গুরুবচন সিং বলল, ইয়ে হ্যাঁয় মোহনগড় যানেকা রাস্তা। আউর এক মিল যানা সেকতা। উসকে বাদ রাস্তা বহুৎ খারাপ হ্যায়। জিপ ছাড়কে দুস্রা গাড়ি নেহি যাত৷
এক মাইলও অবিশ্যি যেতে হল না; কিছু দূর গিয়েই দেখতে পেলাম রাস্তার এক ধারে একটা ট্যাক্সি দাঁড়িয়ে আছে। রাস্তার ডান দিকে খানিকটা দূরে রয়েছে একসঙ্গে অনেকগুলো পরিত্যক্ত একতলা, ছাত-ছাড়া খুপরির মতো পাথরের বাড়ি। বুঝলাম, এটাও হচ্ছে একটা প্রাচীন গ্রাম, যেমন গ্রাম আমরা এর আগে আরও দু-একটা দেখেছি। এ সব গ্রাম থেকে লোকজন নাকি বহুকাল আগে চলে গেছে; শুধু দেয়ালগুলো পাথরের তৈরি বলে এখনও দাঁড়িয়ে আছে।
গুরুবচন সিংকে অপেক্ষা করতে বলে আমরা বাড়িগুলোর দিকে এগোলাম। সদািরজি দেখলাম গাড়ি থেকে নেমে অন্য ট্যাক্সির দিকে এগিয়ে গোল—বোধহয় জাতভাইয়ের সঙ্গে আড়মণ্ড মারতে।
চারিদিক থমথম করছে। পিছন দিকে চাইলে দূরে দেখা যাচ্ছে পাহাড়ের মাথায় জয়সলমীরের কেল্লা। রাস্তার উলটা দিকে খাড়াই উঠে গেছে পাহাড়। তার ঠিক পায়ের কাছে একটা প্ৰকাণ্ড খোলা জায়গা জুড়ে মাটিতে পোঁত শিল-নোড়ার মতো হলদে পাথরের সারি। ফেলুদা ফিসফিস করে বলল, যোদ্ধাদের কবর।
লালমোহনবাবু খসখসে মিহি গলায় বললেন, আমার কিন্তু আবার লো ব্লাড প্ৰেশার।
কিচ্ছু ভাববেন না, ফেলুদা বলল, দেখতে দেখতে হাই হয়ে যেমনটি চাই তেমনিটি হয়ে যাবে।
বাড়িগুলোর কাছে এসে পড়েছি। সারি সারি বাড়ির মাঝখান দিয়ে চলে গেছে সোজা রাস্তা। বেশ বুঝলাম, এ গ্রাম বাংলাদেশের গ্রামের মতো নয়। এর মধ্যে একটা সহজ জ্যামিতিক প্ল্যান আছে।
কিন্তু ট্যাক্সির যাত্রীরা কোথায়? মুকুল কোথায়? ডক্টর হেমাঙ্গ হাজরা কোথায়?
মুকুলের কিছু হয়নি তো?
হঠাৎ খেয়াল হল কানো একটা শব্দ আসছে-এখনও খুবই আস্তে–কিন্তু কান পাতলে শোনা যায়। খট্-খট্-খট্…
অত্যন্ত সাবধানে একটুও শব্দ না করে আরও কয়েক পা এগিয়ে দেখলাম, একটা চৌরাস্তায় এসে পড়েছি। আমরা এখনও দুটো রাস্তার ক্রসের মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছি। ডান দিক দিয়ে শব্দটা আসছে। রাস্তার দু দিকে দশ-বারোটা বাড়ির সারি—তাদের দেয়াল আর দরজার ফাঁকগুলো শুধু দাঁড়িয়ে আছে।
আমরা ডান দিকের রাস্তাটা ধরেই পা টিপে টিপে এগোতে লাগলাম।
ফেলুদা দাঁতের ফাঁক দিয়ে প্রায় শোনা যায় না এমনভাবে বলল, রিভলভার–আর সেই সঙ্গে তার নিজের হাতটাও চলে গেল কোটের ভিতর। আড়চাখে দেখলাম লালমোহনবাবুর হাতেও রিভলভার এসে গেছে, আর সেটা অসম্ভব কাঁপছে।
