লোকগুলোর গায়ের রং একেবারে সদ্য কালি দিয়ে বুরুশ করা নতুন জুতোর মতো চকচকে। দুটোর মধ্যে একটা লোক এবার একটা সিগারেট বার করে মুখে পুরল, তারপর পকেট থাবড়ে-থুবড়ে একটা দেশলাইয়ের বাক্স বার করে সেটা খালি দেখে ট্রেনের লাইনের দিকে ছুড়ে ফেলে দিল। খচ করে একটা শব্দ শুনে ফেলুদার দিকে চেয়ে দেখি, সে তার লাইটারটা জ্বলিয়ে লোকটার দিকে এগিয়ে দিয়েছে। লোকটা প্রথমে একটু অবাক, তারপর মুখ বাড়িয়ে সিগারেটটা ধরিয়ে ফেলুদার কাছ থেকে লাইটারটা নিয়ে নেড়েচেড়ে দেখে এখানে-সেখানে টিপে ফস করে সেটাকে জ্বালাল। লালমোহনবাবু কী জানি বলতে গেলেন, কিন্তু গলা দিয়ে পরিষ্কার আওয়াজ বেরোল না। লোকটা আরও তিনবার লাইটারটা জ্বলিয়ে-নিভিয়ে সেটা ফেলুদাকে ফেরত দিয়ে দিল। লালমোহনবাবু এবার ঢাকনা লাগানো টিনটা সুটকেসে ভরতে গিয়ে পুরো টিনটাই হাত থেকে ফেলে গতবারের চেয়ে আরও চারগুণ বেশি শব্দ করে বসলেন। ফেলুদা সে দিকে কোনও ভুক্ষেপ না করে তার থলি থেকে নীল খাতটা কার করে এই টিমটিমে আলোতেই সেটা উলটে-পালটে দেখতে লাগল।
হঠাৎ লক্ষ করলাম, টিকিট ঘরের পিছনে কিছুটা দূরে একটা কাঁটা ঝোপের উপর কেথেকে জানি একটা আলো এসে পড়েছে।
আলোটা বাড়ছে। এবার একটা গাড়ির আওয়াজ পেলাম। জয়সলমীরের দিক থেকে আসছে গাড়িটা। যাক্ বাবা! মনে হচ্ছে গুরুবচনের সমস্যার সমাধান হলেও হতে পারে।
গাড়িটা হুশ করে নাকের সামনে দিয়ে যোধপুরের দিকে চলে গেল। ঘড়িতে দেখলাম সাড়ে সাতটা।
ফেলুদা খাতা থেকে মুখ তুলে লালমোহনবাবুর দিকে চাইল। তারপর বলল, আচ্ছা! লালমোহনবাবু, আপনি তো গল্প-টল্প লেখেন, বলুন তো ফোসকা জিনিসটা কী এবং ফোসকা কোন পড়ে।
ফোসকা?… ফোসকা?… লালমোহনবাবু থাতমত খেয়ে গেছেন। কেন পড়ে মানে, এই ধরুন আপনি সিগারেট ধরাতে গিয়ে হাতে ছ্যাঁকা লাগল—
সে তো বুঝলাম—কিন্তু ফোসকা পড়বে কেন?
কেন? ও–আই সি-কেন…
ঠিক আছে। এবার বলুন তো একটা লোককে মাথার উপর থেকে দেখলে তাকে বেঁটে মনে হয় কেন?
লালমোহনবাবু চুপ করে হাঁ করে চেয়ে রইলেন। আবছা আলোয় দেখলাম। তিনি হাত কচলাচ্ছেন। পাশের লোক দুটো এক সুরে একভাবে গল্প করে চলেছে। ফেলুদা একদৃষ্টি লালমোহনবাবুর দিকে তাকিয়ে রয়েছে।
লালমোহনবাবু জিভ দিয়ে ঠোঁট চেটে বললেন, আমাকে এ সব, মানে, কোশ্চেন—
আরেকটা প্রশ্ন আছে লালমোহনবাবু—এটার উত্তর আপনি নিশ্চয় জানেন।
লালমোহনবাবু নির্বাক। ফেলুদা যেন তাঁকে হিপ্নোটাইজ করে ফেলেছে।
আজ সকালে আপনি সার্কিট হাউসের পিছনের বাগানে আমার জানালার কাছে কী করছিলেন?
