বিষয়টা বোঝার জন্যে আমাদের ব্যাপারটা আরেকটু খুঁটিয়ে দেখতে হবে। ফ্লু হয় একধরনের ভাইরাসের কারণে। ভাইরাসের সংক্রমণ থেকে কিছু হলে আমরা আমাদের শরীরকেই তার সাথে যুদ্ধ করতে দিই, শরীর যখন যুদ্ধ করে ভাইরাসকে পরাজিত করে তখন আমাদের খুব বড় একটা লাভ হয়, আমাদের শরীরে সেই ভাইরাসের বিরুদ্ধে কাজ করার জন্যে এক ধরনের এন্টিবডি তৈরি হয়ে যায়। সেই এন্টিবডির কারণে সেই ভাইরাস আমাদের শরীরে ভবিষ্যতে আর কখনো বিশেষ সুবিধে করতে পারে না। একবার চিকেন পক্স হলে তাই আর দ্বিতীয়বার চিকেন পক্স হয় না। যদি দ্বিতীয়বার হয়েও যায় সেটা হয় খুব নিরীহ এক ধরনের চিকেন পক্স। ফ্লুটাও হয় ভাইরাস থেকে আর কোটি টাকা দামের প্রশ্ন হলো একবার ফ্লু হলেও তো আরো অনেকবার ফ্লু হতে পারে–তার কারণটা কী? ফ্লুয়ের জন্যে শরীরে কেন এন্টিবডি তৈরি হয় না? এর কারণটা খুব চমকপ্রদ। ফ্লুয়ের ভাইরাস খুব ধুরন্ধর প্রকৃতির ভাইরাস–তারা প্রতিনিয়ত তাদের চেহারা পাল্টে যাচ্ছে, কাজেই আমাদের শরীর তার সাথে তাল মিলিয়ে থাকতে পারছে না। আমাদের শরীরকে খুব সতর্কভাবে এন্টিবডি তৈরি করতে হয়–যেটা শরীরের জন্যে প্রয়োজনীয় কোনো কারণে তার বিরুদ্ধে এন্টিবডি তৈরি করে ফেললে আমরা মহাবিপদে পড়ে যাই। শরীরকে শুধুমাত্র ক্ষতিকর জিনিসের বিরুদ্ধে এন্টিবডি তৈরি করতে হয় আর কোনটা ক্ষতিকর সেটা বোঝার জন্যে শরীরের নিজস্ব কিছু পদ্ধতি আছে। ভাইরাসের বাইরের প্রোটিনের আবরণ দিয়ে তারা সেটা চিনতে পারে। ফ্লুয়ের ভাইরাসের একটা চমকপ্রদ ক্ষমতা রয়েছে, তারা যখন একজন মানুষকে আক্রান্ত করে তখন সেখানে একটুখানি চেহারা পরিবর্তন করে ফেলতে পারে (সত্যি করে বলতে হলে বলা যায় বাইরের প্রোটিনের গঠনটুকু), তাই আমাদের শরীরের প্রতিষেধক নূতন ফ্লুয়ের ভাইরাস দেখতে পেলে একটু বিভ্রান্ত হয়ে যাই। প্রতিবার যে ভাইরাসটা আসে সেটাকে নূতন একটা ভাইরাস হিসেবে বিবেচনা করে–তাই মানুষ অসংখ্যবার ফ্লু দিয়ে আক্রান্ত হতে পারে।
তবে বিষয়টাকে যত খারাপ ভাবা হচ্ছে সেটা আসলে তত খারাপ না। আমাদের শরীর ফ্লুয়ের বিরুদ্ধে আমাদের নিরাপত্তা দিতে পারছে না। কথাটুকু সত্যি কিন্তু যেটুকু দিচ্ছে সেটাও কিন্তু কম নয়। আমরা ফ্লুকে ভয়ঙ্কর রোগ হিসেবে বিবেচনা করি না, কারণ এর কারণে খুব বেশি মানুষের মৃত্যু হয় না। কিন্তু যে মানুষের শরীরে কোনো ধরনের ফ্লুয়ের এন্টিবডি নেই তাদের জন্যে এটা ভয়ঙ্কর একটা রোগ। শ্বেতাঙ্গ মানুষেরা যখন তাদের শরীরে করে এই ভাইরাস আদিবাসীদের কাছে নিয়ে গিয়েছিল, তখন আদিবাসীদের জনপদের পর জনপদ পুরোপুরি নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছিল।
