এরকম আরেকটি বৈজ্ঞানিক জয়াচুরির নাম হচ্ছে কার্ডিফের দানব। 1869 সালে জর্জ হাল একটা বিশাল জিপসাম খণ্ডের মাঝে প্রায় দশ ফুট লম্বা একটা মানুষের শরীর খোদাই করে সেটাকে প্রাচীন ফসিলের রূপ দিয়ে কার্ডিকে মাটির নিচে লুকিয়ে রাখলেন। তারপর তার নিজের কিছু শ্রমিকদের ব্যবহার করে সেটাকা আবিষ্কার করার একটা নাটক করলেন। দশ ফুট লম্বা মানুষের পাথর হয়ে থাকা শরীর নিয়ে সারা পৃথিবীতে বিশাল হইচই। মানুষ টিকেট কিনে সেটা দেখতে যেত। শেষ পর্যন্ত নিজেদের মাঝে ঝগড়া হওয়ার কারণে ব্যাপারটা প্রকাশ হয়ে যায়। কার্ডিফের দানবের সেই দেহটি এখনো সযত্নে রক্ষা করা আছে, মানুষজন এখনো সেটা দেখতে পায় তবে বৈজ্ঞানিক কৌতূহলের জন্যে নয় জুয়াচুরির একটি উদাহরণ দেখার জন্যে।
এ ধরনের জুয়াচুরি যে শুধু অতীতে ঘটেছে তা নয়–অতি সাম্প্রতিককালেও সেটা ঘটেছে। একটা বিখ্যাত উদাহরণ হচ্ছে ফিলিপাইনের তাসাডে সম্প্রদায়। 1971 সালে ফিলিপাইনের একজন মন্ত্রী তাদের একটা দ্বীপে এই সম্প্রদায়কে খুঁজে পেলেন যারা সেই প্রস্তর যুগ থেকে লোকচক্ষুর আড়ালে লুকিয়ে আছে, সভ্য জগতের সাথে তাদের কোনো সম্পর্ক নেই। তারা খুব শান্ত প্রকৃতির, গায়ে কোনো কাপড় নেই, উলঙ্গ হয়ে ঘুরে বেড়ায়। সারা পৃথিবীতে হইচই পড়ে গেল, ন্যাশনাল জিওগ্রাফিতে তাদের উপর বিশাল নিবন্ধ ছাপা হলো।
আসলে পুরোটাই হলো জুয়াচুরি। কিছু মানুষকে টাকা-পয়সা দিয়ে প্রস্তর যুগের মানুষ হিসেবে সাজিয়ে সারা পৃথিবীর বিজ্ঞানীদের ধোঁকা দেয়া হয়েছিল! ফিলিপাইনের সেই মন্ত্রী তাসাডে সম্প্রদায় রক্ষা কমিটি করে লক্ষ লক্ষ টাকা কামিয়ে প্রেসিডেন্ট মার্কোসের পতনের পর দেশ থেকে পালিয়ে গেলেন।
একজন খুব সম্পদশালী মানুষ তার নিজেকে ক্লোন করেছে এরকম একটা খবর 1978 সালে আমি টাইম পত্রিকায় দেখেছিলাম। ডেভিড ররভিক নামে যে মানুষটি এই তথ্য পরিবেশন করেছিল কেউ তার কথা বিশ্বাস করে নি–তারপরেও সে এই জুয়াচুরি করে লক্ষ লক্ষ টাকা কামাই করে ফেলেছিল।
একেবারে খাঁটি বিজ্ঞানীরাও যে জুয়াচুরি করেন পৃথিবীর ইতিহাসে তার উদাহরণও আছে। সাউথ কোরিয়ার বিখ্যাত জীববিজ্ঞানী হোয়াং উ সাক এরকম একজন মানুষ। সারা জীবনের পরিশ্রমে তিনি যেটুকু অর্জন করেছিলেন 1978 সালে তার পুরোটুকুই ধুলায় মিশে গেল যখন জানা গেল তার গবেষণার বড় অংশই হচ্ছে জালিয়াতি। তিনি গবেষণার যে 11টি ফলাফল প্রকাশ করেছিলেন তার 9টির কোনো অস্তিত্বই নেই, পুরোটাই বানানো।
