সেদিন সার্কিট হাউসের বাইরে তো আপনিই ঘুরছিলেন?
হ্যাঁ। আর তাতেও তো এক ফ্যাসাদ! মুকুল দেখি আমাকে চিনে ফেলেছে। অন্তত সেরকম একটা ভাব করেই গেট থেকে বেরিয়ে সোজা আমার দিকে চলে আসছিল।
তারপর আপনি ভবানন্দকে ফলো করে পোকরানের গাড়িতে উঠলেন?
হ্যাঁ। আর সবচেয়ে মজা–ট্রেন থেকে দেখতে পেলাম আপনারা গাড়ি থামাতে চেষ্টা করছেন।
সেটা নিশ্চয় ভবানন্দও দেখেছিল, আর তাই জেনে গিয়েছিল রামদেওরাতেই হয়তো আমরা ট্রেন ধরর।
ডক্টর হাজরা বলে চললেন, ‘ট্রেনে ওঠার আগে ত্রিবেদীকে ফোন করে জয়সলমীরে পুলিশকে খবর দিতে বলে দিয়েছিলাম। তার আগেই অবশ্য ওর বাড়ি থেকেই কলকাতায় ফোন করে আপনার আসার খবর পেয়েছি, আর ত্ৰিবেদীর কাছ থেকে একটি সুটি ধার করে ভদ্রলোক সেজেছি।
ফেলুদা বলল, পোকরানে গিয়ে বোধহয় দেখলেন ভবানন্দর অ্যাসিস্ট্যান্ট ট্যাক্সি নিয়ে হাজির, তাই না?
ওইখানেই তো গণ্ডগোল হয়ে গেল। আই লস্ট দেম। দশ ঘণ্টা অপেক্ষা করে আবার রাত্রের ট্রেন ধরতে হল। সে গাড়িতে যে আপনি আছেন, তা তো জানি না। আপনাদের প্রথম দেখলুম। এই ডাকবাংলোতে। এখন আমার প্রশ্ন হচ্ছে—আপনি কখন প্রথম ভবানন্দকে সন্দেহ করলেন?
ফেলুদা হেসে বলল, ভবানন্দকে সন্দেহ করেছিলাম বললে ভুল বলা হবে। করেছিলাম ডক্টর হাজরাকে। যোধপুরে নয়, বিকনিরে। দেবীকুণ্ডে গিয়ে দেখি ভদ্রলোক হাত-মুখ বাঁধা অবস্থায় পড়ে আছেন। তার ঠিক আগেই একটা দেশলাই কুড়িয়ে পাই-টেক্কা মার্কা। এটা রাজস্থানে বিক্রি হয় না। তারপর ভদ্রলোককে ওই বেগতিক অবস্থায় দেখে মনে হল, যে-লোক এই কুকর্মটি করেছে তারই হয়তো দেশলাই। কিন্তু তারপর দেখলাম বাঁধনেও গণ্ডগোল। একজন লোকের হাত-পা এক সঙ্গে বেঁধে দিলে সে লোক অসহায় হয়ে পড়তে পারে, কিন্তু যেখানে শুধু হাত দুটো পেছনে বেঁধে দেওয়া হয়েছে, সেখানে একটু বুদ্ধি থাকলেই পা দুটোকে ভাঁজ করে তার তলা দিয়ে হাত দুটো সামনে এনে বাঁধন খুলে ফেলা যায়। বুঝতে পারলাম ভদ্রলোক নিজেই নিজেকে বেঁধেছেন। এটা বুঝেও কিন্তু ভাবছি, ডক্টর হাজরাই আসল কালপ্রিট; শেষটায় চোখ খুলে গেল। আজ সকালে ট্রেনে-আপনার প্যাড়ে লেখা ভবানন্দর একটা চিঠির দিকে চেয়ে থাকতে থাকতে।
কীরকম?
