে। এই সত্যটা জানে বলেই সেনাবাহিনীতে সাধারণ সেনাবাহিনীকে কোনো প্রশ্ন না করে তাদের উপরের অফিসারের আদেশ মেনে নেয়া শেখানো সম্ভব হয়।
স্ট্যানলি মিলগ্রামের পরীক্ষা ছিল এক ধরনের মানসিক চাপের পরীক্ষা। মনে হচ্ছিল কোনো কোনো মানুষ শারীরিক যন্ত্রণা পাচ্ছে কিন্তু আসলে সেটা ছিল অভিনয়। কিন্তু এখন যে পরীক্ষাটার কথা বলা হবে সেটা সবাই জানত অভিনয় কিন্তু তার ফলে যে যন্ত্রণার জন্ম হয়েছিল সেটা ছিল পুরোপুরি বাস্তব। এই পরীক্ষাটা করেছিলেন ফিলিপ জিমবার্ডো, 1973 সালে প্রথমে পারিশ্রমিকের বিনিময়ে স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটির 24 জন আন্ডারগ্রাজুয়েট ছাত্রকে বেছে নেয়া হলো। যাদেরকে বেছে নেয়া হলো তারা সবাই শারীরিক এবং মানসিকভাবে সুস্থ। এবং সবল। তারপর লটারি করে তাদের অর্ধেককে তৈরি করা হলো গার্ড বাকি অর্ধেক হলো কয়েদি। গার্ডদের দেয়া হলো গার্ডের পোশাক, কয়েদিদের কয়েদির পোশাক এবং পায়ে শিকল। স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটির মনোবিজ্ঞান বিভাগের নিচে একটা বেসমেন্টকে তৈরি করা হলো একটা জেলখানা তারপর কয়েদিদের জেলখানায় পুরে গার্ডদের বলা হলো পাহারা দিতে। তাদেরকে দুই সপ্তাহ কয়েদি এবং গার্ড হিসেবে থাকতে হবে। এবং মনোবিজ্ঞানীরা তাদের পরীক্ষা করে দেখবেন। কমবয়সী আন্ডারগ্রাজুয়েট ছাত্ররা সানন্দে রাজি হয়ে গেল।
মাত্র ছয়দিন পর এই পরীক্ষা বন্ধ করে দিতে হলো কারণ দেখতে দেখতে গার্ডের ভূমিকায় থাকা ছেলেগুলো হয়ে উঠল নিষ্ঠুর, কয়েদির ভূমিকায় থাকা ছেলেগুলো হয়ে গেল অসহায়। সেই নিষ্ঠুর ছেলেগুলো অসহায় কয়েদিদের গালিগালাজ, অপমান, উলঙ্গ করে অত্যাচার এরকম ভয়ানক নির্যাতন শুরু করল যে কয়েদিরা মানসিকভাবে পুরোপুরি ভেঙে পড়ল। পুরো বিষয়টা ছিল এক ধরনের অভিনয় কিন্তু দেখতে দেখতে সেটি বাস্তব হয়ে গেল। গার্ভের ভূমিকা পাওয়া ছেলেগুলো মনে করতে লাগল তারা সত্যিই বুঝি নিষ্ঠুর গার্ড। কয়েদির ভূমিকা পাওয়া ছেলেগুলো মনে করতে লাগল তারা সত্যিই বুঝি অসহায় কয়েদি, তারা প্রতিবাদ করতেই আর সাহস পেল না।