চোখের মতোন এমন চমকপ্রদ একটা জিনিসের সমালোচনা যদি করা হয় তাহলে সমালোচকরা আক্কেল দাঁতের কেন সমালোচনা করবে না? সেটা তারা করতেই পারে কারণ আমরা সবাই কখনো না কখনো এই আক্কেল দাঁতের সমস্যায় ভুগেছি। মানুষের মুখের ভেতর আক্কেল দাঁত ঠিকভাবে গজানোর জায়গা নেই–মুখের এক্সরে নিলে অবধারিতভাবে দেখা যায় সেটা বাঁকা হয়ে বের হচ্ছে, মাড়ি ভেদ করে বের হতে পারছে না এবং এ নিয়ে যন্ত্রণার কোনো শেষ নেই। মানুষ যদি তার আক্কেল দাঁতের মতো সহজ একটা বিষয়ের সমস্যা সমাধান করতে না পারে তাহলে আরো কঠিন কঠিন সমস্যার সমাধান কেমন করে করবে?
কঠিন একটা সমস্যা হতে পারে মানুষের এপেনডিক্স। আমরা সবাই নিশ্চয়ই কখনো না কখনো আমাদের পরিচিত মানুষের এপেন্ডিসাইটিস অপারেশনের কথা শুনেছি। আমাদের বৃহদন্তের শুরুতে ছোট একটা টিউবের মতো এই অংশটার মানুষের শরীরে কোনো কাজই নেই। মাঝে মাঝে হঠাৎ সেটার ইনফেকশান হয়ে যায়, মানুষ যন্ত্রণায় গড়াগড়ি করতে থাকে এবং পেট কেটে সেই এপেন্ডিক্সটাকে ফেলে দেয়া ছাড়া তখন কোনো আর গতি থাকে না। আরো ভয়ঙ্কর ব্যাপার ঘটে যখন এপেন্ডিক্সটাতে ইনফেকশান হয়ে সেটা ফেটে যায়, তখন সাথে সাথে অপারেশন না করলে রোগীকে বাঁচানো কষ্টকর হয়ে যায়। যে জিনিসটার কোনোই ব্যবহার নেই–যার একমাত্র কাজ হচ্ছে হঠাৎ করে ইনফেকশান হয়ে মানুষের জীবনে একটা বিপদ ঘটানো, সেটাকে পেটের ভেতর রেখে দেয়ার পিছনে যুক্তি কোথায়? সমালোচকরা যদি এর সমালোচনা করে তাহলে তাদের কী দোষ দেয়া যায়?
মানুষ দু’পায়ে দাঁড়াতে পারে কিন্তু মজার ব্যাপার হলো হিসেব কষে দেখা গেছে মানুষের শরীরের যেটুকু ওজন সেটা তাদের দুই পায়ের হাড়ের সংযোগের জন্যে তুলনামূলকভাবে অনেক বেশি। সত্যি কথা বলতে কী, যদি পা দুটি না হয়ে চারটি হতো তাহলে মোটামুটিভাবে ওজনটা ঠিক করে ভাগ করে দেয়া যেত। নিতম্বের যে অংশে পায়ের হাড় এসে সংযোগ দেয় সেই অংশের ক্ষয় মানুষের খুব পরিচিত একটা সমস্যা।
মানুষের হাঁটুর ডিজাইনটাও শরীরের জন্যে পর্যাপ্ত নয়। এখানেও বলা যায় দুটি হাঁটু না হয়ে চারটি হাঁটুতে মানুষের ওজন ছড়িয়ে দিলে হাঁটুর সমস্যা অনেক কম হতো। হাঁটু ছাড়াও কনুই, পায়ের পাতা, পেট এবং বিশেষ করে পুরুষ এবং মহিলাদের মূত্রনালিকে নিয়ে সমালোচকরা অনেক কঠিন কঠিন সমালোচনা করে থাকেন। সেগুলোর সবগুলোকে নিয়ে আলোচনা করলে বিশাল এক মহাভারত লিখতে হবে।