লালমোহনবাবু এক মুহুর্ত পাথর। তারপরেই তিনি একেবারে হাত-পা ছুঁড়ে হাউমাউ করে উঠলেন।
আরো মশাই–আপনার কাছেই তো যাচ্ছিলুম! আপনারই কাছে! এমন সময় ময়ূরটা এমন চেঁচিয়ে উঠল—আর তারপর একটা চিৎকার শুনলাম-কেমন জানি নার্ভাস-টার্ভাস হয়ে…
আমার ঘরে যাবার কি অন্য রাস্তা ছিল না? আর আমার কাছে আসার জন্য মাথায় পাগড়ি আর গায়ে চাদর দিতে হয়?
আরো মশাই, গায়ের চাদর তো বিছানার চাদর, আর পাগড়ি তো সার্কিট হাউসের তোয়ালে! একটা ডিজগাইজ না হলে লোকটার উপর স্পাইং করব কী করে?
কোন লোকটা?
মিস্টার ট্রটার! ভেরি সাস্পিশাস্! ভাগ্যে গোসলুম। কী পেলুম দেখুন না, ওর জানলার বাইরে ঘাসের উপর। সিক্রেট কোড! এইটেই তো আপনাকে দিতে যাচ্ছিলুম, আর ঠিক সেই সময় ময়ূরটা চেচামেচি লাগিয়ে সব ভণ্ডুল করে দিলে৷
আমি লক্ষ করছিলাম। লালমোহনবাবুর ঘড়িটা। সত্যি, এই ঘড়িটাই তো দেখেছিলাম ছাত থেকে।
লালমোহনবাবু সুটকেস খুলে তার খাপ থেকে একটা কোঁকড়ানো কাগজের টুকরো বার করে ফেলুদাকে দিল। বুঝলাম কাগজটাকে দল পাকানো হয়েছিল, সেটা আবার সোজা করা হয়েছে।
ফেলুদার পাশে গিয়ে কেরোসিনের আলোতে দেখলাম কাগজটায়ু পেনসিল দিয়ে লেখা আছে–
IP 1625+U
U–M
ফেলুদা ভীষণভাবে ভুরু কুঁচকে কাগজটার দিকে চেয়ে রইল। আমি এই অ্যালজেব্রার মাথামুণ্ডু কিছুই বুঝলাম না, যদিও লালমোহনবাবু দুবার ফিস্ ফিস্ করে বললেন, হাইলি সাস্পিশাস্।
ফেলুদা ভাবছে, আর ভাবতে ভাবতে আপন মনে বিড়বিড় করছে—
ষোল শ পাঁচিশ…ষোল শ পঁচিশ..এই সংখ্যটা কোথায় যেন দেখেছি রিসেন্টলি?…
ট্যাক্সির নম্বর?? আমি জিজ্ঞেস করলাম।
উঁহু, ষোল শ পঁচিশ…সিক্সটিন টোয়েন্টি ফা—”
ফেলুদা কথাটা শেষ না করে এক ঝটিকায় থলে থেকে ব্র্যাড্শ টাইম টেবিলটা বার করল। পাতা ভাঁজ করা জায়গাটায় খুলে পাতার উপর থেকে নীচের দিকে আঙুল চালিয়ে এক জায়গায় এসে থামল।
ইয়েস। সিক্সটিন টোয়েন্টি ফাইভ হচ্ছে অ্যারাইভ্যাল।
কোথায়? জিজ্ঞেস করলাম।
পোকরানে।
বললাম, তা হলে তো P-টা পোকরান হতে পারে। পোকরানে সিক্সটিম টোয়েন্টি ফাইভ। আর বাকিটা?
বাকিটা…বাকিটা…আই পি-আবার প্লাস ইউ।
তালার Mটা কিন্তু ভাল লাগছে না মশাই, লালমোহনবাবু বললেন। M বললেই কিন্তু মার্ডার মনে পড়ে।
দাঁড়ান মশাই–আগে ওপরেরটার পাঠোদ্ধার করি।
লালমোহনবাবু বিড়বিড় করে বললেন, মার্ডার…মিসট্রি…ম্যাসাকার…মনস্টার…
ফেলুদা কোলের উপর কাগজটা খোলা রেখে ভাবতে লাগল।।
লালমোহনবাবু গজার টিনটা বার করে আমাদের আবার অফার করলেন। আমি একটা নেবার পর ফেলুদার দিকে টিনটিা এগিয়ে দিয়ে ভদ্রলোক বললেন, ভাল কথা—আমিই যে আপনার জানালার কাছে গিয়েছিলুম, সেটা কী করে বুঝলেন স্যার? আপনি কি আমায় দেখে ফেলেছিলেন নাকি?