এইডস রোগটি কোথা থেকে এসেছে, তার ভাইরাস এইচ.আই.ভি. কেমন করে পৃথিবীতে জন্ম নিয়েছে সেটা নিয়ে বিজ্ঞানী এবং গবেষকদের কৌতূহলের শেষ নেই। এটা নিয়ে নানা ধরনের ধারণা প্রচলিত আছে। বলাই বাহুল্য অনেকগুলো ধারণার মাঝে একটি হচ্ছে পাপীদের শাস্তি দেওয়ার জন্যে খোদার দেয়া একটি গজব! তবে বিজ্ঞানীরা এই মুহূর্তে যে ধারণাটি সবচেয়ে বেশি বিশ্বাসযোগ্য বলে ভাবছেন সেটি হচ্ছে এটি শিম্পাঞ্জি থেকে মানুষের কাছে এসেছে। শিম্পাঞ্জির শরীরে যখন এই ভাইরাসটি ছিল তখন কিন্তু এটি মোটামুটি একটা নিরীহ ভাইরাস হিসেবেই ছিল। ধারণা করা হয় আফ্রিকার ক্যামেরুনে কোনো একজন শিকারি শিম্পাঞ্জিকে শিকার করার সময় তার শরীরে কোনো একটা ক্ষত সৃষ্টি হয়ে সেখানে শিম্পাঞ্জির শরীরে থাকা ভাইরাসটির সংক্রমণ হয়। মানুষের শরীরে এসে ভাইরাসটি নিজেকে খানিকটা পরিবর্তন করে নিয়ে যে রূপটি গ্রহণ করে সেটাই হচ্ছে ভয়ঙ্কর এইচ.আই.ভি. । ধারণা করা হয়, 1955-60-এর মাঝে এইডস আক্রান্ত প্রথম মানুষটি ডাক্তারদের শরণাপন্ন হয়, যদিও রোগটি কী সেটা ডাক্তারেরা তখনো অনুমান করতে পারেন নি। বহু দেশ এবং বহু মানুষ ঘুরে এটা শেষ পর্যন্ত যখন উন্নত মানুষের দেশে এসে হানা দেয় তখন সবার টনক নড়তে শুরু করে–1981 সালে এটাকে মহামারি বিবেচনা করে ঘোষণা দেয়া হয়। ফরাসি এবং আমেরিকান বিজ্ঞানীরা 1983 এবং 1984 সালে প্রথমবার এই ভাইরাসটিকে শনাক্ত করে ভিন্ন ভিন্ন নাম দেন। বিজ্ঞানীদের কোন্দল মেটানোর জন্যে 1986 সালে আন্তর্জাতিকভাবে এটার নূতন নাম দেয়া হয় Human Immunodeficiency Virus সংক্ষেপে এইচ.আই.ভি. (HIV)–যে ফরাসি বিজ্ঞানীরা এইচ.আই.ভি. আবিষ্কার করেছেন 2008 সালে তাদের নোবেল পুরস্কার দেয়া হয়।
এইচ.আই.ভি. একটা ভাইরাস এবং এইডস একটি রোগ কিন্তু এর পিছনে বর্তমান পৃথিবীর সবচেয়ে বড় শোকগাথাটি লুকিয়ে আছে । উন্নত বিশ্ব তাদের দেশে এইডসের সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ করে ফেলেছে। এটি রক্ত দেয়ার মাধ্যমে সংক্রামিত হতে পারে তাই সেসব দেশে সব রক্তই প্রথমে এইচ.আই.ভি.-এর জন্যে পরীক্ষা করে নেয়া হয়। এটা দৈহিক মিলনের ভেতর দিয়েও ছড়াতে পারে তাই সেখানেও ঝুঁকি নেয়া হয় না। মায়ের দুধ খেয়ে সন্তানের শরীরে এইচ.আই.ভি. যেতে পারে তাই মা’দের সে বিষয়ে সতর্ক করা হয়। যে সমস্ত মানুষ অনিয়ন্ত্রিত জীবনযাপন করে, ড্রাগ নেবার সময় একে-অন্যের সিরিঞ্জ ব্যবহার করে তারাই এখন অবিবেচক হিসেবে এই ভাইরাসটি সীমিত আকারে ছড়িয়ে যাচ্ছে।
