সেটা বোঝার জন্যে আমাদের একটুখানি নিউক্লিয়ার পদার্থ বিজ্ঞান ঝালাই করে নিতে হবে। আমরা সবাই জানি সব কিছু তৈরি হয় পরমাণু দিয়ে আর পরমাণুর কেন্দ্রে থাকে নিউক্লিয়াস। একটা পরমাণুর মোটামুটিভাবে পুরো ভরটুকুই থাকে নিউক্লিয়াসে, কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার হচ্ছে পরমাণুর তুলনায় সেটা খুবই ছোট। (সেটা কত ছোট সেটা বোঝানোর জন্যে বলা যায় একটা মানুষকে যদি চাপ দিয়ে তার পরমাণুকে গুঁড়িয়ে নিউক্লিয়াসের মাঝে ঠেসে নিয়ে আসা যায় তাহলে সেই মানুষটিকে আর খালি চোখে দেখা যাবে না, মাইক্রোস্কোপ দিয়ে দেখতে হবে!) কিছু কিছু মৌলিক পদার্থের নিউক্লিয়াসের একটা বিশেষত্ব আছে। এমনিতে সেটা মোটামুটি স্থিতিশীল কিন্তু যদি কোনোভাবে তার ভেতরে একটা নিউট্রন ঢুকিয়ে দেয়া যায় হঠাৎ করে সেটা অস্থিতিশীল হয়ে ভেঙে কয়েক টুকরো হয়ে পড়ে। (6.2 নং ছবি) শুরুতে নিউক্লিয়াসের যে ভর ছিল ভেঙে যাবার পর দেখা যায় সেই ভর কমে গেছে। যেটুকু ভর কমে গেছে সেই ভরটাই আইনস্টাইনের বিখ্যাত E = mc^2 সূত্র অনুযায়ী শক্তি হিসেবে বের হয়ে আসে।
শুধুমাত্র এই ব্যাপারটা দিয়ে কিন্তু নিউক্লিয়ার শক্তি কেন্দ্র বোঝা যাবে না, সেটা বোঝার জন্যে 6.2 নং ছল্টিা আরেকটু ভালো করে দেখতে হবে। এই ছবিটাতে দেখানো হয়েছে নিউক্লিয়াসটা যখন ভেঙে যাচ্ছে তখন টুকরোগুলোর মাঝে কিছু নিউট্রনও আছে। যদি এই বাড়তি নিউট্রনগুলো অন্য নিউক্লিয়াসের ভেতর ঠেলে ঢুকিয়ে দেয়া যায় তাহলে সেগুলোও ভেঙে নতুন শক্তি আর নতুন নিউট্রনের জন্ম দেবে, সেই নতুন নিউট্রন নতুন নিউক্লিয়াসে ঢুকে আরো নতুন নিউট্রনের জন্ম দেবে এবং এভাবে প্রক্রিয়াটা চলতেই থাকবে! সত্যি সত্যি যদি এই প্রক্রিয়াটা চালিয়ে যাওয়া যায় তাহলে একে বলে চেইন রি-একশান। নিউক্লিয়ার রি এক্টরের ভেতর এই চেইন রি-একশান চালু রাখতে হয়। ব্যাপারটি যত সহজে বলা হলো আসলে সেটা করা এত সহজ নয়। প্রধান কারণ নিউক্লিয়ার শক্তি দিতে পারে এরকম নিউক্লিয়াসের সংখ্যা হাতেগোনা। সবচেয়ে পরিচিতটি হচ্ছে ইউরেনিয়াম 235। খনিতে যে ইউরেনিয়াম পাওয়া যায় তার মাঝে বেশিরভাগ ইউরেনিয়াম 238, ইউরেনিয়াম 235 মাত্র 0.7 শতাংশ। নিউক্লিয়ার শক্তি কেন্দ্রে ব্যবহার করার জন্যে ইউরেনিয়াম 235-এর পরিমাণ বাড়িয়ে কমপক্ষে 2 থেকে 3 শতাংশ করতে হয় (নিউক্লিয়ার বোমা বানানোর জন্যে সেটা হতে হয় 90 শতাংশ।)। কাজেই নিউক্লিয়ার রি-এক্টরের ভেতরে ইউরেনিয়াম 235 সমৃদ্ধ জ্বালানি রাখতে হয়। যখন চেইন রি-একশন শুরু হয় সেখান থেকে অচিন্তনীয় তাপ বের হতে শুরু করে। আমরা আগেই বলেছি চেইন রি-একশন চালু রাখার জন্যে নিউট্রনের সরবরাহ ঠিক রাখতে হবে। যদি কোনো কারণে নিউট্রন সরবরাহ কমে যায় তাহলে চেইন রি-একশান বন্ধ হয়ে যাবে। যারা বিষয়টি বুঝতে পেরেছেন তারা নিশ্চয়ই অনুমান করতে পারছেন কন্ট্রোল রডগুলো কী! এগুলো আর কিছুই নয়, নিউট্রনকে শোষণ করতে পারে এরকম কোনো মৌল–ক্যাডমিয়াম হচ্ছে তার একটি উদাহরণ। কাজেই নিউক্লিয়ার শক্তি কেন্দ্রে শক্তি উৎপাদন নিয়ন্ত্রণ করা খুবই সহজ। ক্যাডমিয়ামের তৈরি কন্ট্রোল রডগুলো রি-এক্টরের যত ভেতরে ঢোকানো হবে, শক্তি তৈরি হবে তত কম। যত বাইরে আনা হবে শক্তি জন্ম হবে তত বেশি। ভুল করে কেউ যদি পুরোপুরি বাইরে নিয়ে আসে ঘটে যেতে পারে প্রচণ্ড বিপর্যয়–যেমনটি ঘটেছিল চেরনোবিলে!
