ফেলুদা হয়তো খানিকটা ভদ্রতার খাতিরেই জিজ্ঞেস করল, কদ্দুর যাবেন?
যোধপুরটা তো পৌঁছই, তারপর দেখা যাবে। আপনারা?
আমরাও আপাতত যোধপুর।
বাঃ–চমৎকার হল। আপনিও কি লেখেন-টেখৈন নাকি?
আজ্ঞে না। ফেলুদা হাসল। আমি পড়ি। আপনি লেখেন?
জটায়ু নামটা চেনা চেনা লাগচে কি?
জটায়ু? সেই যে সব রোমহর্ষক অ্যাডভেঞ্চার উপন্যাস লেখেন? আমি তো পড়েওছি, তার দু-একটা বই—সাহারায় শিহরণ, দুর্ধর্ষ দুষমণ—আমাদের স্কুলের লাইব্রেরি থেকে নিয়ে।
আপনিই জটায়ু? ফেলুদা জিজ্ঞেস করল।
আজ্ঞে হ্যাঁ—ভদ্রলোকের দাঁত বেরিয়ে গেল, ঘাড় নুয়ে পড়ল—এই অধমের ছদ্মনামই জটায়ু! নমস্কার।
নমস্কার। আমার নাম প্রদোষ মিত্তির। ইনি শ্ৰীমান তপেশরঞ্জন।
ফেলুদা হাসি চেপে রেখেছে কী করে? আমার তো সেই যাকে বলে পেট থেকে ভসভাসিয়ে সোডার মতো হাসি গলা অবধি উঠে এসেছে। ইনিই জটায়ু। আর আমি ভাবতাম, যে রকম গল্প লেখে, চেহারা নিশ্চয়ই হবে একেবারে জেমস বন্ডের বাবা।
আমার আসল নাম লালমোহন গাঙ্গুলী। অবিশ্যি বলবেন না কাউকে। ছদ্মনামটা, মানে, ছদ্মবেশের মতোই–ধরা পড়ে গেলে তার আর কোনও ইয়ে থাকে না।
আমরা আগ্রা থেকে কিছু গুলাবি রেউড়ি নিয়ে এসেছিলাম, ফেলুদা ঠোঙাটা ভদ্রলোকের দিকে এগিয়ে দিয়ে বললেন, আপনি তো বেশ কিছু দিন থেকেই ঘুরছেন বলে মনে হচ্ছে।
ভদ্রলোক হ্যাঁ, তা- বলে একটা রেউড়ি তুলে নিয়েই কেমন যেন থতামত–খেয়ে গেলেন। ফেলুদার দিকে অবাক হয়ে চেয়ে বললেন, আপনি জানলেন কী করে?
ফেলুদা হেসে বললেন, আপনার ঘড়ির ব্যান্ডের তলা দিয়ে আপনার গায়ের চামড়ার রোদে-না-পোড়া আসল রংটা মাঝে মাঝে বেরিয়ে পড়ছে।
ভদ্রলোক চোখ গোল গোল করে বললেন, ওরেব্বাসরে, আপনার তো ভয়ঙ্কর অবজারভেশন মশাই! ঠিকই ধরেছেন। দিল্লি, আগ্ৰা, ফতেপুর সিক্রি—এই সব একটু ঘুরে দেখলুম। আর কী। দিন দশেক হল বেরিয়েচি। অ্যাদ্দিন স্রেফ বাড়িতে বসে বসে। দেশ-বিদেশের গপ্পো লিখিচি; থাকি ভদ্ৰেশ্বরে। এবার তাই ভাবলুম—একটু ঘুরে দেখা যাক, লেখার সুবিধে হবে। আর অ্যাডভেঞ্চারের গপ্পো এই সব দিকেই জমে ভাল, বলুন! দেখুন না। কী রকম সব রুক্ষ পাহাড়, বাইসেপ-ট্রাইসেপের মতো ফুলে ফুলে রয়েছে! বাংলাদেশের—এক হিমালয় ছাড়া—মাস্ল নেই মশাই। সমতলভূমিতে কি অ্যাডভেঞ্চার জমে?