কিন্তু আফ্রিকা মহাদেশে এটি সম্পূর্ণ অন্য একটি ব্যাপার। সারা পৃথিবীতে এখন তিন থেকে সাড়ে তিন কোটি মানুষের শরীরে এইচ.আই.ভি. ভাইরাস–তার মাঝে দুই থেকে আড়াই কোটি মানুষ হচ্ছে আফ্রিকার। সারা পৃথিবীর এইচ.আই.ভি. বহনকারী মানুষের 65 শতাংশই হচ্ছে আফ্রিকার। আফ্রিকার দক্ষিণাঞ্চলে এমন কিছু দেশ আছে যেখানে প্রতি তিনটি মানুষের মাঝে একজন এইচ.আই.ভি. বহন করে। যদিও এইচ.আই.ভি সংক্রমণের প্রায় দশ বছর পর পূর্ণাঙ্গ এইডস দেখা দেয় তারপরেও সেই সব দেশে মৃত্যু এসে হানা দিয়েছে। অসংখ্য মানুষ মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাছে, হাসপাতালে, বাড়িতে ধুকে ধুকে মৃত্যুর জন্যে অপেক্ষা করছে। এখানে মৃত্যু এসে হানা দেয় একজন মানুষের পূর্ণ জীবনের ঠিক মাঝখানে তাই সেখানে লক্ষ লক্ষ অনাথ শিশু–তাদের দেখার কেউ নেই। সেই অনাথ শিশুদের একটা বড় অংশ নিজেরাই এইচ.আই.ভি. বহন করছে, কারো কারো এইডস হয়েছে এবং লক্ষ লক্ষ শিশু এর মাঝে এইডসে মারা গিয়েছে। কর্মক্ষম মানুষ কমে আসায় দেশের অর্থনীতি মুখ থুবড়ে পড়ছে, পুরো সমস্যাটা এখন চক্রবৃদ্ধি হারে বেড়ে যাচ্ছে। ভবিষ্যতে এই মহাদেশটির কী হবে কেউ জানে না।
এতক্ষণ আফ্রিকার এইডস নিয়ে যে কথাগুলো বলা হলো সেগুলো আসলে ভূমিকা মাত্র সত্য কথাটা এখনো বলা হয় নি। সত্য কথাটি আরো অনেক ভয়ঙ্কর–সেটি হচ্ছে আফ্রিকার এই দেশগুলো এখনো এই সমস্যাটিকে স্বীকার করে নিতে প্রস্তুত নয়। রাজনৈতিক নেতা, সামাজিক কর্মী, সুশীল সমাজ সবাই ভান করে যাচ্ছেন যে এটা ঘটে নি। সাউথ আফ্রিকার মতো একটা উন্নত দেশও এটাকে অস্বীকার করে পশ্চিমা ষড়যন্ত্র হিসেবে চালিয়ে দেয়ার চেষ্টা করছে সেই দেশে এইডস কথাটি কেউ মুখে উচ্চারণ করে না, কারো ডেথ সার্টিফিকেটে মৃত্যুর কারণ হিসেবে “এইডস” শব্দটি লেখা হয় না। এইডস হওয়ার পর শেষ পর্যন্ত মারা যায় যক্ষ্মা, নিমোনিয়া, গণরিয়া এরকম পরিচিত রোগে, কাজেই সেটাকেই মৃত্যুর কারণ হিসেবে দেখা হয়। এইচ.আই.ভি. সংক্রমণ বা এইডস এর যেহেতু সত্যিকার চিকিৎসা বা ভেক্সিন নেই তাই এটাকে থামানোর একটাই উপয়, সেটা হচ্ছে কিছু নিয়ম-কানুন মেনে চলা। আফ্রিকাতে সেই নিয়ম-কানুনগুলোর কথা কেউ স্পষ্টভাবে উচ্চারণ করে না, কেউ তার চেষ্টাও করে না, কাজেই সাধারণ মানুষের মাঝে কোনো সচেতনতা নেই। নিজের অজান্তেই তারা তাদের অনিয়ন্ত্রিত জীবনযাপন দিয়ে একে-অন্যকে এই ভয়াবহ ভাইরাসটি দিয়ে যাচ্ছেন। 2004 সালে শান্তিতে নোবেল পুরস্কার বিজয়ী আফ্রিকার প্রথম মহিলা ওয়াংগারি মাথাই পুরস্কার পাওয়ার পরের দিনই বলেছিলেন, এইচ.আই.ভি, বানর থেকে এসেছে তিনি সেটা বিশ্বাস করেন না। তিনি মনে করেন এইচ.আই.ভি. পশ্চিমা শক্তি যুদ্ধাস্ত্র হিসেবে তৈরি করেছে এবং এর কারণে এখন আফ্রিকার কালো মানুষ অসহায়ভাবে মারা যাচ্ছে।