কাগজের ওপরে আপনার নাম ছাপা হয়েছে, তাতে J দিয়ে হাজরা লেখা। আর ইনি নাম সই করেছেন চিঠির নীচে, তাতে দেখি Z। তখনই বুঝলাম এ হাজরা আসলে হাজরাই নন। কিন্তু ইনি তা হলে কে? নিশ্চয় যারা কলকাতায় নীলু। ছেলেটিকে ধরে নিয়ে গিয়েছিল তাদেরই একজন। আর অন্যটি হচ্ছেন্ন মন্দার বোস–যার ডান হাতের একটা নখ বড়, আর যার মুখে সিগারের গন্ধ আমিও পেয়েছি, নীলুও পেয়েছে। কিন্তু তা হলে আসল হাজরা কোন ব্যক্তি এবং তিনি এখন কোথায়? এর উত্তর একটাই হতে পারে-হাজরা হলেন তিনিই, যিনি নাগরা পরে পায়ে ফোসকা করেছিলেন, কিষণগড়ে আমাদের কামরায় উঠেছিলেন, সার্কিট হাউসের এবং বিকানির কেল্লার আশেপাশে ঘোরাঘুরি করছিলেন, এবং জয়সলমীরের ডাকবাংলোয় লাঠি হাতে খুঁড়িয়ে হাঁটছিলেন।
ডক্টর হাজরা বললেন, সুধীরবাবু আপনাকে খবর দিয়ে খুবই বুদ্ধিমানের কাজ করেছিলেন, কারণ আমি একা বাধহয় জুত করে উঠতে পারতাম না। ভবানন্দর অ্যাসিস্টান্টকে তো আপনারাই জব্দ করেছেন। এবারে তাঁর হাতেও হাতকড়াটি পড়লেই ষোলো কলা পূর্ণ হয়।
ফেলুদা লালমোহনবাবুর দিকে দেখিয়ে বলল, মন্দার বোসকে প্রথম সন্দেহ করার পিছনে কিন্তু এনার যথেষ্ট কনট্রিবিউশন আছে।
লালমোহনবাবু এর মধ্যে অনেকবার একটা কথা বলতে চেষ্টা করেছেন, কিন্তু পারেননি। এবার তিনি সেটা বলে ফেললেন–
আচ্ছা স্যার, তা হলে গুপ্তধনের ব্যাপারটা কী হচ্ছে?
ওটা ময়ুরে পাহারা দিচ্ছে দিক না!” বললেন ডক্টর হাজরা। ওদের বেশি ঘাঁটালে কী ফল হয়, সেটা তো দেখলেন।
ফেলুদা বলল, আপাতত আপনার কাছে যে গুপ্তধনটা রয়েছে সেটা তো ফেরত দিন মশাই! অবিশ্যি যেভাবে উচিয়ে রয়েছে, আপনার কোটটা কোমরের কাছে তাতে গুপ্ত আর বলা চলে না।
লালমোহনবাবু বেশ একটু মন-মরা ভাবেই মন্দার বোসের রিভলভারটা বার করে ফেলুদাকে দিয়ে দিলেন।
সেটা হাতে নিয়ে থ্যাঙ্ক ইউ বলেই ফেলুদা হঠাৎ কেমন জানি গভীর হয়ে গেল। তারপর রিভলভারটা নেড়েচেড়ে দেখল। তারপর বিড়বিড় করে বলল, কালিহারি মিস্টার ট্রটার-এভাবে ভাওতা দিলেন প্রদোষ মিত্তিরকে?
কী ব্যাপার? কী হল?–আমরা সমস্বরে বলে উঠলাম।
আরো এ যে একেবারেই ফাঁকি–মেড ইন জাপান-ম্যাজিশিয়ানরা স্টেজে ব্যবহার করে এই রিভলভার।
সকলে হেসে ফেটে পড়ার ঠিক আগে ফেলুদার হাত থেকে রিভলভারটা নিয়ে দাঁত বার করে জটায়ু বললেন, ফর মাই কালেকশন–অ্যান্ড অ্যাজ এ স্মৃতিচিহ্ন অফ আওয়ার পাওয়ারফুল অ্যাডভেঞ্চার ইন রাজস্থান! থ্যাঙ্ক ইউ স্যার।