সেই মহাভারত লেখার যে খুব একটা প্রয়োজন আছে তা কিন্তু নয় কারণ সমালোচকদের এই সব সমালোচনাই বিজ্ঞানীরা যে মেনে নিয়েছেন তা কিন্তু নয়। তাদের অনেকেই যুক্তি দেখান যে একটা ডিজাইনকে এত সহজে খারাপ বা ভুল ডিজাইন বলা ঠিক নয়। যেটাকে আপাতদৃষ্টিতে বিচিত্র বা উদ্ভট মনে হয় সেটা কিন্তু কার্যক্ষেত্রে বিচিত্র বা উদ্ভট নাও হতে পারে। যেমন যে মানুষটি জীবনে কখনো বাইসাইকেল দেখে নি তাকে যদি একটা ছোট বাচ্চাদের ট্রাইসাইকেল আর সত্যিকারের বাইসাইকেল দেখিয়ে জিজ্ঞেস করা হয় কোন ডিজাইনটা ভালো। একেবারে গ্যারান্টি দিয়ে বলা যায় যে তারা ছোট বাচ্চাদের ট্রাইসাইকেলের ডিজাইনটাকে বেছে নেবে, তারা কল্পনাও করতে পারবে না যে আসলে দুই চাকার বাইসাইকেল অনেক দক্ষ এবং সুশৃঙ্খল যন্ত্র। কাজেই কখনোই একটা ডিজাইনকে এত সহজে খারাপ ডিজাইন বলার আগে সেটাকে আরো অনেক খুঁটিয়ে দেখা দরকার।
প্রচলিত বিশ্বাস যে সবকিছুই এসেছে বিবর্তনের ভেতর দিয়ে। একটা নির্দিষ্ট পরিবেশে টিকে থাকার জন্যে বিবর্তনের ভেতর দিয়ে প্রাণী জগৎ নিজেদের পরিবর্তন করে নিয়েছে কিংবা নিচ্ছে। অনেক জায়গাতেই আমরা রয়েছি পরিবর্তন প্রক্রিয়ার ঠিক মাঝখানে, তাই দেখতে পাচ্ছি আমাদের হিসেব মিলছে না। অনেক সময়েই পরিবেশের সাথে টিকে থাকার জন্যে কোনো একটা সমাধান বলতে গেলে জোর করে চলে এসেছে যেটাকে এখন মনে হয় খাপছাড়া বা অগোছালো।
তবে মজার ব্যাপার হচ্ছে, যারা ধর্ম দিয়ে বিজ্ঞান বোঝার চেষ্টা করেন তারা কিন্তু মানুষের শরীরের ডিজাইনে ত্রুটির বিষয়টি মানতেই চান না, তাদের ধারণা সেটা মেনে নিলে ধর্মটাকে খাটো করে দেখা হয়। তাই তারা এই বিষয় নিয়ে ক্রমাগত চেঁচামেচি করে যাচ্ছেন–বিতর্কটা তাই জমে উঠেছে বেশ ভালোভাবেই।
১৫. ঈশপের সেই কাক
পাখিদের জন্যে আমাদের এক ধরনের স্নেহ আছে। কী চমৎকারভাবে তারা ডানা মেলে আকাশে ওড়ে, তাদের গায়ে কত বিচিত্র রং। গাছের ডালে পাখি যখন কিচিরমিচির করে ডাকে আমরা তখন সাগ্রহে এবং সস্নেহে তাদের দিকে তাকাই।
কিন্তু কাক? সর্বনাশ! আমরা কাককে কেউ দুই চোখে দেখতে পারি না। কাকও পাখি কিন্তু পাখির জন্যে রাখা এতটুকু স্নেহ কাকের কপালে জোটে না। কেন জুটবে? তাদের কালো কুৎসিত গায়ের রং, কর্কশ গলার আওয়াজ। কা কা করে ডেকে তারা কান ঝালাপালা করে দেয়। আচার আচরণ মোটেও সুবিধে নয়। রাজ্যের নোংরা ঘাটাঘাটি করায় তাদের কোনো ক্লান্তি নেই, উচ্ছিষ্ট খাবার কিংবা মরা ইঁদুর–কোনো কিছুতেই তাদের অরুচি নেই। এ রকম একটা প্রাণীর জন্যে বুকের ভেতর কী ভালোবাসা জন্মানো যায়? কেউ কী কাকদের সম্পর্কে একটি ভালো কথাও বলতে পারবে?