দেখা গেছে বুদ্ধিমান প্রাণীরা দল বেঁধে সামাজিক পরিবেশে থাকতে পছন্দ করে। পাখিদের বেলায় এটা সত্যি–তার সবচেয়ে বড় প্রমাণ হচ্ছে শীতকালের পাখি! শীতের সময় শীতল দেশের পাখিরা দল বেঁধে উড়ে উড়ে আমাদের দেশে চলে আসে। এই হাজার হাজার মাইল উড়ে আসার সময় পাখিরা যে শৃঙ্খলা দেখায় তার কোনো তুলনা নেই। দল বেঁধে থাকা পাখিদের মাঝে কাক যে একেবারে এক নম্বর সে ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই। কেউ যদি আমার কথা অবিশ্বাস করে তাহলে তাকে বলব কোনোভাবে একটা কাককে জ্যান্ত অবস্থায় ধরে ফেলতে, তাহলে সেই কাককে উদ্ধার করার জন্যে সারা শহরের যত কাক রয়েছে সবাই ছুটে এসে তারস্বরে চিৎকার করা শুরু করবে, তাদের আপনজনকে ছুটিয়ে নেয়ার জন্যে এমন কাণ্ড শুরু করবে যে তার থেকে মুক্তি পাবার কোনো উপায় নেই!
একটা প্রাণী যখন বুদ্ধিমত্তায় উপরের দিকে থাকে তখন কিন্তু শুধু খাওয়া আর বংশবৃদ্ধিতে তারা সন্তুষ্ট থাকে না, তারা আনন্দও করতে চায়। আনন্দ করার একটা প্রধান উপায় হচ্ছে খেলা–এবং পাখিরা প্রায় সময়েই নিজেরা নিজেরা খেলে। একটা ঢালু জায়গায় ছোট বাচ্চারা এসে গড়িয়ে গড়িয়ে নিচে পড়ত, একটা কাক গভীর মনোযোগ দিয়ে সেটা লক্ষ করল। তারপর যখন কেউ নেই! তখন দেখা গেল কাকটা একটা টিনের কৌটা এনে সেই ঢালু জায়গায় ছেড়ে দিচ্ছে–সেটা গড়িয়ে গড়িয়ে নিচে পড়ে যাবার পর কাকটা আবার উপরে তুলে এনে ছেড়ে দিচ্ছে, টিনের কৌটাটা তখন আবার গড়িয়ে পড়ছে। হাত নেই বলে সেই কাক হাততালি দিয়ে আনন্দ প্রকাশ করতে পারে নি কিন্তু যারা দেখেছে তারা সেই আনন্দটুকু সত্যিই অনুভব করতে পেরেছে!
পাখিদের বুদ্ধিমত্তার যতগুলো উদাহরণ আছে তার মাঝে সবচেয়ে চমকপ্রদ উদাহরণটি তৈরি করেছে ল্যাবরেটরিতে পোষা একটি কাক, তার নাম হচ্ছে বেটি। বুদ্ধিমত্তার নানা পরীক্ষা করার কারণেই কী না কে জানে, বেটির বুদ্ধির কোনো তুলনা নেই। তার বুদ্ধির পরীক্ষা করার জন্যে একটা কাচের সরু গ্লাসের ভেতর আরেকটা কৌটা রাখা হলো, তার উপরে একটা আংটার মতো রয়েছে। গ্লাসটা একটু গভীর তাই কাক ঠোঁট দিয়ে আংটাটা নাগাল পায় না, নানাভাবে চেষ্টা করেও সে হাল ছেড়ে দিল না। খুঁজে পেতে এক টুকরো তার নিয়ে এসে সেটা মুখে লাগিয়ে আংটাটা টেনে তোলার চেষ্টা করল–কিন্তু সোজা তার আংটাতে আটকানো যায় না, চেষ্টা করে কোনো লাভ হলো না।
তখন বেটি নামের কাকটি যে কাজ করল সেটি অবিশ্বাস্য, তারটার এক মাথা এক জায়গায় আটকে চাপ দিয়ে সেই অংশটা বঁড়শির মতো বাঁকিয়ে ফেলল। তারপর ঠোঁট দিয়ে বঁড়শির মতো অংশটা নিচে নামিয়ে সেটা দিয়ে আংটাটা ধরে টেনে বের করে আনল! পুরো ঘটনার ভিডিওটা ইন্টারনেটে আছে, কেউ যদি আমার কথা বিশ্বাস না করে সেটা নিজের চোখে দেখতে পারে।
আমরা সবাই কলসির তলায় একটুখানি পানি এবং তৃষ্ণার্ত কাকের সেই গল্পটি পড়েছি যেখানে তৃষ্ণার্ত কাক কলসির ভেতর পাথরের টুকরো ফেলে পানিটাকে উপরে নিয়ে এসে সেই পানি খেয়েছে। আমরা এতদিন জানতাম এটা ঈশপের কাল্পনিক গল্প।
এখন বিজ্ঞানীরা ভাবছেন এটা হয়তো কাল্পনিক গল্প নয়। ঈশপ হয়তো আসলেই এরকম কিছু একটা দেখেছিলেন।
১৬. স্কিতজোফ্রেনিয়া