ফ্লুয়ের ভাইরাসে আট টুকরো RNA আছে, যদি মানুষের শরীর দুটি ভিন্ন RNA দিয়ে আক্রান্ত হয় তাহলে RNAগুলো নিজেদের ভেতরে তাদের অংশ বিশেষ দেয়া-নেয়া করতে পারে–তার কারণে নূতন যে ভাইরাসটা তৈরি হয় সেটা আগেরটা থেকে ভিন্ন হয়ে যেতে পারে। সাধারণত নূতন ভাইরাসগুলো আগেরটা থেকে খুব বেশি ভিন্ন হয় না, তবে মাঝে মাঝে তার ব্যতিক্রম ঘটে যেতে পারে। হঠাৎ করে এমন একটা ফ্লু ভাইরাসের জন্ম হতে পারে যেটা পুরোপুরি ভিন্ন, আমাদের শরীর যেটার জন্যে একেবারেই প্রস্তুত নয়। যার ফলাফল হবে। ভয়ঙ্কর–যে রকম হয়েছিল 1918 সালে। পৃথিবীর 98 শতাংশ মানুষ এই ভাইরাস দিয়ে আক্রান্ত হয়েছিল, 28 শতাংশ মানুষের ফ্লু হয়েছিল এবং তাদের ভেতর 3 শতাংশ মানুষ মারা গিয়েছিল। মানুষের মৃত্যু হয়েছিল প্রায় 40 মিলিয়ন বা চার কোটি । 1918 সালের হিসেবে সেটা ছিল পুরো পৃথিবীর এক শতাংশ মানুষ। যে কোনো হিসেবে এই সংখ্যাটি অচিন্তনীয়।
এতক্ষণ আমরা মানুষের ফুয়ের কথা বলছিলাম, এবারে বার্ড ফ্লুয়ের মাঝে ফিরে আসতে পারি। এটি সত্যি কথা যে বার্ড ফ্লু হচ্ছে বার্ড বা পাখিদের অসুখ তাই এই অসুখটা এক পাখি থেকে অন্য পাখিদের মাঝে ঘুরে বেড়ানোর কথা। কিন্তু আমরা আগেই বলেছি ফ্লুয়ের ভাইরাস হচ্ছে ধুরন্ধর প্রকৃতির ভাইরাস, এটা এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় যাবার সময় খানিকটা পরিবর্তন হয়ে যায় এবং এই পরিবর্তনটুকু নিয়েই ভয়। কে জানে একটু-আধটু পরিবর্তন হয়ে হঠাৎ করে না পাখিদের ফ্লু মানুষের ফ্লু হয়ে যায়! মানুষের শরীর মানুষের ফ্লুয়ের জন্যে প্রতিষেধক তৈরি করে রেখেছে কিন্তু পাখির ফ্লুয়ের জন্যে তো কোনো প্রতিষেধক নেই, তাই হঠাৎ করে বার্ড ফ্লু যদি মানুষকে সংক্রমণ করতে পারে তাহলে মানুষ একেবারেই অসহায়। এই মুহূর্তে পৃথিবীর মানুষ যে বার্ড ফ্লু নিয়ে ব্যতিব্যস্ত সেটার বৈজ্ঞানিক নাম হচ্ছে H5N1, এটা মানুষের মাঝে সংক্রামিত হতে পারে। 1997 সালে এটা হংকংয়ে 18 জন মানুষকে আক্রান্ত করেছিল, তার মাঝে ছয়জনই মারা গিয়েছিল। মানুষের শরীর এই ভাইরাসের জন্যে প্রস্তুত নয়, তাই আমরা সাধারণ ফ্লুকে যেভাবে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিই এই H5N1 ভারাইসকে সেভাবে তুড়ি দিয়ে ওড়াতে পারব না। জানুয়ারি 2009 পর্যন্ত সময়টিতে সারা পৃথিবীতে 270 জন বার্ড ফ্লু দিকে আক্রান্ত হয়েছিল এবং মারা গেছে 164 জন, সংখ্যাটি হচ্ছে শতকরা ষাট জন। যে রোগে মৃত্যুর হার শতকরা ষাট জন সেই রোগটি একটি ভয়ঙ্কর রোগ–মানুষকে সেই রোগকে ভয় পেতে হয়। পৃথিবীর মানুষ তাই বার্ড ফ্লুকে ভয় পায়।