গর্ভবতী মায়েদের অসুখ-বিসুখের সাথেও স্কিতজোফ্রেনিয়ার সম্ভাবনা থাকতে পারে বলে আশঙ্কা করা হয়। গর্ভ ধারণের পর মায়েদের ফ্লু হলে সেটা কোনোভাবে সন্তানদের স্কিতজোফ্রেনিয়া হবার আশঙ্কাকে বাড়িয়ে দেয়। চারপাশের পরিবেশ একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে জানলেও ঠিক বিশেষ ধরনের একটা ঘটনা বা সামাজিক অবস্থা এরকম একটি বৈকল্য ঘটিয়ে দিতে পারে সে ব্যাপারে কোনো বিজ্ঞানী এখনো একমত হন নি। ধারণা করা হয় সামগ্রিক একটা ব্যাপার এর জন্যে দায়ী, বিচ্ছিন্ন একটি বা দুটি বিষয় নয়।
আমাদের সবারই মাঝে মাঝে অকারণে মন খারাপ হয়। কখনো কখনো আমরা শুধু শুধু একজনকে কোনো কিছু নিয়ে সন্দেহ করি, কোনো কোনো সময় আমরা কিছু একটা বুঝতে ভুল করে ফেলি বা অসংলগ্ন কথা বলে ফেলি। কিন্তু আমরা কখনোই স্কিতজোফ্রেনিকদের ভয়ঙ্কর আতঙ্ক অনুভব করি না, কেউ একজন আমাদের খুন করে ফেলবে সেই ভয়ে অস্থির হয়ে যাই না বা অদৃশ্য কোনো মানুষ আমাদের সাথে কথা বলে না। কোনো দুঃসংবাদ শুনে আমরা আনন্দে অট্টহাসি শুরু করে দিই না। তাই দুর্ভাগা স্কিতজোফ্রেনিকদের জন্যে আমরা সবসময়েই গভীর এক ধরনের সমবেদনা অনুভব করি–বিজ্ঞানীরা তাই এই রহস্যময় বিষয়টি বোঝার জন্যে চেষ্টা করে যাচ্ছেন। একবার সেটি বুঝে গেলে হয়তো সেটি অপসারণ করা যাবে, সেটাই আমাদের আশা।
তথ্যসূত্র : Psychology David G. Myers
১৭. মনোবিজ্ঞানের বিখ্যাত কিছু পরীক্ষা
মানুষের মন বড় বিচিত্র একটা বিষয়–এটা বোঝা খুব সহজ নয়। সবচেয়ে বিস্ময়কর ব্যাপার হচ্ছে এটা প্রায় সময়েই “কমন সেন্স” দিয়ে বোঝা যায় না। যেমন ধরা যাক যদি কাউকে জিজ্ঞেস করা হয় যে একজন মানুষ আত্মহত্যা করার জন্যে সাততলা বাসার ছাদে দাঁড়িয়ে আছে, আরেকজন মানুষ তাকে দেখতে পেলে কী করবে? মোটামুটি নিশ্চিতভাবে বলা হবে যে মানুষটি চেষ্টা করবে সাততলা বাসার ছাদে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটিকে আত্মহত্যা থেকে নিবৃত্ত করতে। 1981 সালে কিছু মনোবিজ্ঞানী এটা নিয়ে গবেষণা করে খুবই বিচিত্র একটা বিষয় আবিষ্কার করেছেন। তারা দেখেছেন যদি আত্মহত্যা করতে ইচ্ছুক মানুষটিকে দেখে শ’তিনেক মানুষ থেকে বেশি মানুষ ভিড় করে এবং যদি সময়টা সন্ধেবেলার দিকে হয় তাহলে সম্মিলিত মানুষ আত্মহত্যাটাকে থামানোর চেষ্টা করবে না। উল্টো সবাই মিলে লোকটাকে ছাদ থেকে লাফ দেবার জন্যে প্ররোচিত করতে থাকবে। আমি জানি ব্যাপারটাকে মোটেও বিশ্বাসযোগ্য মনে হয় না কিন্তু মনোবিজ্ঞানীরা এ ধরনের অনেকগুলো ঘটনা বিশ্লেষণ করে এটাই জানতে পেরেছেন। মানুষ এককভাবে একরকম ব্যবহার করে, যখন একসাথে অনেক মানুষ থাকে তখন হঠাৎ করে তাদের ব্যক্তিগত চরিত্র পাল্টে সম্মিলিত মানুষের সম্পূর্ণ ভিন্ন একটা চরিত্র ফুটে ওঠে।
