কোনো একটা প্রযুক্তির সাফল্য নির্ভর করে সেটা দিয়ে মানুষের ব্যবহারের উপযোগী কিছু একটা তৈরি করার মাঝে। সে হিসেবে ন্যানো টেকনোলজি বেশ খানিকটা এগিয়ে আছে, বেশ কিছু জিনিস তৈরি হয়েছে যেটা মানুষ ব্যবহার করতে শুরু করেছে কিংবা ব্যবহার শুরু করতে পারবে এরকম পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। ন্যানো টেকনোলজি ব্যবহার করে যেসব জিনিস তৈরি হয়েছে তার মাঝে রয়েছে রৌদ্র প্রতিরোধক সান স্ক্রিন (যে ক্রিকেটাররা মুখে সাদা রং মেখে মোটামুটি ভয়ঙ্কর দর্শন হয়ে থাকেন সেই পাউডারটি!), নিজে থেকে পরিষ্কার হয়ে যাওয়া কাঁচ, কোনোভাবেই কুঁচকে যায় না এরকম কাপড়, ভেতর থেকে কোনোভাবেই বাতাস বের হয়ে যাবে না এরকম টেনিস বল । এল, সি, ডি, মনিটর, কম্পিউটারের মাইক্রোপ্রসেসর কিংবা ক্যাপাসিটর।
উপরে যে জিনিসগুলোর কথা বলা হয়েছে সেগুলো ছাড়াও ন্যানো টেকনোলজি দিয়ে আরেকটি অসাধারণ জিনিস তৈরি হয়েছে সেটাকে বলা হয় ন্যানো ফাইবার। এটি হচ্ছে। কার্বনের পরমাণু দিয়ে তৈরি এক ধরনের টিউব, যেটার ব্যাস হয়তো মাত্র কয়েক ন্যানো মিটার কিন্তু দৈর্ঘ্য এক-দুই মিটার থেকে শুরু করে কিলোমিটার পর্যন্ত হতে পারে। এই সূক্ষ্ম তন্তু দিয়ে যদি কোনো দড়ি তৈরি করা যায় তাহলে সেটা ইস্পাত থেকে একশ গুণ শক্ত হবে কিন্তু ওজন হবে তার মাত্র ছয় ভাগের এক ভাগ্য।
বলাই বাহুল্য ওজন কম কিন্তু পরিচিত যে কোনো জিনিস থেকে শতগুণ শক্ত সেরকম অসাধারণ একটা তন্তু (Fiber) দিয়ে অনেক ধরনের কাজ করা যায়, উদাহরণ দেওয়ার জন্যে টেনিস র্যাকেটের কথা বলা যায়, গাড়ির বডি কিংবা প্লেনের ফিউজলেজের কথাও বলা যায়। তবে সবচেয়ে চমকপ্রদ যে জিনিসটার কথা বলা যায় সেটা এখনো খানিকটা বিজ্ঞান এবং অনেকখানি কল্পবিজ্ঞান।
মহাকাশ নিয়ে মানুষের কৌতূহল তাদের জন্মলগ্ন থেকে। মাত্র গত কয়েক দশকে মানুষ প্রথমবার পৃথিবীর আকর্ষণ থেকে যুক্ত হয়ে মহাকাশে উড়ে বেড়িয়েছে। এখন পর্যন্ত যে প্রযুক্তি ব্যবহার করে মানুষ মহাকাশে পাড়ি দিয়েছে সেটি অনেক খরচসাপেক্ষ। হিসেব করে দেখানো যায় প্রতি কেজি ওজনের কোনো কিছুকে মহাকাশে পাঠাতে খরচ পড়ে প্রায় দশ থেকে পনেরো হাজার ডলার–যেটা প্রায় সোনার দামের কাছাকাছি, কাজেই মহাকাশে যারার প্ৰযুক্তি মানুষের আয়ত্তের মাঝে এলেও সেটা এখনো সাধারণ মানুষের ধরা-ছোঁয়ার বাইরে। কেমন করে সাধারণ মানুষ মহাকাশে যেতে পারে সেটা নিয়ে বিজ্ঞানী এবং কল্পবিজ্ঞানীরা অনেক দিন থেকে চিন্তা করে আসছেন এবং দুই দলই একমত হয়েছেন যে সেটা করা সম্ভব মহাকাশ লিফট দিয়ে। ব্যাপারটা ব্যাখ্যা করা খুবই সহজ–আমরা উঁচু দেয়ালে ওঠার জন্যে লিফট ব্যবহার করি, ঠিক সেরকম প্রায় পঁয়ত্রিশ হাজার কিলোমিটার উঁচু একটা লিফট থাকবে এবং মহাকাশ পরিব্রাজকরা সেই লিফটে করে মহাকাশে উঠে যাবেন!