শুনে অবিশ্বাস্য মনে হতে পারে, কিন্তু এটি সত্যি যে প্রতি একশত মানুষের মাঝে একজন স্কিতজোফ্রেনিয়াতে আক্রান্ত হয়। একজন মানুষ যখন তার শৈশব শেষ করে যৌবনে প্রবেশ করে সাধারণত তখন এটি দিয়ে আক্রান্ত হয়। পুরুষ আর মহিলারা প্রায় সমান সমানভাবে আক্রান্ত হলেও একজন পুরুষ সাধারণত আগে এবং আরো কঠিনভাবে আক্রান্ত হয়। স্কিতজোফ্রেনিয়া নামটি কঠিন মনে হতে পারে কিন্তু সারা পৃথিবীতে প্রায় আড়াই কোটি মানুষ এটিতে ভুগছে। স্কিতজোফ্রেনিয়া শব্দটির অর্থ খণ্ডিত মন, একজনের মনকে খণ্ডিত করে কখনো কখনো দ্বৈত ব্যক্তিত্ব দেখা যায়–এটি সেই বিষয় নয়। এখানে খণ্ডিত মন বলতে বোঝানো হচ্ছে বাস্তব জগৎ থেকে মনকে খণ্ডিত করে নিয়ে আসা, যেখানে চিন্তা ভাবনাগুলো হয় এলোমেলো, পরিচিত জগৎটাকে মনে হয় দুর্বোধ্য এবং অনুভূতিগুলো হয় সঙ্গতিহীন।
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে আমাকে প্রায় নিয়মিতভাবেই কোনো না কোনো ছাত্রছাত্রীর সাথে মুখোমুখি হতে হয়। যাদের মানসিক জগৎটুকু অন্যরকম, প্রায় সময়েই তারা অজানা আতঙ্কে ভুগে, বিনা কারণেই গভীর বিষাদে ডুবে থাকে, নিদ্রাহীন যন্ত্রণাকাতর রাত কাটায়। কাউকে কাউকে শুধুমাত্র বুঝিয়ে সুঝিয়ে শান্ত করা যায়, কাউকে কাউকে ডাক্তারের কাছে নিতে হয়, মানসিক চিকিৎসকের কাছে পাঠাতে হয়। আমি নিশ্চিত, সাহস করে আমাদের কাছে আসে না। কিন্তু ভেতরে ভেতরে গভীর মানসিক যন্ত্রণায় ভুগছে এরকম ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা খুব নয়। মানসিক বিষাদ, অস্থিরতা বা ডিপ্রেশন যদি সর্দি-কাশির সাথে তুলনা করি তাহলে স্কিতজোফ্রেনিয়া হচ্ছে ক্যান্সার বা এইডসের মতো ভয়াবহ একটা বিষয়।
এলোমেলো চিন্তার বিষয়টা একজন স্কিতজোফ্রেনিয়া আক্রান্ত মানুষের কথা শুনলেই বোঝা যায়। তাদের কথাবার্তা হয় অসংলগ্ন, একটা বিষয় নিয়ে কথা বলতে বলতে কথার মাঝখানে তারা অন্য বিষয় নিয়ে কথা বলতে শুরু করতে পারে। এমন কী একটা বাক্যের মাঝখানেই। আরেকটা বাক্য বলতে শুরু করে দেয়। সাধারণ মানুষের একটা অসাধারণ ক্ষমতা আছে যেটা আমরা সবাই জানি কিন্তু আলাদা করে ভেবে দেখি নি। একটা ভিড়ের মাঝে যখন অনেক মানুষ কথা বলছে তার মাঝেও আমরা একটা নির্দিষ্ট মানুষের সাথে কথা বলতে পারি কারণ আমাদের মস্তিষ্ক অসংখ্য মানুষের কথাবার্তার মাঝে থেকে শুধু নির্দিষ্ট মানুষের কথাটুকু বের করে আনতে পারে। দেখার মাঝেও সেটা হতে পারে, সামনে অনেক কিছু থাকলেও আমরা যেটা দেখতে পাই শুধু সেটার দিকে মনোযোগ দিয়ে সেটা দেখতে পারি। যারা স্কিতজোফ্রেনিয়ায় ভুগে তারা অনেক সময় এটা করতে পারে না, নির্দিষ্ট একটা বিষয়ে মনোযোগ ধরে রাখতে পারে না। তুচ্ছ একটা বিষয় তাদের মনোযোগ সরিয়ে নিতে পারে কাজেই তাদের চিন্তাগুলো হয়ে যায় পুরোপুরি অসংলগ্ন । আমরা যে রকম সহজে আমাদের চারপাশের ভুবনটুকু দেখতে পারি, শুনতে পারি বা অনুভব করতে পারি স্কিতজোফ্রেনিয়া সেরকম দেখতে, শুনতে বা অনুভব করতে পারে না। তাদের শুধু যেটুকু দেখা, শোনা বা অনুভব করার কথা তার বাইরেও আরো অনেক জঞ্জাল দেখতে হয়, শুনতে হয় বা অনুভব করতে হয়।