মানুষের মন বোঝার জন্যে মনোবিজ্ঞানের বেশ কিছু চমকপ্রদ পরীক্ষা করা হয়েছে। 1956 সালে সলোমন এশের এরকম একটা পরীক্ষা এখন খুব সুপরিচিত। পরীক্ষাটা খুবই সহজ, একটা কাগজে একটা সরলরেখা আঁকা হয়েছে, অন্য একটা কাগজে তিনটা সরলরেখা আঁকা হয়েছে, যার মাঝে একটা প্রথম কাগজে আঁকা রেখাটার সমান। যে কোনো মানুষকে জিজ্ঞেস করা হলে সে তিনটা রেখার মাঝে কোন রেখাটা প্রথম রেখাটার সমান সেটা খুব সহজেই বলে দিতে পারে । সলোমন এশ এবারে একটা মজার কাজ করলেন, তিনি আটজন মানুষের একটা ছোট দলকে এই কাজটি করতে দিলেন, তিনটি রেখার ভেতর থেকে সঠিক দৈর্ঘ্যের রেখাঁটি খুঁজে বের করতে হবে। আটজনের এই দলের মাঝে একটা বৈশিষ্ট্য ছিল, সাতজনই ছিল সলোমন এশের নিজের লোক, একজন ছিল খাঁটি এবং সে ঘুণাক্ষরেও সন্দেহ করে নি যে অন্যেরা এই বৈজ্ঞানিক “ষড়যন্ত্রের সাথে যুক্ত। সলোমন এশের নির্দেশ অনুযায়ী সাতজন মানুষই ইচ্ছে করে একটা ভুল রেখাকে শনাক্ত করল, মজার ব্যাপার দেখা গেল যে খাঁটি মানুষটি ষড়যন্ত্রে পা দিয়ে নিজেও ভুল রেখাটাকে শনাক্ত করছে। কোনটি সঠিক উত্তর হবে সে খুব ভালো করে জানে কিন্তু অন্য সাতজনের উত্তর শুনে সে ভুল উত্তরটাকেই সঠিক উত্তর ভাবতে শুরু করেছে! বৈজ্ঞানিক মহলে এটা ঐকমত্যের (conformity) পরীক্ষা নামে বিখ্যাত হয়ে আছে–তবে আমরা বহুদিন থেকে এটা জানি। আমাদের বাংলা ভাষায় এটা নিয়ে একটা বাগধারাও আছে, আমরা সেটাকে বলি, “দশচক্রে ভগবান ভূত!”
মনোবিজ্ঞানের জগতে যে পরীক্ষাটি সবচেয়ে বিখ্যাত হয়ে আছে সেটার নাম স্ট্যানলি মিলগ্রামের পরীক্ষা। অনুমান করা হয় আজকাল এরকম পরীক্ষা আইনসঙ্গত মনে করা হবে না এবং কাউকে করতে দেয়া হবে না। তবে ষাটের দশকে (1963)। মনোবিজ্ঞানী স্ট্যানলি মিলগ্রামের এটা করতে কোনো সমস্যা হয় নি। এই বিখ্যাত পরীক্ষাটি করা হয়েছে এভাবে : খবরের কাগজে বিজ্ঞাপন দেয়া হয়েছে ছাত্র এবং শিক্ষক সংক্রান্ত একটা পরীক্ষা করা হবে সে জন্যে স্বেচ্ছাসেবক প্রয়োজন। সেই বিজ্ঞাপন দেখে অনেকেই পরীক্ষায় অংশ নিতে এসেছেন। মনোবিজ্ঞানীরা প্রথমে তাদেরকে বিষয়টা বুঝিয়ে দিলেন। পরীক্ষাটা করার জন্যে দুজন স্বেচ্ছাসেবক দরকার, তার মাঝে একজন হবে শিক্ষক অন্যজন হবে ছাত্র। দুজন স্বেচ্ছাসেবককে দিয়ে শুরু করা হলো এবং লটারি করে একজনকে শিক্ষক অন্যজনকে ছাত্রের দায়িত্ব দেয়া হলো, ছাত্রকে প্রথমে বেশ কিছু জোড়া শব্দ মুখস্থ করতে বলা হলো এবং তাকে বলা হলো জোড়া শব্দের প্রথম শব্দটি তাকে বলা হলে তাকে দ্বিতীয় শব্দটি বলতে হবে। সে যদি সঠিকভাবে বলতে না পারে তাকে ইলেকট্রিক শক দিয়ে শাস্তি দেয়া হবে। পরীক্ষার উদ্দেশ্য ইলেকট্রিক শক দিয়ে তাকে আরো দ্রুত শেখানো যায় কী না সেটা পরীক্ষা করা। ইলেকট্রিক শক দেওয়ার একটা যন্ত্রও আলাদাভাবে তৈরি করা আছে–এটা শুরু হয় 45 দিয়ে এবং 15 ভোল্ট করে বাড়াতে বাড়াতে 450 ভোল্ট পর্যন্ত যাওয়া যায়। 45 ভোল্টের ইলেকট্রিক শক প্রায় বোঝাই যায় না কিন্তু সেটা বাড়তে বাড়তে যদি 450 ভোল্ট হয়ে যায় তাহলে সেটা ভয়াবহ–রীতিমতো মেরে ফেলার অবস্থা!