আমরা তিনজনে রেউড়ি খেতে লাগলাম। জটায়ু দেখি মাঝে মাঝে আড়চোখে ফেলুদার দিকে, দেখছেন। শেষটায় বললেন, আপনার হাইট কত মশাই? কিছু মনে করবেন না।
প্রায় ছয়, ফেলুদা বলল। ওঃ, দারুণ হাইট। আমার হিরোকেও আমি ছয় করিচি। প্রখর রুদ্র–জানেন তো? রাশিয়ান নাম–প্রখর, কিন্তু বাঙালিকেও কী রকম মানিয়ে গেছে বলুন! আসলে নিজে যা হতে পারলুম না, বুঝেছেন, হিরোদের মধ্যে দিয়ে সেই সব আশ মিটিয়ে নিচ্চি। কম চেষ্টা করিচি মশাই হবার জন্যে? সেই কলেজে থাকতে চার্লস অ্যাটলাসের বিজ্ঞাপন দেখতুম বিলিতি ম্যাগাজিনে। বুক চিতিয়ে মাসূল ফুলিয়ে কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। কী হাতের গুলি, কী বুকের ছতি, কোমারখানা একেবারে সিংহের মতো। চর্বি নেই এক ফোঁটা সারা শরীরে। মাথা থেকে পা অবধি ঢেউ খেলে গেছে মাস্লের। বলছে-এক মাসের মধ্যে আমার মতো চেহারা হয়ে যাবে, আমার সিস্টেম ফিলো করে। ওদের দেশে হতে পারে। মশাই! বাংলাদেশে ইমপসিবল। বাপের পয়সা ছিল, কিছু নষ্ট করলুম, লেসন আনালুম, ফলো করলুম-কিসূ হল না। যেই কে সেই। মামা বললেন-পদাির রড ধরে ঝুলবি রোজ, দেখবি একমাসের মধ্যে হাইট বেড়ে যাবে। কোথায় একমাস! ঝুলতে ঝুলতে একদিন মশাই রড সুন্ধু খসে মাটিতে পড়ে হাঁটুর হাড় ডিসলোকেট হয়ে গেল, অথচ আমি সেই পাঁচ সাড়ে তিন-সেই পাঁচ সাড়ে তিনিই রয়ে গেলাম। বুঝলুম, টাগ অফ ওয়ারের দড়ির বদলে আমাকে ধরে টানলেও লম্বা। আমি হব না। শেষটায় ভাবলুম-দূত্তোরি, গায়ের মাসলের কথা আর ভাবিব না, তার চেয়ে ব্রেনের মাসলের দিকে অ্যাটেনশন দেওয়া যাক। আর মেনটাল হাইট। শুরু করলাম রোমাঞ্চ উপন্যাস লেখা। লালমোহন গাঙ্গুলী নাম তো আর চলে না, তাই নিলুম ছদ্মনাম৷–জটায়ু। ফাইটার। কী ফাইটটা দিয়েছিল রাবণকে বলুন তো!
ট্রেনটাকে ফাস্ট প্যাসেঞ্জার বললেও কাছাকাছির মধ্যে এত স্টেশন পড়ছে যে পনেরো-কুড়ি মিনিটের বেশি একটানা গাড়ি চলতেই পারছে না। ফেলুদা প্যারাসাইকলজিক্যাল পত্রিকা ছেড়ে এখন রাজস্থানের বিষয় একটা বই পড়তে শুরু করেছে। রাজস্থানের কেল্লার সব ছবি রয়েছে। এ বইতে। সেগুলো সে খুব খুঁটিয়ে দেখছে আর মন দিয়ে তাদের ধর্ণনা পড়ছে। আমাদের সামনে আপার বার্থে আরেকজন ভদ্রলোক রয়েছেন, তার গোঁফ আর পোশাক দেখলেই বোঝা যায় তিনি বাঙালি নন। ভদ্রলোক একটার পর একটা কমললেবু খেয়ে চলেছেন, আর তার খোসা আর ছিবড়ে ফেলছেন সামনে পাতা একটা উর্দু খবরের কাগজের উপর।
ফেলুদা পকেট থেকে একটা নীল পেনসিল বার করে হাতের বইটাতে দাগ দিচ্ছিল, এমন সময় লালমোহনবাবু বললেন, কিছু মনে করবেন না–আপনি কি মশাই গোয়েন্দা জাতীয় কিছু?
কেন বলুন তো?
না, মানে, যেভাবে ফস করে তখন আমার ব্যাপারটা বলে দিলেন…
আমার ও ব্যাপারে ইন্টারেস্ট আছে।
বাঃ! তা আপনারাও তো যোধপুরেই যাচ্ছেন বলে বললেন।