০৭. কার্বন-ডাই-অক্সাইড : পৃথিবীর ভিলেন?
আমাদের বাতাসের শতকরা 99 ভাগ হচ্ছে নাইট্রোজেন এবং অক্সিজেন (যথাক্রমে 78% ও 21%)। বাকি এক শতাংশের বেশিরভাগই হচ্ছে আর্গন নামের একটা নিষ্ক্রিয় গ্যাস। এরপর অত্যন্ত ক্ষুদ্র পরিমাণ যে গ্যাসটির কথা বলা যায় সেটা হচ্ছে কার্বন-ডাই-অক্সাইড। কিন্তু বাতাসে তার পরিমাণ এত কম (মাত্র 0.038%) যে সেটাকে ধর্তব্যের মাঝেই আনার কথা ছিল না। কিন্তু মজার কথা হচ্ছে যে কার্বন-ডাই-অক্সাইড গ্যাসটি শুধু যে ধর্তব্যের মাঝে আনা হয়েছে তা নয় আমাদের বর্তমান পৃথিবীতে এই গ্যাসটি হচ্ছে সবচেয়ে আলোচিত একটি গ্যাস।
কার্বন-ডাই-অক্সাইড গ্যাসের নাম শুনেই বোঝা যায় যে এর মাঝে রয়েছে একটা কার্বনের এবং দুটো অক্সিজেনের পরমাণু। এটি বর্ণ এবং গন্ধহীন একটা গ্যাস। আমাদের নিশ্বাসের সাথে কার্বন-ডাই-অক্সাইড বের হয়ে আসে। বাতাসে যে ক্ষুদ্র পরিমাণ কার্বন-ডাই-অক্সাইড রয়েছে সেটা আমাদের জন্যে বিষাক্ত নয় কিন্তু পরিমাণে বেশি হলে সেটা রীতিমতো বিষাক্ত হতে পারে। এটা বাতাস থেকে ভারী তাই অব্যবহৃত কুয়া বা গর্তের নিচে এটা জমা হয়, না বুঝে অনেক মানুষ এরকম কুয়ায় নেমে নিশ্বাস বন্ধ হয়ে মারা পড়ে।
শুধু যে কুয়াতে নিশ্বাস বন্ধ হয়ে মানুষ মারা যায় তা নয়–কার্বন-ডাই-অক্সাইডের কারণে একসাথে শতশত মানুষের মারা যাওয়ারও উদাহরণ আছে। আফ্রিকায় তিনটি হ্রদ রয়েছে যেগুলোর গঠন একটু বিচিত্র। হ্রদের নিচে রয়েছে আগ্নেয়গিরির জ্বালামুখ এবং সেই জ্বালামুখ দিয়ে কার্বন-ডাই-অক্সাইড গ্যাস বের হয়ে নিচে জমা হতে থাকে। প্রাকৃতিক কোনো কারণে হঠাৎ হঠাৎ হ্রদের নিচ থেকে বিপুল পরিমাণ কার্বন-ডাই-অক্সাইড গ্যাস বের হয়ে আসে। আগেই বলা হয়েছে কার্বন-ডাই-অক্সাইড বাতাস থেকে ভারী–তাই পানি যেভাবে গড়িয়ে নিচু এলাকা প্লাবিত করে ফেলে, এই কার্বন-ডাই-অক্সাইড গ্যাসও ঠিক সেভাবে কাছাকাছি নিচু জনপদকে প্লাবিত করে সব বাতাসকে সরিয়ে জায়গা দখল করে নেয়। এলাকার মানুষজন নিশ্বাস নিতে না পেরে দম বন্ধ হয়ে মারা যায়।