আপাতত।
কোনও রহস্য আছে নাকি? যদি থাকে তো আমি কিন্তু আপনাদের সঙ্গে ঝুলে পড়ব–ইফ ইউ ডোন্ট মাইন্ড। এমন সুযোগ আর আসবে না।
আপনার উটের পিঠে চড়তে আপত্তি নেই তো?
আরেব্বাস, উট! ভদ্রলোকের চোখ জ্বলজ্বল কয়ে উঠল। শিপ অফ দি ডেজার্ট! এ তো আমার স্বপ্ন মশাই। আমার আরক্ত আরব উপন্যাসে আমি বেদুইনের কথা লিখেছি যে! তা ছাড়া সাহারায় শিহরণ-এও আছে। অদ্ভুত জীব। নিজের ওয়াটার সাপ্লাই নিজের পাকস্থলীর মধ্যে নিয়ে বালির সমুদ্র দিয়ে সার বেঁধে চলেছে। কী রোমান্টিক-ওঃ!
ফেলুদা বলল, পাকস্থলীর ব্যাপারটা কি আপনার বইয়ে লিখেছেন নাকি?
লালমোহনবাবু থাতমত খেয়ে বললেন, ওটা ঠিক নয় বুঝি?
ফেলুদা মাথা নেড়ে বলল, জল আসে উটের কুঁজ থেকে। কুঁজটা আসলে চর্বি। ওই চর্বিকে অক্সিডাইজ করে উট জল করে নেয়। এক নাগাড়ে দশ পনেরো দিন ওই চর্বির জোরে জল না খেয়ে থাকতে পারে। অবিশ্যি একবার জলের সন্ধান পেলে দশ মিনিটে পাঁচিশ গ্যালানও খেয়ে নেয় বলে শোনা গেছে।
লালমোহনবাবু বললেন, ভাগ্যিস বললেন। নেক্সট এডিশনে ওটা কারেক্ট করে দেব।
০৪. ট্রেন ঢিমে হলেও
এখানকার ট্রেন ঢিমে হলেও, বেশি যে লেট করছে না এটাই ভাগ্যি। গাড়ি বদল করার ব্যাপার যেখানে থাকে, সেখানে লেট করলে অনেক সময় ভারী মুশকিল হয়।
ভরতপুর স্টেশনে এসে আমরা প্রথম ময়ূর দেখলাম। প্ল্যাটফর্মের উলটা দিকে তিনটে ময়ূর দিব্যি লাইনের উপর ঘুরে বেড়াচ্ছে। ফেলুদা বলল, কলকাতায় যেমন কাক-চড়ুই দেখিস সর্বত্র, এখানে তেমনি দেখবি ময়ূর আর টিয়া।
লোকজন যা দেখা যাচ্ছে, তাদের মধ্যে –পাগড়ি আর গালাপাট্টার সাইজ ক্রমেই বেড়ে চলেছে। এরা সবাই রাজস্থানি। এদের পরনে খাটো ধুতি হাঁটু অবধি তোলা, আর এক পাশে বোতামওয়ালা জামা। এ ছাড়া পায়ে আছে ভারী নাগরা, আর অনেকের হাতেই একটা করে লাঠি।
বান্দিকুই স্টেশনের রিফ্রেশমেন্ট রুমে বসে রুটি আর মাংসের ঝোল খেতে খেতে লালমোহনবাবু বললেন, এই যে সব লোক দেখছেন, এদের মধ্যে এক-আধটা ডাকাত থাকার সম্ভাবনা কিন্তু খুব বেশি। আরাবল্লী পাহাড় হল গিয়ে ডাকাতদের আস্তানা, জানেন তো? আর এ সব ডাকাত কী রকম পাওয়ারফুল হয়, সেটা নিশ্চয়ই আপনাকে বলে দিতে হবে না। জানালার লোহার শিক দু হাতে দু দিকে টেনে ফাঁক করে জেলখানা থেকে পালায় মশাই এরা।
ফেলুদা বলল, জানি। আর কারুর উপর খেপে গেলে এরা কীভাবে শাস্তি দেয় বলুন তো?
উঁহু। ওইখানেই তো মজা। সে লোক যেখানেই থাকুক না কেন, তাকে খুঁজে বের করে তলোয়ার দিয়ে নাকটা কেটে ছেড়ে দেয়।
লালমোহনবাবুর হাতের মাংসের টুকরোটা আর মুখে পোরা হল না।
নাক কেটে?
