আমরা আজকাল গ্রীন হাউস এফেক্ট-এর কথা প্রায় সময়েই শুনে থাকি, ভবিষ্যতে এই প্রক্রিয়ায় আমাদের জীবনে ভয়াবহ বিপর্যয় নিয়ে আসবে সেটা নিয়ে এখন সবার ভেতরে আতঙ্ক। “গ্রীন হাউস” শব্দটাতেই এক ধরনের ভীতি, কিন্তু মজার কথা হচ্ছে প্রকৃত গ্রীন হাউস কিন্তু অত্যন্ত নিরীহ একটি ব্যাপার। শীতপ্রধান দেশে কাচের ঘর তৈরি করে তার ভেতর সাজি কিংবা ফুলের চাষ করা হয়। কাচের ঘর দিয়ে সূর্যের আলো ঢুকে, নিচে সেটা শোষিত হয়ে যখন আবার বিকীরণ করে তখন সেটা কাচ ভেদ করে যেতে পারে না, কাচের ঘরে আটকা পড়ে যায়। তাই বাইরে যখন প্রচণ্ড শীত, গ্রীন হাউসের ভেতর তখন থাকে আরামদায়ক উষ্ণতা।
যত দিন যাচ্ছে ততই নূতন নূতন কাচ তৈরি হচ্ছে। যে কাঁচটি নিয়ে এখন সবার ভেতরে এক ধরনের উত্তেজনা সেটা তৈরি হয় আয়রন ফসফেট দিয়ে। ধারণা করা হচ্ছে নিউক্লিয়ার শক্তি কেন্দ্রের তেজস্ক্রিয় বর্জ্য মিশিয়ে যদি এই কাচ তৈরি করা হয় তাহলে এই বর্জ্যগুলো সেই কাচের ভেতর এমনভাবে আটকা পড়বে যে কখনোই সেখান থেকে বের হতে পারবে না। তখন তেজস্ক্রিয় বর্জ্য সংরক্ষণের পুরো ব্যাপারটি হবে অনেক সহজ ব্যাপারটা দেখার জন্যে বিজ্ঞানী মহল বেশ আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করছে।
কাঁচ নিয়ে এখনো গবেষণা হচ্ছে, আমরা নূতন কী দেখব এখনো জানি না–খাওয়া যায় এরকম কাঁচও তৈরি হয়েছে, পরা যায় এমন কাচ নিশ্চয়ই খুব দূরের ব্যাপার নয়!
০৯. বাঁশের ফুল
রাঙ্গামাটি বেড়াতে গিয়েছি, সেখানকার স্থানীয় মানুষদের সাথে কথা বলছিলাম তাদের কাছ থেকে অত্যন্ত বিচিত্র একটা তথ্য জানতে পারলাম। তারা বললেন, এই বছর বাঁশের ফুল এসেছে এবং সেটা একটা মহাদুর্যোগের সংকেত। আমরা ফুলকে সবসময়ই সৌন্দর্যের সাথে তুলনা করি, তাই বাঁশের ফুল কেমন করে মহাদুর্যোগের সংকেত হতে পারে সেটা চট করে । বুঝতে পারছিলাম না, তাই তারা আমাদের বুঝিয়ে দিলেন।
বাঁশ পঞ্চাশ বছর পর একবার ফুল দেয়। সেই ফুল থেকে ফল হয় এবং ফল দেয়ার পর সেই বাঁশ মরে যায়। ব্যাপারটা ঘটে পঞ্চাশ বছর পর পর, শেষবার ঘটেছিল 1958 সালে, তাই এই বছরটা আবার সেই সময়। পাহাড়ি অঞ্চলে যেখানে বাঁশ জন্মায় সেখানে সবাই দেখছে বাঁশে ফুল আসতে শুরু করেছে, কিছুদিনেই সেখানে ফল হবে তারপর বাঁশগুলো মরে যাবে। বাঁশগুলো মরে গেলেই শেষ হয়ে যাবে না, মৃত্যুর আগে তারা শেষ যে ফলগুলো দিয়ে গেছে সেই ফলের বিচি থেকে জন্ম নেবে নূতন বাশ গাছ। আগামী পঞ্চাশ বছর সেই বাশ গাছ বেঁচে থাকবে–বাঁশঝাড় থেকে জন্ম নেবে নূতন বাঁশ গাছ, তারপর আরও পঞ্চাশ বছর পর আবার ফুল হবে, সেই ফুল থেকে ফল হয়ে আবার সব বাঁশ মরে যাবে। শত শত বৎসর থেকে এটা ঘটে আসছে।
