ফেলুদা একটা গজা তুলে নিয়ে বলল, পাগড়িটা খোলার পর বোধহয় চুলটা আঁচড়াননি। ঘটনাটার কিছুক্ষণ পর যখন আপনার সঙ্গে দেখা হয়, তখন আপনার চুলের অবস্থাটা দেখেই সন্দেহ হয়েছিল।
ভদ্রলোক হেসে বললেন, কিছু মনে করবেন না স্যার–আপনাকে কিন্তু সেন্ট-পারসেন্ট গোয়েন্দা বলেই মনে হচ্ছে।
ফেলুদা এবার তার একটা কার্ড বার করে লালমোহনবাবুকে দিল। লালমোহনবাবুর দৃষ্টি উদ্ভাসিত হয়ে উঠল।
ওঃ!–প্রদোষ সি মিটার! এটা কি আপনার রিয়্যাল নাম?
আজ্ঞে হ্যাঁ! সন্দেহের কোনও কারণ আছে কি?
না, মানে ভাবছিলাম কী অদ্ভুত নাম
অদ্ভুত?
অদ্ভুত নয়? দেখুন না কেমন মিলে যাচ্ছে! –প্রদোষ–প্র হচ্ছে প্রফেসনাল, দোষ হচ্ছে ক্রাইম আর সি হচ্ছে–টু সি–অর্থাৎ দেখা–অর্থাৎ ইনভেস্টিগেট। অৰ্থাৎ প্রদোষ সি ইজ ইকুয়্যাল টু প্রফেসন্যাল ক্রাইম ইনভেস্টিগেটর!
সাধু সাধু।—আর মিটার?
মিটারটা একটু ভেবে দেখতে হবে, লালমোহনবাবু মাথা চুলকে বললেন।
কিসু ভাবার দরকার নেই। আমি বলে দিচ্ছি। ট্যাক্সি মিটার জানেন তো? সেই মিটার—অর্থাৎ ইন্ডিকেটর। তার মানে শুধু ইনভেস্টিগেশন নয়, অলসো ইনডিকেশন। ক্রাইমের তদন্তই শুধু নয়, ক্রিমিনাল বার করে তার দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ। হল তো?
লালমোহনবাবু ব্রাভো বলে হাততালি দিয়ে উঠলেন। ফেলুদা কিন্তু আবার সিরিয়াস। আরেকবার হাতের কাগজটার দিকে দেখে সেটাকে শার্টের বুক-পকেটে গুঁজে রেখে সিগারেটটা বার করে বলল, I এবং U-এর অবিশ্যি খুব সহজ মানে হতে পারে।I অর্থাৎ আমি এবং U অর্থাৎ তুমি, কিন্তু প্লাস ইউ-টা গোলমেলে। আর দ্বিতীয় লাইনটার কোনও কিনারাই করা যাচ্ছে না। …তোপসে, তুই বরং হান্ড-অলটা বিছিয়ে শুয়ে পড়। আপনিও—লালমোহনবাবু; এখনও তো সাড়ে সাত ঘণ্টা দেরি ট্রেন আসতে। আমি আপনাদের ঠিক সময়ে তুলে দেব।
কথাটা মন্দ বলেনি ফেলুদা। শুধু স্ট্র্যাপ দুটো খুলে হাল্ড-অলটাকে বিছিয়ে প্ল্যাটফর্মের উপর শুয়ে পড়লাম। চিত হওয়ামাত্র আকাশের দিকে চোখ গেল, আর তক্ষুনি বুঝতে পারলাম যে, একসঙ্গে এত তারা আমি জীবনে কখনও দেখিনি। মরুভূমিতে কি আকাশটা তা হলে একটু বেশি পরিষ্কার থাকে? তাই হবে।
আকাশ দেখতে দেখতে ক্ৰমে চোখটা ঘুমে বুজে এল। একবার শুনলাম। লালমোহনবাবু বলছেন, উটে চড়লে গাঁটে বেশ ব্যথা হয় মশাই। আর একবার যেন বললেন, এম ইজ মার্ডর। এর পর আর কিছু মনে নেই।
ঘুম ভাঙল ফেলুদার ঝাঁকানিতে।
তোপসে—উঠে পড়~~গাড়ি আসছে।
তড়াক করে উঠে হোল্ড-অল বেঁধে ফেলতে ফেলতে ট্রেনের হেড-লাইট দেখা গেল।
১০. মিটার গেজের প্যাসেঞ্জার গাড়ি
