- বইয়ের নামঃ আরো একটুখানি বিজ্ঞান
- লেখকের নামঃ মুহম্মদ জাফর ইকবাল
- প্রকাশনাঃ কাকলী প্রকাশনী
- বিভাগসমূহঃ বৈজ্ঞানিক বই
০১. বিজ্ঞান এবং অপ-বিজ্ঞান
ভূমিকা
আমার নিজেরই বিশ্বাস হয় না যে আমি ছয় বছর থেকে “কালি ও কলম” এর প্রতি সংখ্যায় বিজ্ঞানের উপর নিয়মিতভাবে লিখে এসেছি। প্রথম তিন বছরের পর লেখাগুলো সংকলিত করে প্রকাশিত হয়েছিল “একটুখানি বিজ্ঞান”। বইটির জন্যে ছেলে বুড়ো অনেকেরই একধরণের মমতা জন্মেছিল তাই পরের তিন বৎসরের লেখাগুলো সংকলিত করে “আরো একটুখানি বিজ্ঞান” প্রকাশ করার সাহস দেখাচ্ছি। এই লেখাগুলো পড়ে একজন মানুষেরও যদি বিজ্ঞানের রহস্যময় জগত নিয়ে একটু কৌতূহল হয় আমি মনে করি আমার পরিশ্রমটুকু সার্থক হয়েছে।
মুহম্মদ জাফর ইকবাল
২৪ জানুয়ারি ২০১০
.
০১. বিজ্ঞান এবং অপ-বিজ্ঞান
কিছুদিন আগে আমার কাছে একটা ছোট ছেলে এসেছে, সে মুখ কাচুমাচু করে বলল তার মাথায় একটা বৈজ্ঞানিক আইডিয়া এসেছে সেটা সে আমাকে বলতে চায়। ছেলেটি মুখ খোলার আগেই আমি বুঝে গেলাম “আইডিয়া”টি কী–কারণ আমি যখন তার বয়সী ছিলাম তখন আমার মাথাতেও এরকম “বৈজ্ঞানিক আইডিয়া” এসেছিল, তবে আমি সাহস করে কারো কাছে যেতে পারি নি। সে কী বলবে জানার পরও আমি তাকে পুরো ব্যাপারটা ব্যাখ্যা করতে দিলাম, একটা জেনারেটর আর একটা মোটর ব্যবহার করে সে অফুরন্ত শক্তি বের করে আনবে। জেনারেটর ঘুরাৰে মোটরকে, মোটর ঘুরাবে জেনারেটরকে এভাবে চলতেই থাকবে।
পদার্থবিজ্ঞান পরিষ্কার করে বলে দিয়েছে শক্তিকে ব্যবহার করলেই তার খানিকটা অপচয় হয়–তাই যেটুকু শক্তি দেওয়া হয় তার থেকে অনেক কম শক্তি ফেরত পাওয়া যায়, সেজন্যে কখনোই “অফুরন্ত শক্তি” বা “চির ঘূর্ণায়মান” যন্ত্র তৈরি করা যায় না। আমি ছোট ছেলেটাকে তার মতো করে বিষয়টা বুঝিয়ে দিলাম, সে ব্যাপারটা বুঝে খুশি হয়ে ফিরে গেল!
মজার ব্যাপার হচ্ছে বড়রা ব্যাপারটা বুঝতে চায় না একবার একজন বয়স্ক মানুষ এসে আমাকে একই ধরনের একটা “চির ঘূর্ণায়মান” যন্ত্রের কথা বলল। আমি তাকে বুঝিয়ে বললাম কেন এটা কাজ করবে না কিন্তু সে বুঝতে রাজি হলো না! তার ধারণা আমি একটু সাহায্য করলেই সে জগদ্বিখ্যাত বিজ্ঞানী হয়ে কোটি কোটি টাকা কামাই করতে থাকবে–আমি হিংসা করে তাকে নিরুৎসাহিত করছি! বাধ্য হয়ে আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম, সে কী তার একটা যন্ত্রের মডেল তৈরি করতে পারবে? মানুষটি বলল অবশ্যই পারবে, সেটা তৈরি করতে তার দরকার কয়েক ফিট পাস্টিকের নল, দুটো পানির বোতল আর কিছু পানি। আমি তাকে বললাম সে যদি তার মডেলটা তৈরি করে আনতে পারে তাহলে আমি তাকে একটা নোবেল পুরস্কার, মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার, তার সাথে বিবিসি, সি. এন. এন.