হঠাৎ একটা খচমচ আওয়াজ শুনে আমরা থমকে দাঁড়ালাম, আর তার পরমুহুর্তেই দেখলাম রাস্তার শেষ মাথায় বাঁ দিকের একটা বাড়ির দরজা দিয়ে মুকুল দৌড়ে বেরিয়ে এল-তারপর আমাদের দেখতে পেয়ে আরও দ্বিগুণ জোরে ছুটে এসে ফেলুদার বুকের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। সে হাঁপাচ্ছে, তার মুখ রক্তহীন ফ্যাকাশে।
আমি জিজ্ঞেস করতে যাচ্ছিলাম কী হয়েছে, কিন্তু ফেলুদা ঠোঁটে আঙুল দিয়ে আমার কথা বন্ধ করে দিল।
ফিসফিস করে একে একটু দেখুন বলে মুকুলকে লালমোহনবাবুর জিম্মীয় রেখে ফেলুদা নিঃশব্দে এগিয়ে চলল যেখান থেকে মুকুল বেরিয়েছে সেই দিকে। আমিও চললাম তার পিছন পিছন।
এগোনোর সঙ্গে সঙ্গে শব্দটা বাড়ছে। মনে হল কে যেন পাথর নিয়ে নাড়াচাড়া করছে—খট্–খটাং—খুট্–খুট্…
বাড়িটার কাছে পৌঁছে দেয়ালের দিকটায় ঘেঁষে গেল ফেলুদা।
আর তিন পা বাড়াতেই দরজার হাঁ করা ফাঁকটা দিয়ে দেখলাম। ডক্টর হাজরাকে। ঘরের এক কোণে দাঁড়িয়ে আমাদের দিকে পিঠ করে পাগলের মতো একটা ভাঙা পাথরের স্তৃপ থেকে একটার পর একটা পাথর তুলে এক পাশে ফেলছেন। আমরা যে এসে দরজার মুখে দাঁড়িয়ে তাকে দেখছি, সেটা তাঁর খেয়ালই নেই।
আরেক পা সামনে এগোল ফেলুদা—তার হাতে রিভলভার ডক্টর হাজরার দিকে উঁচোনো।
হঠাৎ উপর দিক থেকে একটা ঝটপট শব্দ।
একটা ময়ূর পাঁচিলের উপর থেকে লাফিয়ে পড়েছে।
মাটিতে পড়েই তীরবেগে ছুটে গিয়ে ময়ূরটা উপুড় হওয়া ডক্টর হাজরার বাঁ কানের ঠিক নীচে একটা সাংঘাতিক ঠোকর মারল। ডক্টর হাজরা যন্ত্রণায় আর্তনাদ করে হাত দিয়ে ঠোকরানোর জায়গাটা চেপে ধরতেই তার সাদা শার্টের আস্তিনটা লাল হয়ে উঠল।
এদিকে ময়ূরটা ঠোকর মেরেই চলেছে। তার মধ্যেই ডক্টর হাজরা পালাতে গিয়ে আমাদের সামনে দেখে ভুত দেখার মতো ভাব করলেন। আমরা দরজা ছেড়ে পিছিয়ে দাঁড়ালাম, আর ময়ূর তাকে ঠুকরে ঘর থেকে বার করে দিল।
গুপ্তধনের জায়গায় যে ময়ুরের বাসা থাকবে, আর তার মধ্যে যে ডিম থাকবে—এটা বোধ হয় আপনি ভাবতে পারেননি।–তাই না?
ফেলুদার গলার স্বর ইস্পাত, তার রিভলভার ডক্টর হাজরার দিকে তাগ করা। বেশ বুঝতে পারছিলাম যে ডক্টর হাজরাই শয়তান, আর তার শাস্তিও হয়েছে চমৎকার, কিন্তু অন্য অনেক কিছুই এখনও এত ধোঁয়াটে রয়েছে যে, মাথাটা কেমন জানি গোলমাল হয়ে যাচ্ছিল।
একটা গাড়ির শব্দ পাওয়া গেল। ডক্টর হাজরা মাটিতে উপুড় হয়ে আছেন। তার ঘাড়টা আস্তে আস্তে ফেলুদার দিকে ফিরল, তাঁর বাঁ হাতটা এখন একটা রক্তাক্ত রুমাল সমেত ক্ষতের উপর চাপা।
ফেলুদা বলল, আর কোনও আশা নেই, জানেন। এবার আপনার দু দিকের রাস্তার বন্ধ।