মিটার গেজের প্যাসেঞ্জার গাড়ি। কামরাগুলো তাই খুবই ছোট। যাত্রীও বেশি নেই, তাই একটা খালি ফাস্ট ক্লাস পাওয়াতে খুব একটা অবাক লাগল না।
কামরা অন্ধকার; হাতড়িয়ে সুইচ বার করে টিপে কোনও ফল হল না। লালমোহনবাবু বললেন,সভ্য দেশেই রেলের বালব লোপাট হয়ে যায়, ডাকাতের দেশে তো ওটা আশা করাই ভুল।
ফেলুদা বলল, তোরা দুজন দু দিকের বেঞ্চিতে শুয়ে পড়। আমি মাঝখানের মেঝেতে শতরঞ্চি পেতে ম্যানেজা করছি। ঝাড়া ছ ঘণ্টা সময় আছে হাতে, দিব্যি গড়িয়ে নেওয়া যাবে।
লালমোহনবাবু একবার একটু আপত্তি করেছিলেন—আপনি আবার ফ্লোরে কেন মশাই, আমাকে দিন না-কিন্তু ফেলুদা একটু কড়া করে মোটেই না বলতে ভদ্রলোক বোধহয় গাঁটের ব্যথার কথা ভেবেই বেঞ্চিতে হান্ড-অল খুলে পেতে নিলেন।
গাড়ি ছেড়ে প্ল্যাটফর্ম পেরনের এক মিনিটের মধ্যেই কে একজন আমাদের দরজার পা-দানিতে লাফিয়ে উঠল। লালমোহনবাবু হেসে বলে উঠলেন, আরে বাবা, গাড়ি রিজার্ভ হায়। জেনানা কামরা হ্যায়।
এবারে ঝড়াক করে আমাদের দরজাটা খুলে গেল, আরেকটা উজ্জ্বল টর্চের আলো জ্বলে উঠে কয়েক মুহুর্তের জন্য আমার চোখ ধাঁধিয়ে দিল।
সেই আলোতেই দেখলাম, একটা হাত আমাদের দিকে এগিয়ে এসেছে, আর সে হাতে চকচক করছে একটা লোহার নলওয়ালা জিনিস।
আমাদের তিনজনেরই হাত মাথার উপর উঠে গেল।
এবার উঠুন তো বাবুরা! দরজা খালা আছে, একে একে নেমে পড়ুন তো বাইরে।
এ যে মন্দার বোসের গলা।
গাড়ি যে চলছে।–কাঁপা গলায় বলে উঠলেন লালমোহনবাবু।
শাট্ আপ। মন্দার বোস গর্জন করে দু পা এগিয়ে এলেন। টর্চের আলোটা অনবরত আমাদের তিনজনের উপর ঘোরাফেরা করছে। ন্যাকামো হচ্ছে। কলকাতায় চলন্ত ট্রাম-বাস থেকে ওঠানামা করা হয় না? উঠুন উঠুন–
কথাটা শেষ হতে না হতে এমন একটা ব্যাপার ঘটে গেল, যেটা আমি জীবনে কোনও দিন ভুলব না। ফেলুদার ডান হাতটা একটা বিদ্যুতের শিখার মতো নেমে এসে তার নিজের শতরঞ্চির সামনের দিকটা খামাচে ধরে মারল একটা প্রচণ্ড হ্যাঁচকা টান–আর তার ফলে মন্দার বোসের পা দুটো সামনের দিকে হড়কে ছটকে শূন্যে উঠে গিয়ে উপরের শরীরটা এক ঝটিকায় চিতিয়ে দাড়াম করে লাগল কামরার দেয়ালে। আর সেই সঙ্গে তার ডান হাত থেকে রিভলভারটা ছিটকে বেরিয়ে গিয়ে পড়ল লালমোহনবাবুর বেঞ্চিতে, আর বাঁ হাত থেকে জুলন্ত টর্চটা ফসকে গিয়ে পড়ল মেঝেতে।
মন্দার বাসের পুরো শরীরটা মাটিতে পড়বার আগেই লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়িয়েছে ফেলুদা–তার হাতে কোটের ভিতর থেকে বার করা তার নিজের রিভলভার।
গেট আপ! ফেলুদা মন্দার বোসকে উদ্দেশ করে গৰ্জিয়ে উঠল।