কার্বন-ডাই-অক্সাইডের কারণে পৃথিবীর তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়ার বিষয়টিকে বলা হয় গ্লোবাল ওয়ার্মিং, বাংলায় বৈশ্বিক উষ্ণতা। বিজ্ঞানীরা অনেকদিন থেকেই এই বিষয়টা নিয়ে চেঁচামেচি করে আসছিলেন। প্রাকৃতিক উপায়ে বাতাসে অনেক কার্বন-ডাই-অক্সাইড আসে, সেটাকে ঠেকানোর কোনো উপায় নেই। ধারণা করা হয় পৃথিবীর বাতাসের শতকরা 40 অংশই আসে পৃথিবীর নানা আগ্নেয়গিরি থেকে। প্রকৃতি যেভাবে কার্বন-ডাই-অক্সাইড তৈরি করে ঠিক সেরকম সেটাকে শোষণ করারও ব্যবস্থা করে রেখেছে। সমুদ্র তার পানিতে বিশাল পরিমাণ কার্বন-ডাই-অক্সাইড দ্রবীভূত করে রাখে। কিন্তু পৃথিবীর অবিবেচক মানুষেরা কলকারখানা চালিয়ে, গাড়ি, জাহাজ, বিমান চালিয়ে প্রতিমুহূর্তে কার্বন-ডাই-অক্সাইড তৈরি করে যাচ্ছে। বিজ্ঞানীদের কাছে এখন সুনির্দিষ্ট প্রমাণ আছে যে পৃথিবীতে কার্বন-ডাই-অক্সাইডের পরিমাণ ধীরে ধীরে বেড়ে যাচ্ছে। বিজ্ঞানীরা অনুমান করছেন এই পৃথিবী বৈশ্বিক উষ্ণতার কবলে পড়তে যাচ্ছে। প্রথম দিকে ব্যবসায়ীরা, কারখানা ফ্যাক্টরির মালিকেরা এটা মানতে চায় নি কিন্তু জাতিসংঘ থেকে শেষ পর্যন্ত একটা সতর্কবাণী উচ্চারণ করা হয়েছে এবং শেষ পর্যন্ত পুরো পৃথিবী এটা মেনে নিয়েছে। সবাই স্বীকার করছে এই মুহূর্তে সতর্ক না হলে সামনে মহাবিপদ!
পৃথিবীর মানুষ অবিবেচক হয়ে প্রকৃতি এবং পরিবেশকে ধ্বংস করেছে–আবার সেই পৃথিবীর মানুষই প্রকৃতি এবং পরিবেশকে উদ্ধার করার কাজে লেগে গিয়েছে। সারা পৃথিবীজুড়ে এখন “সবুজ আন্দোলন শুরু হয়েছে, যার প্রধান একটা কাজ বাতাসে কার্বন-ডাই-অক্সাইড কমানো। কার্বন-ডাই-অক্সাইডকে সংক্ষেপে বলছে কার্বন, আর নূতন পৃথিবী এর পিছনে উঠেপড়ে লেগেছে!
কার্বন-ডাই-অক্সাইড ছিল একটি নিরীহ প্রয়োজনীয় গ্যাস–কেমন করে জানি সে এখন হয়ে গেছে পৃথিবীর ভিলেন!
০৮. একটি বিস্ময়কর বস্তু
যদি কখনো কাউকে জিজ্ঞেস করা হয়, কোনো জিনিস কঠিন, তরল কিংবা বায়বীয় কোনোটার ভেতরেই পড়ে না তাহলে সেই মানুষটির বড় ধরনের বিভ্রান্তির মাঝে পড়ে যাবার কথা। তার বিভ্রান্তি শতগুণে বেড়ে যাবে যদি আমরা তাকে বলি সেই জিনিসটা আমাদের খুবই পরিচিত, আমরা প্রতিদিনই সেটা ব্যবহার করি। শুধু তাই নয়, জিনিসটা যে শুধু দৈনন্দিন কাজে ব্যবহৃত হয় তা নয় এটা দিয়ে যেরকম মহাকাশযানের আচ্ছাদন তৈরি করা হয় ঠিক সেরকম ক্যান্সারের চিকিৎসা করা হয়। এটা দিয়ে মুহূর্তের মাঝে লক্ষ মাইল দূরে তথ্য পাঠানো হয় আবার আকাশের গ্রহ-নক্ষত্রকে চোখের সামনে নিয়ে আসা যায়। এটা দিয়ে সবজি চাষ করা যায় আবার নিউক্লিয়ার শক্তি কেন্দ্রের ভয়াবহ তেজস্ক্রিয় বর্জকে সামলে রাখা যায়। তালিকাটি আরো দীর্ঘ না করে অন্য কিছুও বলা যেতে পারে–এই অসাধারণ জিনিসটি যে শুধুমাত্র বর্তমান যুগের বড় বড় বিজ্ঞানীরা তাদের অতি আধুনিক ল্যাবরেটরি বা কলকারখানায় তৈরি করতে পারেন তা নয়, মানুষ হাজার হাজার বছর থেকে এটা তৈরি করে আসছে, যে কোনো প্রাচীন সভ্যতার মাঝেই এই জিনিসটির হদিস পাওয়া যায়।