আমি জানি বেশিরভাগ পাঠকই ভুরু কুঁচকে বলছেন, “পঁয়ত্রিশ হাজার কিলোমিটার উঁচু একটা লিফট? পৃথিবীর ব্যাসার্ধের ছয় গুণ?” স্বীকার করতেই হবে এই মুহূর্তে এটাকে বিজ্ঞান কল্পকাহিনী বলাই বেশি যুক্তিসঙ্গত–কিন্তু বিজ্ঞান কল্পকাহিনী বলাও সম্ভব হতো না যদি দেখা যেত পৃথিবীর কোনো প্রযুক্তি দিয়েই এরকম একটা লিফট তৈরি করা সম্ভব না! পৃথিবীর সাথে বেঁধে রাখা একটা মহাকাশ স্টেশন পৃথিবীর সাথে সাথে ঘুরছে–সেটা সম্ভব করার জন্যে যে শক্ত ‘দড়ি’ দরকার সেটা আগে ছিল না, ন্যানো টেকনোলজি ব্যবহার করে যে কার্বন ফাইবার বা কার্বন ন্যানো টিউব তৈরি করা হয়েছে শুধুমাত্র সেগুলোও এই প্রচণ্ড শক্তিতে মহাকাশ স্টেশনকে ধরে রাখতে পারবে। ভবিষ্যতে কখনো এরকম মহাকাশ স্টেশন তৈরি করা এখন আর বিজ্ঞান কল্পকাহিনী নয়। যদি সত্যি সত্যি এই মহাকাশ লিফট তৈরি করা সম্ভব হয় তখন মহাকাশ অভিযানে যেতে খরচ হবে প্রতি কেজির জন্যে মাত্র দশ । ডলার–সাধারণ মানুষও খুব। সহজে সেই সুযোগ নিতে পারবে!
নূতন প্রযুক্তি সবসময়েই নূতন ভীতির জন্ম দেয়। কিছুদিন আগে লার্জ হ্যাড্রন কলাইডারের কার্যক্রম শুরু করার সময় কিছু মানুষ সারা পৃথিবীতে একটা আতঙ্ক সৃষ্টি করে ফেলেছিল যে। এই কলাইডারে যে শক্তির জন্ম দেবে সেই শক্তিতে তৈরি হবে ব্ল্যাক হোল এবং সেই ব্ল্যাক হোল সমস্ত পৃথিবীকে গিলে খেয়ে ফেলবে। এই আতঙ্ক এমন এক পর্যায়ে চলে গিয়েছিল যে ভারতবর্ষের একটা কিশোরী সেটা আর সহ্য করতে না পেরে আত্মহত্যা করেছিল।
এ ধরনের আতঙ্ক ভিত্তিহীন কারণ বিজ্ঞানীরা নূতন কোনো একটা প্রযুক্তি নিয়ে কাজ শুরু করার আগে সবসময়েই সেটা থেকে সম্ভাব্য বিপদগুলো কী হতে পারে সেটা নিয়ে ভাবনা চিন্তা করেন। তারা কখনোই এমন দায়িত্বহীন নন যে নিজের হাতে সারা পৃথিবীতে একটা মহাবিপর্যয়ের সৃষ্টি করে দেবেন।
কাজেই ন্যানো টেকনোলজি নিয়ে কী বিপদ হতে পারে সেটা নিয়েও ভাবনা-চিন্তা চলছে। অত্যন্ত ক্ষুদ্র বলে আমাদের শরীরে, রক্তস্রোতে মিশে মস্তিষ্কে চলে গিয়ে শারীরিক বিপদ ডেকে আনা একটা অত্যন্ত গ্রহণযোগ্য বিপদের আশঙ্কা। তবে যে বিপদটি চমকপ্রদ সেটা এরকম : ন্যানো টেকনোলজির এক পর্যায়ে তৈরি হবে ন্যানো রবোট, তারা নিজেরা নিজেদের তৈরি করে টেকনোলজির কাজে ব্যবহৃত হবে। হঠাৎ করে সেই ন্যানো রবোট যদি মানুষের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গিয়ে নিজেরা নিজেদের তৈরি করতে শুরু করে–পৃথিবীর যা কিছু আছে তার সবকিছু ধ্বংস করে তারা শুধু নিজেদের তৈরি করতে থাকে তাহলে দেখা যাবে এই পৃথিবীতে আর কোনো জীবিত প্রাণী নেই। আপাতদৃষ্টিতে মনে হবে এটা বুঝি প্রাণহীন জগৎ কিন্তু আসলে এটা রাজত্ব করবে কোটি কোটি ন্যানো রবোট!