ভুল গবেষণার ফলাফল শুধু যে অসৎ বিজ্ঞানীরা প্রকাশ করেন তা নয় অনেক সময় খাঁটি বিজ্ঞানীও সেটা নিজের অজান্তেই করে ফেলেন! এরকম একজন বিজ্ঞানীর নাম ব্লাস কাবেরা। তিনি দীর্ঘদিন থেকে ম্যাগনেটিক মনোপোল নামে প্রকৃতির একটি রহস্যময় জিনিস খুঁজে বেড়াচ্ছেন। প্রকৃতিতে যদি এর অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায় তাহলে পুরো পদার্থবিজ্ঞানের ইতিহাস অন্য রকম করে লিখতে হবে। অনেক বড় বড় বিজ্ঞানীর ধারণা এটা আছে, শুধুমাত্র এখনো খুঁজে পাওয়া যায় নি। তাই 1982 সালের 14 ফেব্রুয়ারি ভ্যালেন্টাইনের ভালোবাসার দিনে যখন সেটা খুঁজে পাওয়া গেল তখন সারা পৃথিবীতে হইচই পড়ে গেল। বিজ্ঞানী ব্লাস কাবেরা রাতারাতি জগদ্বিখ্যাত হয়ে গেলেন, তাকে নিয়ে কাড়াকাড়ি শুরু হয়ে গেল। পৃথিবীর সব ল্যাবরেটরি তখন সেই ম্যাগনেটিকে মনোপোল খোঁজার কাজে লেগে গেল–কিন্তু কেউ আর সেটা খুঁজে পেল না, ব্লাস কাবেরার সেই একমাত্র গবেষণার ফলাফলটিকে এখন একটা বৈজ্ঞানিক ভুল হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
তবে যে বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা নিয়ে সবচেয়ে বেশি হইচই হয়েছিল সেটার নাম কোল্ড ফিউসান। নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্লান্টে বড় বড় নিউক্লিয়াসকে ভেঙে ছোট টুকরো করে শক্তি বের করা হয়। এভাবে শক্তি তৈরি করার পর যে তেজস্ক্রিয় বর্জ্য তৈরি হয় সেটি থেকে শুধু এই পৃথিবী নয় পুরো সৃষ্টি জগতের মুক্তি নেই। কিন্তু যদি ছোট ছোট নিউক্লিয়াসকে একত্র করে একটু বড় নিউক্লিয়াস তৈরি করে শক্তি বের করা হয় সেটি অত্যন্ত নিরাপদ। শুধু তাই নয় তার জ্বালানি হিসেবে খুব সহজেই হাইড্রোজেনের মতো অতি সহজে পাওয়া যায় এরকম মৌল ব্যবহার করা যায়। এই পদ্ধতিটির নাম ফিউসান এবং ফিউসান ঘটানোর জন্যে হালকা নিউক্লিয়াসগুলোকে ভয়ঙ্কর গতিতে একের সাথে অন্যকে আঘাত করতে হয়। তার জন্য যে তাপমাত্রা দরকার সেই তাপমাত্রা ধারণ করার মতো কোনো পাত্র নেই!
তাই 1989 সালে স্ট্যানলি পন এবং মার্টিন ফ্লিশম্যান নামে দুজন বিজ্ঞানী যখন ঘোষণা করলেন যে তারা একটা কাচের বোতলে সাধারণ তাপমাত্রায় ফিউসান প্রক্রিয়াটা ঘটিয়ে ফেলেছেন তখন সারা পৃথিবীর বিজ্ঞানী মহলে একটা আলোড়নের সৃষ্টি হয়েছিল। কারণ সত্যিই যদি এটা ঘটে থাকে তাহলে পৃথিবীতে আর শক্তির অভাব থাকবে না। সাধারণ তাপমাত্রায় এই ফিউসান ঘটে থাকে বলে এর নাম কোল্ড ফিউসান (Cold Fusion)। সারা পৃথিবীর বিজ্ঞানীরা এখন স্ট্যানলি পন আর মার্টিন ফ্লিশারম্যানের পরীক্ষাটা করে নিশ্চিত হবার চেষ্টা করলেন, কিন্তু কেউ সেটা করে নিশ্চিত হতে পারলেন না। কোটি কোটি টাকা খরচ করে শেষ পর্যন্ত বিজ্ঞানীরা রায় দিলেন পরীক্ষার ফলাফলটি ছিল ভুল!