এখন পর্যন্ত যতগুলো উদাহরণ দেয়া হয়েছে তার সবগুলোই হলো ইচ্ছে করে কিংবা ভুল করে ভুল তথ্য দিয়ে বিজ্ঞানীদের বিভ্রান্ত করা। এর বাইরেও কিছু উদাহরণ আছে যেখানে রসিকতাপ্রিয় বিজ্ঞানীরা শুধুমাত্র তামাশা করার জন্যে জার্নালে গবেষণা পত্র প্রকাশ করেছেন। এর মাঝে সবচেয়ে বিখ্যাত ঘটনার নায়ক এলেন সোকাল নামে একজন পদার্থবিজ্ঞানী। তিনি শুধুমাত্র ঠাট্টা করার জন্যে গাল ভরা শব্দ দিয়ে ভরাট করে একটা পুরোপুরি অর্থহীন একটা পেপার লিখে প্রকাশ করার জন্যে সেটা ডিউক ইউনিভার্সিটি প্রেস থেকে প্রকাশিত একটা জার্নালে পাঠিয়ে দিলেন। জার্নালের বড় বড় সম্পাদকরা সেটা ছাপিয়েও দিলেন–এলেন সোকাল তখন তার এই রসিকতাটুকু ফাঁস করে দিলেন। সারা পৃথিবীর শিক্ষাবিদরা তখন যে অট্টহাস্য করেছিলেন এখনো সেটা শুনতে পাওয়া যায়। প্রায় একই ধরনের কাণ্ড করেছিল এম. আই. টি.-এর কিছু ছাত্র। তারা একটা কম্পিউটার প্রোগ্রাম লিখেছে যেটা বৈজ্ঞানিক পেপার লিখতে পারে। কিছু বৈজ্ঞানিক শব্দ ব্যবহার করে সেটি এমন কিছু লিখে ফেলতে পারে যেটা পুরোপুরি অর্থহীন কিন্তু দেখায় সত্যিকারের গবেষণা পেপারের মতো। সাইজেন (SCIGEN) নামে সেই প্রোগ্রামটি ব্যবহার করে তারা একটা পেপার লিখে তারা একটা কনফারেন্সে পাঠিয়ে দিলেন, সেখানে সেটা ছাপাও হয়ে গেল! ছাত্ররা যখন তাদের রসিকতাটুকু প্রকাশ করেছে তখন সেই কনফারেন্সের বড় বড় কর্মকর্তাদের মুখ দেখানোর উপায় নেই!
বিজ্ঞানের মতো এত গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারটা নিয়ে শুধু যে বিজ্ঞানীরাই ভুল-ভ্রান্তি করে ফেলেন তা নয়–তাদের অন্য এক ধরনের শত্রু আছ, সেটা হচ্ছে প্রচারলোভী কিছু মানুষ কিংবা প্রতিষ্ঠান। আমরা সবাই জানি পৃথিবীর মানুষ 1969 সালে চাঁদে গিয়েছিল। সেটা একই সাথে ছিল বিজ্ঞান, প্রযুক্তি আর মানুষের দুঃসাহসের একটা চমৎকার উদাহরণ। 2001 সালে যুক্তরাষ্ট্রের ফক্স টেলিভিশন হঠাৎ করে একটা বিশাল অনুষ্ঠান প্রচার শুরু করল যেখানে তারা প্রমাণ করার চেষ্টা করল পৃথিবীর মানুষ আসলে কখনোই চাঁদে যায় নি। পুরোটাই নাসার একটা ধাপ্পাবাজি।
এরকম উদ্ভট একটা ব্যাপার যে ঘটতে পারে সেটা অবিশ্বাস্য কিন্তু মজার ব্যাপার হলো পৃথিবীর অনেক মানুষ সেটা বিশ্বাস করে ফেলল! ফক্স টেলিভিশনের সেই অনুষ্ঠানেই যেসব যুক্তি দেয়া হয়েছিল তার সবগুলোই হচ্ছে অত্যন্ত দুর্বল এবং খোঁড়া যুক্তি, অনুষ্ঠানটা প্রচার করা হয়েছিল শুধুমাত্র একটা হইচই সৃষ্টি করে তাদের চ্যানেলের রেটিং বাড়ানোর জন্যে-সোজা কথায় কিছু পয়সা কামাই করার জন্যে!