তই তো শুনেছি। এ যে সেই পৌরাণিক যুগের সাজার মতো মনে হচ্ছে মশাই। কী সাংঘাতিক!
মাঝরাত্তিরে মাড়ওয়ারের ট্রেনে ওঠার সময় অন্ধকারে একটু হাঁচোড় প্যাচোড় করতে হলেও, জায়গা পেতে অসুবিধা হল না। রাত্রে ঘুমও হল ভাল। সকালে ঘুম থেকে উঠে চলন্ত ট্রেনের জানালা দিয়ে একটা পাহাড়ের মাথায় একটা পুরনো কেল্লা দেখতে পেলাম। তার এক মিনিটের মধ্যেই গাড়ি কিষণগড় স্টেশনে এসে থামল। ফেলুদা বলল, জায়গার নামে গড় আছে দেখলেই বুঝবি কাছাকাছির মধ্যে কোথাও এ রকম একটা পাহাড়ের উপর একটা কেল্লা আছে।
কিষণগড় স্টেশনে প্ল্যাটফর্মে নেমে চা খেলাম। এখানকার চায়ের ভাঁড়গুলো দেখলাম। বাংলাদেশের ভাঁড়ের চেয়ে অনেক বেশি বড় আর মজবুত। চায়ের স্বাদও একটু অন্য রকম। ফেলুদা বলল যে, উটের দুধ দিয়ে তৈরি। সেটা শুনেই বোধহয় লালমোহনবাবু পর পর দু ভাঁড় চা খেলেন।
চা খেয়ে প্ল্যাটফর্মের কালে চট করে দাঁতটা মেজে চোখেমুখে জলের ঝাপটা দিয়ে গাড়িতে ফিরে এসে দেখি, বিরাট পাগড়ি মাথায় একটা রাজস্থানি লোক নাক অবধি চাদরে ঢেকে বেঞ্চির উপর পা তুলে হাঁটুর উপর থুতনি ভর করে লালমোহনবাবুর বেঞ্চির একটা পাশ দখল করে বসে আছে। চাদরের ফাঁক দিয়ে ভেতরের জামার রংটা দেখলাম, টকটকে লাল।
লালমোহনবাবু কামরায় ঢুকে তাকে দেখেই সটান নিজের জায়গা ছেড়ে আমাদের বেঞ্চির একটা কোণে বসে পড়লেন। ফেলুদা তোরা আরাম করে বোস বলে একেবারে সেই রাজস্থানিটার পাশেই বসে পড়ল।
আমি লোকটার পাগড়িটা লক্ষ করছিলাম; কত অজস্র প্যাঁচ আছে। ওই পাগড়িতে সেটা ভেবে কূলকিনারা পাচ্ছিলাম না। লালমোহনবাবু চাপা গলায় ফেলুদাকে উদ্দেশ করে বলল, পাওয়ারফুল সাস্পিশাস্। এ রকম চাষাভুষোর মতো পোশাক অথচ দিব্যি প্রথম শ্রেণীতে উঠে বসে আছে। কত হিরে-জহরত আছে ওই পুটলিটার মধ্যে কে জানে!
পুঁটলিটা পাশেই রাখা ছিল। ফেলুদা খালি একটু হাসল, মুখে কিছু বলল না। গাড়ি ছেড়ে দিল। ফেলুদা তার ঝোলার ভিতর থেকে রাজস্থানের বইটা বার করে নিল। আমি নিউম্যানের ব্র্যাড্শ টাইম-টেবিলটা খুলে সামনে কী কী স্টেশন পড়বে দেখতে লাগলাম। অদ্ভুত নাম এখানকার সব স্টেশনের–গালোটা, তিলাওনিয়া, মাক্রেরা, ভেসানা, সেন্দ্ৰা। কোথেকে এল এ সব নাম কে জানে। ফেলুদা বলে জায়গার নামের মধ্যে নাকি অনেক ইতিহাস লুকোনো থাকে। কিন্তু সে সব ইতিহাস খুঁজে বার করবে কে?
গাড়ি ঘটার ঘটর করে চলেছে, আমি রাজকাহিনীর শিলাদিত্য বাপ্লাদিত্যের কথা ভাবছি, এমন সময় বুঝতে পারলাম আমার শার্টের পাশটায় একটা টান পড়ছে। পাশ ফিরে দেখি লালমাহনবাবুর মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেছে। চোখাচোখি হতেই তিনি ঢোক গিলে শুকনো গলায় ফিস ফিস করে বললেন, ব্লাড।