যারা পাহাড়ি মানুষ তারা নানাভাবে বাঁশের উপর নির্ভর করে থাকে, হঠাৎ করে সেই বাঁশ যদি উজাড় হয়ে যায় তাহলে তাদের ওপর দুর্যোগ নেমে আসতেই পারে। কিন্তু রাঙ্গামাটির স্থানীয় মানুষেরা যে মহাদুর্যোগের কথা বলছিলেন সেটা এই বাঁশের উজাড় হয়ে যাওয়া নয়, সেটা অন্য একটা মহাদুর্যোগ।
তারা বললেন, বাঁশের ফুল থেকে যে ফল হয় সেটা ইঁদুরের খুব প্রিয় একটা খাবার। তাই ইঁদুর খুব শখ করে এই ফলগুলো খায়। আর এই ফল খাওয়ার সাথে সাথে তাদের ভেতর একটা বিচিত্র ব্যাপার ঘটে হঠাৎ করে তারা ব্যাপকভাবে বংশ বৃদ্ধি করতে থাকে। দেখতে দেখতে লক্ষ লক্ষ ইঁদুরের জন্ম হয়। সেই ইঁদুরের আকার-আকৃতিও অস্বাভাবিক, অনেক বড় এবং খানিকটা হিংস্র, তারা দল বেঁধে এদিক-সেদিক আক্রমণ করতে শুরু করে। রাতারাতি তারা একটা ফসলের ক্ষেত খেয়ে শেষ করে ফেলে। সংখ্যায় এই ইঁদুর এত বেশি যে তাদেরকে প্রতিরোধ করার কোনো উপায় নেই। স্থানীয় মানুষ খুব সঙ্গত কারণেই ইঁদুরের এই ভয়াবহ আক্রমণের নাম দিয়েছে ইঁদুরের বন্যা। সেই ইঁদুরের বন্যায় ফসল নিঃশেষ হয়ে যায়–তখন আসে দুর্ভিক্ষ। মানুষ না খেতে পেয়ে মারা যায়। এই ভয়াবহ দুর্যোগ কমপক্ষে তিন-চার বছর থাকে, তারপর খুব ধীরে ধীরে সবকিছু আবার আগের অবস্থায় ফিরে আসে। বাঁশের ফলে কী এমন জিনিস থাকে যার কারণে হঠাৎ করে তাদের এমন বংশ বৃদ্ধি হতে থাকে সেটা তারা আমাদের বলতে পারলেন না কিন্তু তারা দিব্যি দিয়ে বললেন কথাটি সত্যি। শুধু যে ইঁদুরের বংশ বৃদ্ধি হয় তা নয়, পাহাড়ের বন মোরগ যখন বাশের ফলের বিচিগুলো খায় তাদেরও বংশ বৃদ্ধি হতে থাকে। যখনই বাঁশের ফল হয়, তখনই পাহাড়ে বন মোরগের সংখ্যা হঠাৎ করে বেড়ে যায় ইঁদুরের মতোই!
আমি রাঙ্গামাটি থেকে এক ধরনের বিস্ময় নিয়ে ফিরে এসেছি। স্থানীয় মানুষ যে কথাগুলো বলেছেন সেগুলো তারা পরিবারের বয়োবৃদ্ধদের কাছে শুনেছেন, কিছু কিছু ব্যাপার হয়তো নিজেও দেখেছেন, তার কিছু সত্যি, কিছু হয়তো অতিরঞ্জন, কিছু হয়তো আসলে সত্যি নয়। ব্যাপারটা নিয়ে অনুসন্ধান করে আমি যেটুকু জানতে পেরেছি তার বড় অংশই অত্যন্ত বিচিত্র।
প্রথমত সব বাঁশই যে পঞ্চাশ বছর পর ফুল দিয়ে মারা যায় সেটা সত্যি নয়, কিছু কিছু বাঁশ আছে যারা হয়তো প্রতি বছরই ফুল দেয়। তবে এটা সত্যি প্রায় পঞ্চাশ বছরের যে কথাটি আছে বাংলাদেশের রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়ি কিংবা ভারতের ত্রিপুরা, মিজোরাম এই এলাকার বাঁশের জন্যে সেটা সত্যি। যারা খবরের কাগজ পড়েন তারা সবাই মিজোরাম এলাকার সশস্ত্রবিচ্ছিন্নতাবাদীদের কথা জানেন। ভারতবর্ষে প্রায় ত্রিশ-চল্লিশ বছর থেকে এই বিছিন্নতাবাদীরা যুদ্ধ করে আসছে এবং ভারতবর্ষের জন্যে সেটা অনেক বড় একটা সমস্যা। শুনে অবিশ্বাস্য মনে হতে পারে সেটা শুরু হয়েছে বাঁশের ফুলের কারণে।