কাজেই আমরা যারা বিজ্ঞানকে অত্যন্ত পূতপবিত্র মহান একটা বিষয় হিসেবে জানি তাদেরকেও খুব সতর্ক থাকতে হয়। পৃথিবীর অনেক ধুরন্ধর মানুষ বিজ্ঞানকে অপবিজ্ঞানে রূপ দিয়ে কোথাও নামধাম এবং কোথাও টু-পাইস কামিয়ে নেয়ার চেষ্টা করছে।
যারা সত্যিকার বিজ্ঞানী তাদের এ ধরনের ফাঁদে পা দেয়ার কোনো ভয় নেই, অন্যদের একটু সতর্ক করে রাখা ভালো।
০২. হাইপেশিয়া
আজ থেকে প্রায় পঁয়ত্রিশ বছর আগে আমি যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্থবিজ্ঞান পড়ি তখন আমাদের ক্লাসের অর্ধেকই ছিল মেয়ে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লেখাপড়া শেষ করে আমি যখন যুক্তরাষ্ট্রে পি.এইচ.ডি. করতে যাই তখন আমাদের ক্লাসে ছাত্রী ছিল মাত্র একজন। আমি বেশ অবাক হয়েছিলাম–আমার ধারণা ছিল “উন্নত দেশে নিশ্চয়ই বিজ্ঞান আর প্রযুক্তিতে অনেক বেশি ছাত্রী পড়ালেখা করবে। মজার কথা হচ্ছে সে দেশে গিয়ে আমি আরও বিচিত্র তথ্য আবিষ্কার করলাম, সেখানে মেয়েরা খুব ভাবনা-চিন্তা করে বিজ্ঞান আর প্রযুক্তি থেকে দূরে থাকে। সাধারণভাবে বিশ্বাস করা হয় বিজ্ঞান-প্রযুক্তি বিষয়গুলো মেয়েদের বিষয় নয়–এগুলো হচ্ছে কাঠখোট্টা ছেলেদের বিষয়! শুধু তাই নয়, কোনো মেয়ে যদি বিজ্ঞান-প্রযুক্তি বিষয় নিয়ে লেখাপড়া করে তাহলে ছেলেরা তার থেকে শত হস্ত দূরে থাকে, মেয়েটি যদি লেখাপড়ায় ভালো হয় তাহলে তো কথাই নেই, সেই মেয়েটি হয়তো বিয়ে করার জন্যে কোনো ছেলের দেখাই পাবে না!
কথাটা যদিও হালকা সুরে বলা হয়েছে কিন্তু এর মাঝে সত্যতা আছে। শুধু যে বর্তমানকালে এর সত্যতা আছে তা নয়, এটি সবসময়েই সত্যি। ছেলেরা আর মেয়েরা কখনোই সমান অবস্থায় থেকে বিজ্ঞান-প্রযুক্তি কিংবা সাধারণ শিক্ষা-দীক্ষাতে অংশগ্রহণ করতে পারল না। তাই পৃথিবীর ইতিহাসে আমরা পুরুষ বিজ্ঞানী কিংবা প্রযুক্তিবিদ যেরকম পাই মেয়েদের সেভাবে পাই না, তুলনামূলকভাবে তাদের সংখ্যা অনেক কম। ইদানীং তবু চোখে পড়ার মতো মহিলা বিজ্ঞানী এবং প্রযুক্তিবিদ দেখা যায়, অতীতে বা মধ্যযুগে তাদের সংখ্যা ছিল একেবারেই হাতেগোনা।
সুদূর অতীতে–আজ থেকে প্রায় দেড় হাজার বছরের আগে এরকম একজন মহিলা বিজ্ঞানী ছিলেন, তার নাম ছিল হাইপেশিয়া (Hypatia)। তিনি এমন একজন অসাধারণ মহিলা ছিলেন যাকে এতকাল পরেও অত্যন্ত শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করা হয়। যে সময়ের কথা বলা হচ্ছে সেই সময়ে মেয়েদের লেখাপড়া করার বা অন্য কিছু করার সুযোগ দূরে থাকুক তাদেরকে সামান্য সম্মানটুকুও দেয়া হতো না। সত্যি কথা বলতে কী সে সময়ে মেয়েরা ছিল পুরুষদের সম্পত্তি! সেই সময়ে হাইপেশিয়া শুধু যে একজন তুখোড় গণিতবিদ, সফল পদার্থবিজ্ঞানী, প্রতিভাময় জ্যোতির্বিদ আর নিউপ্লেটোনিক দর্শন ধারার প্রধান ছিলেন তা নয়, তিনি ছিলেন আলেকজান্দ্রিয়া লাইব্রেরির শেষ গবেষক।