কৌতূহলকে আরো না বাড়িয়ে আমরা জিনিসটার নাম বলে দিতে পারি, জিনিসটা হচ্ছে কাঁচ! মানুষ সেই প্রাচীনকাল থেকে কাচ তৈরি করতে জানে, কেমন করে কাচ তৈরি করা যায় তার সবচেয়ে প্রাচীন পদ্ধতিটি খ্রিস্টের জন্মের 650 বছর আগে তৈরি করা হয়েছে। বালুকে প্রায় 2300 ডিগ্রি সেলসিয়াসে উত্তপ্ত করলেই সেটা কাঁচে পরিণত হয়। 2300 ডিগ্রি সেলসিয়াস। আসলে অনেক তাপমাত্রা, খুব সহজে সেটা পাওয়ার কথা নয়। বালুর সাথে খানিকটা সোড়া (Na2CO3) মিশিয়ে নিলে সেটা 1500 ডিগ্রি সেলসিয়াসের কাছাকাছি তাপমাত্রাতেই কাচ তৈরি করা যেতে পারে। অনুমান করা হয় প্রাচীনকালে হয়তো কোনো মানুষ মরুভূমিতে বালুর ওপর আগুন জ্বালিয়ে রাত কাটিয়েছে, হয়তো সেই বালুতে সোডা মেশানো ছিল, ভোরবেলা আগুন নেভাতে গিয়ে সেখানে স্বচ্ছ কাচ আবিষ্কার করে চমৎকৃত হয়েছে। কৌতূহলী হয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে তখন তারা কাচ তৈরি করা শিখে ফেলেছে!
শুরুতে বলা হয়েছে কাচ কঠিন, তরল বা বায়বীয় কোনোটাই নয়। ব্যাপারটা নিয়ে তর্ক বিতর্ক শুরু হয়ে যাওয়া খুবই স্বাভাবিক, আমাদের চারপাশের যে কাচ আমরা দেখি সেগুলোকে অবশ্যই আমরা কঠিন বস্তু হিসেবে দেখি। বিজ্ঞানীরা অন্য কথা বলেন, তারা বলেন কাচ (ইংরেজিতে glass) আসলে কোনো নির্দিষ্ট বস্তুর নাম নয়, কাচ হচ্ছে কোনো পদার্থের অণু পরমাণুর একটি বিশেষ বিন্যাসের নাম। অণু-পরমাণু সঠিকভাবে বিন্যস্ত থাকলে আমরা সেটাকে কঠিন পদার্থ বলি, তরল পদার্থের অণু-পরমাণু পুরোপুরি এলোমেলো হয়ে যায়। অণু পরমাণুর এই পুরোপুরি এলোমেলো বিন্যাসকে হঠাৎ করে যদি আটকে ফেলা যায় তখন সেটাকে বলে কাচ! কাজেই বাহ্যিক ব্যবহার দিয়ে বিবেচনা করলে কাচ অবশ্যই কঠিন পদার্থ কিন্তু যদি আমরা তার অণু-পরমাণুর বিন্যাসকে দেখি তাহলে আমরা দেখব সেটা মোটেও কোনো কঠিন পদার্থের বিন্যাস নয়–সেটা হুবহু একটা তরল পদার্থের বিন্যাস!
আমাদের দৈনন্দিন জীবনে আমরা নানাভাবে কাঁচকে ব্যবহার করি। পানি খাবার জন্যে যেটা আমরা ব্যবহার করি সেটাকে আমরা কাচের ইংরেজি নাম গ্লাস বলেই ডাকি। আমাদের জানালায় কাঁচ। ঘরের দেওয়ালে যে ছবির ফ্রেম টানাই তার সামনে থাকে কাঁচ। আলমিরার দরজায় থাকে কাঁচ। চুল আঁচড়াই যে আয়নার সামনে সেটা কাঁচ, টেবিলের উপরে অনেক সময় থাকে কাঁচ, পেপার ওয়েটে থাকে কাঁচ। ওষুধের শিশি তৈরি হয় কাচ দিয়ে, টেলিভিশনের স্ক্রিনটা হচ্ছে কাঁচ, চোখে যে চশমা লাগাই তার লেন্সটাও তৈরি হয়েছে কাচ দিয়ে। দৈনন্দিন ব্যবহারে আমরা কোথায় কোথায় কাচ ব্যবহার করি এটা তার খুব ছোট একটা তালিকা, কেউ যদি আরেকটু সময় নিয়ে তালিকাটা তৈরি করে সেটা আরো অনেকগুণ লম্বা করা সম্ভব।