-এ সাক্ষাৎকারের সবকিছু ব্যবস্থা করে দেব। মানুষটি উত্তেজিত ভঙ্গিতে তখন তখনই বের হয়ে গেল–দুই ঘণ্টার মাঝে সে মডেলটা তৈরি করে এনে আমাকে দেখাবে। দুই ঘণ্টার পর আরো ছয় বছর পার হয়ে গেছে সেই মানুষটি তার নোবেল পুরস্কার পাওয়ার উপযোগী যন্ত্রের মডেল নিয়ে আর ফিরে আসেন নি। কী কী করা যায় না সেটা জানা থাকা ভালো তাহলে সেটা করতে গিয়ে সময় নষ্ট হয় না। (কোনো কোণকে সমান তিন ভাগে ভাগ করা যায় না, পাঁচ ঘাত সমীকরণ সমাধান করা যায় না, ঠিক সে রকম শক্তি না দিয়ে শক্তি ফিরে পাওয়া যায় না।)।
এই ব্যাপারগুলো ঘটে বিজ্ঞান না জানার কারণে আমাদের খবরের কাগজ মাঝে মাঝে দায়িত্বহীন কাজ করে বসে থাকে। বিজ্ঞান জানা নেই তাই আজগুবি কিছু একটা দাবি করে কোনো মানুষ একটা ঘোষণা দিয়ে বসে থাকে, খবরের কাগজ সেগুলো ফলাও করে ছাপে, এই দেশে থাকার কারণে সঠিক মূল্যায়ন হচ্ছে না বলে তারা সরকারকে গালাগাল করে! কিন্তু সবারই জানা থাকতে হবে কোনো শক্তি না দিয়ে সে কখনো শক্তি ফিরে পাবে না এবং বিজ্ঞানের আবিষ্কারের ঘোষণা দিতে হয় বিজ্ঞানের জার্নালে, কখনোই সেটা খবরের কাগজে দিতে হয় না!
ইতিহাস ঘাটলে দেখা যায় সেই প্রাচীনকাল থেকে শুরু করে একেবারে এই বর্তমানকাল পর্যন্ত অনেকেই কোনো শক্তি না দিয়েই শক্তি পাবার জন্যে যন্ত্র তৈরি করার চেষ্টা করে এসেছেন। শিল্পী লিওনার্দো দা ভিঞ্চির ডায়েরিতেও এরকম যন্ত্রের ছবি রয়েছে–এই যন্ত্রগুলোর মাঝে একটা মিল রয়েছে। কেউ এগুলো তৈরি করতে পারে না, ড্রয়িং হিসেবেই থেকে যায়।
“চির ঘূর্ণায়মান” অফুরন্ত শক্তির ইঞ্জিনের মডেল যে একেবারেই তৈরি হয় নি তা নয়। 1813 সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে চার্লস রেডহেফার নামে একজন মানুষ একটা যন্ত্র তৈরি করেছিল যেটা নিজে থেকেই ঘুরত। অনেক মানুষ সেটা পয়সা খরচ করে দেখতে এসেছিল এবং রেডহেফার সাহেব রীতিমতো বড়লোক হয়ে গিয়েছিলেন। শেষ পর্যন্ত কিছু সন্দেহপ্রবণ মানুষ কাঠের কিছু তক্তা খুলে দেখতে পেলেন একাধিক পুলি ব্যবহার করে ছাদে বসে একটা বুড়ো মানুষ সেটা দর্শকদের জন্যে ঘুরিয়ে যাচ্ছে।
কেউ যেন মনে না করে পৃথিবীতে রেডহেফারের মতো মানুষ খুব কম ইতিহাস ঘাঁটলে এরকম অসংখ্য মানুষকে খুঁজে পাওয়া যাবে। বৈজ্ঞানিক জুয়াচুরির এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বিখ্যাত উদাহরণটির নাম পিল্টডাউন মানব (Piltdown Man)। 1912 সালে চার্লস ডসন নামে একজন দাবি করলেন তিনি মানুষ আর বানরের মাঝখানে যোগসূত্রটি খুঁজে পেয়েছেন। সেই ফসিলের প্রাণীটির ছিল মানুষের মতো মস্তিষ্ক করোটি কিন্তু বানরের মতো চোয়াল । মিউজিয়ামে সেই ফসিলটি চল্লিশ বছর মানুষের কৌতূহলকে নিবৃত্ত করেছে–1953 সালে বিজ্ঞানীরা ঘোষণা করলেন এটি পুরোপুরি জুয়াচুরি। বিভিন্ন প্রাণীর ফসিল দিয়ে এটাকে তৈরি করা হয়েছে। মাথাটি মানুষের, চোয়ালটি ওরাংওটানের, দাঁতগুলো জলহস্তীর! এই জুয়াচুরিতে যারা অংশ নিয়েছিলেন তার মাঝে শার্লক হোমসের স্রষ্টা আর্থার কোনাল ডায়ালের নামও আছে।